ইউক্রেনে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এক টেবিলে বসেছেন ইউরোপীয় নেতারা। সঙ্গে ছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও। হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত সোমবারের ওই বৈঠকে ইউরোপীয় নেতারা যুদ্ধ বন্ধ ও ইউক্রেন তথা ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলেন।
ইউরোপীয় নেতারা যা বলেছেন—
মার্ক রুটে
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটে বলেন, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে যেভাবে মানুষ হত্যা হচ্ছে, তা বন্ধ করতে হবে। ইউক্রেনের অবকাঠামো ধ্বংসও আমাদের বন্ধ করতে হবে। এটি একটি ভয়াবহ যুদ্ধ। এ সময় তিনি ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ট্রাম্প ‘অচলাবস্থা ভেঙেছেন’।
উরসুলা ফন ডার লিয়েন
বৈঠকে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন বলেন, আমরা এখানে এসেছি ইউক্রেনের জন্য একটি ন্যায্য ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা, হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার লক্ষ্যে আপনার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে। প্রতিটি শিশুর পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
ফ্রিডরিখ মের্ৎস
জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস বলেন, আমি কল্পনাও করতে পারছি না যে, পরবর্তী বৈঠক যুদ্ধবিরতি ছাড়া হবে। ফলে আসুন আমরা এটি নিয়ে কাজ করি এবং রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করি।
জর্জিয়া মেলোনি
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি বলেন, আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলব। এর প্রথমটি হলো, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। এটা কীভাবে নিশ্চিত করা যায় যে, এটি (যুদ্ধ) আবার ঘটবে না। এটাই সব ধরনের শান্তির পূর্বশর্ত।
এমানুয়েল মাখোঁ
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেন, গত কয়েক বছর শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। আমাদের চাওয়া, জোরালো ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তি। এজন্য ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটাই সমাধানের একমাত্র পথ।
কিয়ার স্টারমার
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার বলেন, আমরা নিরাপত্তার কথা বলছি। এটা শুধু ইউক্রেনের নয়, পুরো ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তার কথাও বলছি। সে কারণে এটা এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
আলেকজান্ডার স্টাব
ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাব বলেন, প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, আজ আমরা যে এই টেবিলে বসেছি, এটা খুবই প্রতীকী। তা এই অর্থে যে, টিম ইউরোপ ও টিম যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সহায়তা করছে। ফিনল্যান্ডের রাশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির (সংঘাতের) অভিজ্ঞতা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা ১৯৪৪ সালে একটি সমাধান খুঁজে পেয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত যে, আমরা ২০২৫ সালে এসে রাশিয়ার আগ্রাসন বন্ধে একটি সমাধান পাব এবং একটি স্থায়ী ও ন্যায়সঙ্গত শান্তি অর্জন করতে সক্ষম হবো।
ডোনাল্ড ট্রাম্প
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ইউক্রেনে তিনি দীর্ঘমেয়াদি শান্তি চান। আর যুদ্ধ বন্ধের চুক্তির অংশ হিসেবে ইউক্রেনকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য ইউরোপকে সহায়তা করবে যুক্তরাষ্ট্র। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও জেলেনস্কিকে নিয়ে বৈঠক আয়োজনের কথাও বলেন ট্রাম্প।
সাংবাদিকেরা জানতে চান, যুদ্ধ বন্ধের পর ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মার্কিন শান্তিরক্ষীদের দেশটিতে পাঠানো হবে কি না? জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, আমরা ইউক্রেনের সঙ্গে কাজ করতে যাচ্ছি। দীর্ঘমেয়াদি শান্তি নিশ্চিত করার জন্য আমরা সবার সঙ্গে কাজ করব। এটি (চুক্তি) যেন কাজে আসে, সে জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই দেশের সঙ্গে কাজ করব।
ট্রাম্প বলেন, ইউক্রেনে শান্তি ফেরানোর জন্য যুদ্ধবিরতির প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন না। যুদ্ধ বন্ধের চুক্তিতে রাশিয়া, না ইউক্রেন—কার হাতে ‘তুরুপের তাস’ ভালো আছে, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, তিনি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চান না। কারণ, এই যুদ্ধ তাঁর না। সবার ভালোর জন্য যুদ্ধ শেষ হওয়া প্রয়োজন।
ইউক্রেনের নিরাপত্তার বিষয়ে ট্রাম্প বলেন, ইউক্রেনের নিরাপত্তায় বড় পরিসরে সহায়তা করবে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে প্রথমে ইউরোপকে নিরাপত্তার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রও যুক্ত হবে।
এ সময় জেলেনস্কি অনেকটাই চুপচাপ ছিলেন। যুদ্ধ বন্ধের বিনিময়ে ইউক্রেনের ভূখণ্ড ছাড় দেবেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের যুদ্ধ বন্ধ করা প্রয়োজন। রাশিয়াকে থামানো প্রয়োজন। কূটনৈতিক উপায়ে যুদ্ধ থামানোর ট্রাম্পের পরিকল্পনা সমর্থন করেন ইউক্রেনীয়রা। পুতিন ও ট্রাম্পের সঙ্গে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের কথাও বলেন তিনি।
এর আগে গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প। ওই বৈঠকে যুদ্ধ বন্ধের একটি চুক্তি হবে বলে ট্রাম্প প্রশাসনের কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত সেখানে এমন কোনো চুক্তির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তখন ট্রাম্প জানিয়ে দেন, কোনো চুক্তি হলে তা হবে যুদ্ধরত দুই পক্ষ রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যেই। এরপরই ট্রাম্প-জেলেনস্কি বৈঠকের ঘোষণা আসে।
পুতিনের সঙ্গে ওই বৈঠকের পর ট্রাম্পের সুরে বড় বদল আসে। আগে যেখানে তিনি ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির কথা বলছিলেন, সেখানে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধের কথা বলা শুরু করেন। এরই মধ্যে রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে পোস্ট দিয়ে ট্রাম্প জানিয়ে দেন, যুদ্ধ বন্ধের চুক্তির অংশ হিসেবে ইউক্রেন ক্রিমিয়া ফিরে পাবে না, ন্যাটোতেও যোগ দিতে পারবে না।
এ ছাড়া ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে পুতিন এমন কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেছেন, যা মেনে নেওয়া জেলেনস্কির পক্ষে প্রায় অসম্ভব। সূত্রের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, ইউক্রেনের রাশিয়ার দখল করা কিছু অংশ ছেড়ে দিতে চায় রাশিয়া। এর বিনিময়ে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক ইউক্রেনকে রাশিয়ার হাতে তুলে দিতে হবে। এতে কিয়েভ রাজি হলে সম্মুখসারিতে যুদ্ধ বন্ধ করবে মস্কো। তবে জেলেনস্কি বরাবরই রাশিয়ার হাতে নিজেদের ভূখণ্ড তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে। রোববার ওয়াশিংটনে পৌঁছানোর পর টেলিগ্রামে জেলেনস্কি লেখেন, ‘রাশিয়া যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, তা তাদের শেষ করতে হবে। আমি আশা করি, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় বন্ধুদের সঙ্গে আমাদের মিলিত শক্তি রাশিয়াকে সত্যিকারের শান্তি মেনে নিতে বাধ্য করবে।’