‘ডেভিল হান্ট’ চলাকালীন ট্রিপল মার্ডার

ঝিনাইদহে ফের মাথাচাড়া দিয়েছে চরমপন্থিরা

নিষিদ্ধ ঘোষিত সশস্ত্র দলগুলোর ‘ঘুরে দাঁড়ানো’র মহড়া চলছে * বেড়েছে অস্ত্রধারীদের আনাগোনা, ডাকাতি-ছিনতাই ঘটছে অহরহ * হত্যার আগে ফোনে ডেকে নেওয়া হয় হানিফ ও রাইসুলকে


ঝিনাইদহে ফের মাথাচাড়া দিয়েছে চরমপন্থিরা
ঝিনাইদহ অঞ্চলে চরমপন্থিরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত সশস্ত্র দলগুলো ‘ঘুরে দাঁড়ানো’র প্রতিযোগিতায় মাঠে নেমে পড়েছে। মজুত করা অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করছেন তারা। শুক্রবার পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির হরিণাকুণ্ডু অঞ্চলের সাবেক কমান্ডার হানিফ ওরফে হানেফসহ তিনজন গুলিতে নিহত হওয়ার পর বিষয়টি স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জোরদার করা হয়েছে যৌথ বাহিনীর চলমান অভিযান। ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চলা অবস্থায় ট্রিপল মার্ডারের এই ঘটনায় হকচকিয়ে গেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা। এ হত্যাকাণ্ডে অত্যাধুনিক নাইন এমএম পিস্তল ও শটগানের গুলি ব্যবহার করা হয়েছে। উদ্ধার করা ম্যাগাজিন ও গুলি থেকে তেমন প্রমাণ মিলেছে বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন।এদিকে শুক্রবার রাতে ঝিনাইদহের শৈলকুপায় গুলিতে নিহত তিনজনের পরিচয় মিলেছে। তারা হলেন-হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আহাদনগর ঠকপাড়া গ্রামের মৃত রায়হান উদ্দিনের মেজো ছেলে চরমপন্থি দলের নেতা মো. হানিফ ওরফে হানেফ। তিনি নিষিদ্ধ চরমপন্থি দল পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক আঞ্চলিক কমান্ডার। নিহত অপর দুজন হলেন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পিয়ারপুর গ্রামের আরজেত মণ্ডলের একমাত্র ছেলে রাইসুল ইসলাম এবং হরিণাকুণ্ডু উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের উমাদ মন্ডলের ছেলে লিটন। ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল মর্গে তাদের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে শনিবার বিকাল ৪টার দিকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ।জানা যায় ১৯৯৯ সালের শেষ দিকে তৎকালীন সরকার সশস্ত্র চরমপন্থি দলগুলোকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করে। ওই বছরের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, খুলনা, যশোর ও ঝিনাইদহ জেলার ২২ জন বাহিনী প্রধানসহ ২ হাজার ৫৯৪ জন নামমাত্র দেশীয় পিস্তল, কাটা বন্দুক, পাইপগান জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। ওই সময় শুধু যশোরের টপ সন্ত্রাসী হাসান বাহিনীর প্রধান একটি বিদেশি এসএমজি (সাব মেশিন গান) জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। সে সময় পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ ২২ এবং সর্বহারা পার্টির ১৩ জন শক্ত অবস্থান নিয়ে আত্মসমর্পণ করেননি। নানা নামে পুলিশ-র‌্যাবের অভিযান চলতে থাকে। বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি তিতাস ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর নড়াইলে কৃষক নেতা হেমন্ত সরকার আত্মগোপনে চলে যান এবং স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু কিছুতেই থামে না চরমপন্থিরা।২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর বেপরোয়াভাবে কথিত ক্রসফায়ারে মেতে উঠে র‌্যাব-পুলিশ। ক্রসফায়ার বাণিজ্যে পকেট ভারী হতে থাকে তাদের। জনযুদ্ধের আব্দুর রশিদ মালিথা তপন, খুলনার মৃণাল, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির (হক) দেবু গোল্ডেন শিহাব, কুষ্টিয়ার শাহিন-মুকুল বাহিনীর শাহিন, একদিল, ইত্তেহাদ, কোটচাঁদপুরের ডাক্তার টুটুল, পূর্ববাংলার থিকট্যাংক মাফখারুল ইসলামসহ শত শত কথিত সশস্ত্র বিপ্লবী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মারা যেতে থাকে। গণমুক্তি ফৌজ নামে প্রকাশ্যে একটি দল গঠন করেন বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মীর ইলিয়াস হোসেন দিলিপ। ঝিনাইদহ জেলা শহরের পাগলা কানাই মোড়ে ব্রাশফায়ারে নিহত হন দিলিপ ও তার সহযোগী আলফাজ উদ্দিন। দিশেহারা হয়ে অস্ত্রধারীরা প্রকাশ্যে রাজনীতিতে জড়িয়ে প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করেন। ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর লুকিয়ে থাকা ওই সব সশস্ত্র ব্যক্তিরা সক্রিয় হয়ে উঠে। ৩ ফেব্রুয়ারি সেনা সদস্যরা একটি আর্জেস গ্রেনেড উদ্ধার করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ-র‌্যাবের চলমান বেহাল অবস্থার সুযোগে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, চৌগাছা, মহেশপুর এলাকায় তৎপর হয়ে উঠে সশস্ত্র গ্রুপগুলো।নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ : পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সময় লুট হওয়া অস্ত্র ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশে। পাড়া-মহল্লার সন্ত্রাসীদের হাত ঘুরে নব্য চরমপন্থিদের হাতে চলে এসেছে এসব অস্ত্র। হরিণাকুণ্ডু থেকে প্রাপ্ত খবরে বলা হয়েছে হাসিনা সরকার পতনের পর হানেফ ও তার শ্যালক দল সংগঠিত করার চেষ্টা করছিল। কুষ্টিয়াকেন্দ্রিক হানেফের প্রতিপক্ষ সশস্ত্র চরমপন্থিরা বিষয়টি টের পেয়ে যায়। সূত্র মতে, শাহিন মারা গেলেও মুকুল জীবিত এবং বিদেশ থেকে বাহিনী পরিচালনা করে আসছে। বিভিন্ন দপ্তরে ঠিকাদারি ব্যবসা রয়েছে তার। শৈলকুপা অঞ্চলে বিলুপ্ত জাসদ গণবাহিনীর বেশিরভাগ কর্মী নিষ্ক্রিয় হলেও কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর ভেড়ামারা, রাজবাড়ির পাংশা, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা এলাকায় তৎপর হয়ে উঠেছে এরা। চুয়াডাঙ্গার লাল্টু বাহিনীর প্রধান লাল্টু আজও জীবিত। নাঙ্গলবাধ (শ্রীপুর) এলাকায় আধিপত্য গড়ে তুলেছে তার বিশেষ একটি বাহিনী। শহরকেন্দ্রিক পাণ্ডাদের হাতেও আগ্নেয়াস্ত্র আছে বলে গোপন সূত্রগুলো জানিয়েছে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলে কোটচাঁদপুরে অস্ত্রধারীদের আনাগোনা বেড়েছে। ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে। নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ।অস্ত্রধারীদের তৎপরতা বৃদ্ধির বিষয়ে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এমরান জাকারিয়া জানান, চরমপন্থিদের উত্থান হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখছে। প্রতিনিয়তই চেকপোস্টগুলোতে অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন থানা-ফাঁড়ির লুটের অস্ত্র-গোলাবারুদ সব এখনো উদ্ধার হয়নি। শুক্রবারের ট্রিপল মার্ডারের সঙ্গে জাসদ গণবাহিনী জড়িত এমন প্রচারের বিষয়টিতেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। যৌথ বাহিনীর চলমান অভিযান জোরদার করা হয়েছে বলেও জানান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।হত্যার আগে ফোনে ডেকে নেওয়া হয় হানেফকে : শুক্রবার রাতে শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের জঙ্গলঘেরা নির্জন শশ্মান ঘাট এলাকায় কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় তিনজনকে। রাতেই ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত হানেফের ছোট ভাই হরিনাকুণ্ডু উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি সাজেদুল ইসলাম ইশা জানান, শুক্রবার সন্ধ্যার কিছু আগে ফোন পেয়ে বাড়ি থেকে বের হন হানেফ। রাতেই তাকে হত্যার খবর পান তারা। শনিবার সকালে শৈলকুপা থানায় লাশ শনাক্ত করেন।এদিকে, প্রাপ্ত তথ্যমতে, পারিবারিক সূত্র ধরে হানেফ ঝিনাইদহ-২ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠজন হয়ে উঠেন। সেই সূত্রে একাধিক মামলায় ফাঁসিসহ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হানেফ ১৪ বছর কারাভোগের পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিশেষ ক্ষমায় ৩ বছর আগে সব মামলা থেকে খালাস পান। এরপর ঢাকায় লেগুনা চালিয়ে জীবনধারণ করছিলেন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাড়ি আসার পথে কুষ্টিয়া থেকে র‌্যাব আটক করে তাকে। উপজেলা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে জামিনে মুক্ত হন হানেফ। হরিণাকুণ্ডু উপজেলা মৎস্যজীবী লীগের সহসভাপতিও ছিলেন তিনি। নিহত লিটন হানেফের স্ত্রী শান্তির সৎভাই।রাইসুলও ফোন পেয়ে ঘর থেকে বের হন : নিহত কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পিয়ারপুর গ্রামের রাইসুল ইসলামের মামা শরিফুল ইসলাম ও খালাতো ভাই জাহিদুল ইসলাম জানান, দুই মাস আগে মারা গেছেন রাইসুলের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বাবা আরজেত মণ্ডল। ঝিনাইদহ সরকারি কেশব চন্দ্র মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাশ করার পর কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স শেষ করেন রাইসুল। চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগছিলেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় ফোন পেয়ে নিজের পালসার মোটরসাইকেলে বাড়ি থেকে বের হন। এলাকায় ভালো একজন ফুটবল খেলোয়াড় হিসাবে পরিচিতি ছিল তার।এদিকে অনুসন্ধানে জানা যায়, হরিণাকুণ্ডু উপজেলার কায়েতপাড়া গ্রামে নারায়ণকান্দি কায়েতপাড়া নামে একটি সরকারি বাঁওড় (জলাশয়) রয়েছে। ওই বাঁওড়ে তালিকাভুক্ত মৎস্যজীবীরা মাছ চাষ করে থাকেন। সুদীর্ঘ অতীত থেকে বাঁওড়টি চরমপন্থিরা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। এক সময় বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির (হক) আঞ্চলিক নেতা মফিজ (ক্রসফায়ারে নিহত) বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। পরবর্তীতে নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির হাতে। হানেফ এলাকায় পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির বাহিনীপ্রধান হওয়ার পর মানুষের রক্ত নিয়ে হোলিখেলা শুরু হয়। বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির (হক) নেতাকর্মীরা দিশেহারা হয়ে পড়েন।