তাহলে এত গ্যাস যাচ্ছে কোথায়?


তাহলে এত গ্যাস যাচ্ছে কোথায়?
একটি টেক্সটাইল মিল চালাতে প্রতিদিন ১৫-২০ পিএসআই গ্যাস প্রয়োজন। অথচ দিনের অধিকাংশ সময় পাওয়া যায় মাত্র এক থেকে দেড় পিএসআই। গ্যাসের চাপ সব সময় ৫ পিএসআই-এর নিচে থাকে। একই অবস্থা প্রায় প্রতিটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে। এ কারণে দিনের অধিকাংশ সময় কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন শিল্পমালিকরা। অবস্থা এতই বেগতিক যে, দিনের পরিবর্তে রাতে কারখানা চালু রাখতে শ্রমিকদের বাড়তি বেতন দিচ্ছেন কেউ কেউ। যদিও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দাবি করা হয়েছে, শিল্পে গ্যাস সংকট নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া হচ্ছে। বাস্তবে গত বছরের তুলনায় এ সময়ে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে ২১ শতাংশ। এর মধ্যে এপ্রিলে বেড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ। এছাড়া বলা হয়, ২৮ মে থেকে অতিরিক্ত ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে।এদিকে গ্যাস সরবরাহের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে বুধবার পক্ষ থেকে গাজীপুর, আশুলিয়া এবং নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজারে বেশ কয়েকটি শিল্পকারখানা সরেজমিন অনুসন্ধান করা হয়। সকাল থেকে প্রতিনিধিরা কারখানায় উপস্থিত থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। এতে দেখা যায় সরকারের দাবির উলটো চিত্র। প্রতিটি কারখানায় গ্যাসের তীব্র সংকট, যা প্রয়োজন তার ধারেকাছে সরবরাহ নেই। নানারকম ঝামেলা হতে পারে বলে অনেকে প্রকৃত তথ্য দিতে চাননি। তবে সবাই এককথায় জানিয়েছেন, গ্যাসের চাপ নেই। বেশির ভাগ সময় শ্রমিকরা অলস বসে থাকেন। এতে চরমভাবে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পণ্য রপ্তানির টাইম শিডিউল কেউ ধরে রাখতে পারছেন না। এ কারণে শিল্পমালিকরা দিশেহারা।প্রসঙ্গত, গত রোববার বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনসহ রপ্তানি খাতের সাতটি সংগঠন আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে গ্যাস সংকট নিয়ে বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে শিল্পমালিকরা বলেন, গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের মতো এখন ২৫ সালে পরিকল্পিতভাবে শিল্পোদ্যোক্তাদের মেরে ফেলার পাঁয়তারা চলছে। এভাবে চলতে থাকলে কুরবানির ঈদের পর অর্ধেকের বেশি টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে যাবে। শিল্পোদ্যোক্তাদের এমন বক্তব্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সরকারও নড়েচড়ে বসে।পরদিন সরকারের তরফ থেকে এক প্রতিক্রিয়ায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দাবি করা হয়, গত বছরের তুলনায় এবার এপ্রিলে ক্যাপটিভ ও শিল্প খাতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। এ অবস্থায় ব্যবসায়ী মহলে প্রশ্ন উঠেছে-তাহলে এত গ্যাস যাচ্ছে কোথায়?বাংলাদেশ নিটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে সরকারকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। শিল্পাঞ্চলভেদে গ্যাস রেশনিং করা যেতে পারে। প্রয়োজনে আগামী অর্থবছরের বাজেটে এলএনজি আমদানিতে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে। কারণ মনে রাখতে হবে, শিল্পের চাকা সচল না থাকলে দেশের অর্থনীতি থমকে যাবে।যমুনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহসভাপতি শামীম ইসলাম বলেন, শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ পরিস্থিতি খুবই নাজুক। এর ফলে উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অথচ দিনদিন পরিচালন ব্যয় বেড়েই চলেছে। গ্যাসের অভাবে কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হলেও শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ঠিকই গুনতে হচ্ছে।তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এভাবে শিল্পমালিকরা কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের এনজেড টেক্সটাইল মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালেহউদ জামান বলেন, জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে শিল্পে গ্যাস সরবরাহের যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। আমার কারখানায় এক থেকে দেড় পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকে। এ চাপ দিয়ে কারখানা চালানো মোটেই সম্ভব নয়। পেট্রোবাংলা শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়াবে বলে জানিয়েছে। তবে এখনো গ্যাস পাইনি। তিনি আরও বলেন, গ্যাস সরবরাহ নিয়ে সরকার ও পেট্রোবাংলার তথ্যে ব্যাপক গরমিল দেখা যাচ্ছে। তিনি মনে করেন, সরকারকে অসহযোগিতা করতে প্রকৃত অবস্থা আড়াল করে ভুল তথ্য দেওয়া হচ্ছে। তবে গ্যাসের তথ্যে গরমিল খুঁজে বের করতে বিটিএমএ থেকে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। এ টিম সামগ্রিক চিত্র পর্যালোচনা করে প্রকৃত তথ্য শিগ্গিরই উপস্থাপন করবে।সালেহউদ জামান জানান, মোট গ্যাসের ১৮ শতাংশ শিল্প খাতে সরবরাহ করা হয়। আর ১৪ শতাংশ গ্যাস সিস্টেম লসে নষ্ট হয়। এই ১৪ শতাংশ গ্যাসের অপচয় রোধ করতে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা উচিত। কারণ, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পুলিশ ও তিতাস কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আর অবৈধ সংযোগের দায়ভার শিল্পকে বহন করতে হচ্ছে।গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনায় আউটপেস স্পিনিং মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার রাজিব হায়দার বলেন, শিল্প খাতে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। শিগ্গিরই এর উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যদিও পেট্রোবাংলা থেকে বারবার বলা হচ্ছে, সরবরাহ বাড়ানো হবে। কিন্তু বাস্তবে এর মিল পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, শিল্পে গ্যাসের সংকট হবে, এ কথা অন্তত এক বছর আগে থেকে বিটিএমএ বলে আসছে। তখন কেউ কর্ণপাত করেনি। এখন গ্যাস সংকট প্রকট আকার ধারণ করার পর সবার টনক নড়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এখন যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে না পারলে আগামী দিনে শিল্পে গ্যাস থাকবে না বললেই চলে। আর গ্যাস পেলেও এর জন্য শিল্পমালিকদের চড়া মূল্য দিতে হবে। কারণ, প্রতিনিয়ত গ্যাস উত্তোলন কমে আসছে। ৫-৬ বছরের মধ্যে আরও কমে আসবে। তখন এলএনজি আমদানির মাধ্যমে চাহিদা মেটাতে গেলে চড়া মূল্য দিতে হবে। তাই সরকারকে এখনই নতুন কূপ খননে মনোযোগ দেওয়া উচিত। তা না হলে সামনে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে।তিনি আরও বলেন, সস্তা শ্রম এবং কম দামে গ্যাসের ওপর নির্ভর করে দেশে শিল্প গড়ে উঠেছে। এখন শ্রমের দাম বাড়ছে, সঙ্গে গ্যাসেরও। অর্থাৎ দেশ রপ্তানি খাতে প্রতিযোগী সক্ষমতা হারাতে শুরু করেছে। তবে আরেকবার যদি বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে এ সেক্টরকে বাঁচানো যাবে না। ভবিষ্যতে এমন অবস্থা তৈরি হলে শিল্প বন্ধ হতে বাধ্য। তখন হয়তো সরকারের হাতে গ্যাস থাকবে; কিন্তু ব্যবহারের শিল্প থাকবে না। তাই সময় থাকতে ভোলার গ্যাস ঢাকায় আনতে পাইপলাইন স্থাপন ও সমুদ্রে অফশোর গ্যাস কূপ খননে মনোযোগ দিতে হবে।