টি২০- তে নতুন রূপকথা


ক্রিকেটের কেতাবি ভাষায় ‘হোয়াইটওয়াশ’। বাংলায়– ‘বাংলাওয়াশ’। যে যেভাবে বলে বলুক, আবেগ মেশানো ‘ওয়াশ’ তো রয়েছে তাতে। ইংল্যান্ড হোয়াইটওয়াশ– ভাবতেই ভালো লাগে। ‘ইতিহাস’ শব্দটি ক্লিশে হয়ে গেছে সিরিজ জয়ের পরই। গতকাল এর চেয়েও বেশি কিছু হয়েছে। একঝাঁক সাহসী আর টগবগে তরুণের হাত ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুন দিনের সূচনা হয়েছে মিরপুরে। বাংলাদেশ বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের সব ম্যাচ হারিয়েছে টি২০ সিরিজে। এ সাফল্যকে বর্ণনা করতে আলাদা করে বিশেষণ খোঁজার প্রয়োজন হয় না। হোয়াইটওয়াশ শব্দ দিয়েই সবকিছু প্রকাশ করা হয়ে যায়। অবিশ্বাস্য এমন কিছু করে ফেলা তো রূপকথাই, যেটা সাকিব আল হাসানের কল্পনারও বাইরে গিয়ে পাওয়া। সিরিজ আগেই নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় শেষ ম্যাচটি ইংলিশদের কাছে ছিল মর্যাদার লড়াই। সেই লড়াইয়ে হেরে বিমর্ষ বদনে দেশে ফিরছে চ্যাম্পিয়নরা। হ্যাঁ, একেবারে নিঃস্ব হয়ে নয়, একটি ট্রফি তারাও জিতেছে। একদিনের সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতেছে মিরপুরে। তবে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে টি২০ ক্রিকেটে। অথচ সিরিজ শুরুর আগে সাকিবরাও ভাবেননি এমন কিছু হতে পারে। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক জানান, সিরিজ শুরুর আগে ফলাফল নিয়ে ভাবেননি মোটেও। তাঁরা চেয়েছিলেন ভালো ক্রিকেট খেলতে। সেই ভালো এত ভালো হবে, তা সাকিবের কল্পনাতেও ছিল না। মিরপুরে বড় দলের বিপক্ষে সিরিজ জয় নতুন কিছু নয়। বছর দেড়েক আগে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছেন মাহমুদউল্লাহরা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের সঙ্গে আগের দুই সিরিজের মৌলিক পার্থক্য হলো অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটিওয়াশ করা যায়নি। খেলা হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ উইকেটে। সহনীয় মাত্রার চেয়েও নিম্ন মানের স্লো ও লো উইকেট ছিল সেবার। ইংলিশদের বিপক্ষে তেমন কিছু করেনি। উইকেট স্লো ও লো হলেও খেলার মতোই ছিল। চট্টগ্রামের প্রথম ম্যাচে ইংলিশদের ১৫৬ রান শোভন স্কোর। ওই রান তাড়া করেই জিতেছে বাংলাদেশ। সিরিজনির্ধারণী দ্বিতীয় ম্যাচটি ছিল লো স্কোরিং। তবে গতকালের পিচ রান করার জন্য ভালোই ছিল। সাকিব আর শান্ত শেষ পাঁচ ওভারে খোলসবন্দি না হলে দলের সংগ্রহ ১৭০ থেকে ১৭৫ রান হতে পারত। স্লগের পাঁচ ওভার থেকে মাত্র ২৭ রান যোগ করতে পারেন এ দুই ব্যাটার। ইংল্যান্ড টসে জিতে ফিল্ডিং নিয়েছিল বাংলাদেশকে কম রানে বেঁধে ফেলতে। সফরকারীদের সে পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে রনি তালুকদার ও লিন কুমার দাস ভালো শুরু করায়। রনি একবার জীবন পেয়ে ২২ বলে ২৪ রান করে আউট হলেও লিটন ধীরে এবং ধরে খেলে রানে ফেরেন। ৪১ বলে ৫০ রান করার পর হাত খোলেন। তিনি পরের ২৩ রান করেন ১৬ বলে। কে জানে শেষপর্যন্ত টিকে থাকলে প্রথম টি২০ সেঞ্চুরিটা করে ফেলতেন না তিনি। তখনও তো ১৮ বলের খেলা বাকি ছিল। লিটনের দিনে শান্তও ধারাবাহিকতা রেখেছেন। ৩৬ বলে ৪৭ রানে অপরাজিত তিনি। সিরিজজুড়েই দারুণ ছন্দে ছিলেন বাঁহাতি এ ব্যাটার। চট্টগ্রামে হাফ সেঞ্চুরির পর মিরপুরের দুই ম্যাচে করেন ৪৬ ও ৪৭ রান। উইকেট ব্যাটারদের জন্য ভালো হলেও ১৫৯ রান চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য। এর পরও ইংলিশ টপঅর্ডার ব্যাটাররা লড়াই জমিয়ে তোলেন। অভিষিক্ত বাঁহাতি স্পিনার তানভির ইসলাম ইংলিশ ওপেনার ফিল সল্টকে রানের খাতা খুলতে না দিলেও দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন জস বাটলার ও ডেভিড মালান। ৯৫ রানের জুটি তাঁদের। এ জুটির ব্যাটিং দেখে মনেই হচ্ছিল না ইংল্যান্ড ম্যাচ হারতে পারে। বিশেষ করে মালান যেভাবে রান করছিলেন, তাতে বোলারদের তেমন কিছু করার ছিল না। বিশ্বাস হারানোর আগেই মুস্তাফিজুর রহমান জুটি ভাঙেন। ডেভিড মালানের উইকেটটিকে নিজের শততম টি২০ উইকেট বানান তিনি। সাকিবের পর মুস্তাফিজ দ্বিতীয় বোলার হিসেবে টি২০তে ১০০ উইকেট পেলেন। মালানের আউটের ঠিক পরের বলেই ঘটে অবিশ্বাস্য ঘটনা। মেহেদী হাসান মিরাজ বাটলারকে দুর্দান্তভাবে রানআউট করেন। পর পর ২ উইকেট পতনে ম্যাচেরও বাঁক বদল হয়। মঈন আলি, স্যাম কারেনরা মানিয়ে নিতে পারেননি। জিততে শেষ ওভারে ২৬ রান প্রয়োজন ছিল ইংল্যান্ডের। হাসান মাহমুদের প্রথম দুই বলে চার হাঁকালেও পরের চার বলে ব্যাটই লাগাতে পারেননি দুই ক্রিস- ওকস ও জর্ডান। ইংল্যান্ডকে থেমে যেতে হয় ১৪২ রানে। বাংলাদেশ ম্যাচ জেতে ১৬ রানে। আশা করা হচ্ছিল, জয়ের পর বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস হবে। কিন্তু মাঠে তেমন কিছুই দেখা গেল না। মুস্তাফিজ একটি স্টাম্প তুলে নিলেও বাকিরা করমর্দন আর কোলাকুলিতেই শেষ উদযাপন। পুরস্কার বিতরণী শেষে যে ছবিটি তোলা হলো, তাতেও আনন্দের আতিশয্যে ভেসে যাননি কেউই। বরং ক্রিকেটারদের চেয়েও বেশি খুশি দেখাচ্ছিল বিসিবি কর্তাদের। এ যেন বদলে যাওয়া এক বাংলাদেশ। সংবাদ সম্মেলনে সে বার্তাই দিয়ে গেছেন সাকিব।