তিন ভাইয়ের ‘নিয়ন্ত্রণে’মোহাম্মদপুর-আদাবর এক হয়েছে পাঁচ গ্যাং


তিন ভাইয়ের ‘নিয়ন্ত্রণে’মোহাম্মদপুর-আদাবর এক হয়েছে পাঁচ গ্যাং
ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, জমি দখলে সহায়তা, জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়, মাদক কারবার, খুনসহ জোট বেঁধে নানা অপরাধে জড়াচ্ছে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও আদাবরকেন্দ্রিক কিশোর গ্যাংগুলো। একসময় ছোট এসব অপরাধচক্র নির্দিষ্ট এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বজায় রেখে চালাত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। তবে, গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে পাঁচটি গ্যাং এক জোট হয়েছে। ‘রনি-জনি’, ‘টুন্ডা বাবু’, ‘পানি রুবেল’, ‘ভাইগ্না বিল্লাল’ ও ‘কবজি কাটা গ্রুপ’-এর সদস্যরা ভিড়েছে এক দলে। স্থানীয় থানা পুলিশ এবং একাধিক গ্যাং সদস্যের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে । মোহাম্মদপুর ও আদাবরকেন্দ্রিক সক্রিয় একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য গতকাল বুধবার বলেন, বছরখানেক আগেও মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় ছোট ছোট কিশোর গ্যাংয়ের আলাদা ‘গ্যাং ওয়ার’ (নিজের মধ্যে সংঘাত) হতো। এখন কিন্তু সেটা দেখা যায় না। সব গ্যাংকে এক করে ফেলেছে কবজি কাটা গ্রুপ। গত বছরের মাঝামাঝি সময় পুরো এলাকার নেতৃত্ব নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে কবজি কাটা গ্রুপের আনোয়ার ওরফে কবজি কাটা আনোয়ার ওরফে শুটার আনোয়ার। সর্বশেষ বড় ধরনের গ্যাং ওয়ার হয়েছে গত বছরের মাঝামাঝি সময়। আদাবর বালুর মাঠভিত্তিক ‘রনি-জনি’ গ্যাংয়ের একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা কেন্দ্র করে এই লড়াই হয় কবজি কাটা গ্রুপের সঙ্গে। সপ্তাহ ধরে চলা ওই লড়াইয়ে কবজি কাটা গ্রুপের কাছে এক অর্থে পরাস্ত হয় রনি-জনি গ্যাং। তখন বিষয়টি মধ্যস্থতা করে আরেক গ্যাং লিডার টুন্ডা বাবু। এ বাবু হলো রনি ও জনির দুলাভাই। রনি-জনি গ্যাং যখন কবজি কাটা গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, তখন পুরোনো সখ্য থাকায় টুন্ডা বাবু গ্রুপও যুক্ত হয় কবজি কাটা গ্রুপের সঙ্গে। এই অবস্থায় ভাইগ্না বিল্লাল গ্রুপ এবং পানি রুবেল গ্রুপ এলাকায় দুর্বল হয়ে পড়ায় বাধ্য হয়ে কবজি কাটা গ্রুপের সঙ্গে জোট করে। সবাই আলাদা নাম ও নেতৃত্বে চললেও তাদের নিয়ন্ত্রণ করে কবজি কাটা গ্রুপের আনোয়ার। তার অবর্তমানে (বর্তমানে কারাবন্দি) জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে রনি, জনি ও ওসমান।’ এই গ্যাং সদস্যের ভাষ্যের সত্যতা মেলে আদাবর থানা পুলিশের বক্তব্যেও। গতকাল থানাটির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম জাকারিয়ার কাছে প্রশ্ন করা হয় রনি-জনি গ্যাং তো গ্রেপ্তার হলো। পানি রুবেল ও ভাইগ্না বেলাল গ্যাংদের ব্যাপারে কী ভাবছেন? তিনি বলেন, ‘এখন আর কেউ আলাদা নেই। সবাই এক। রনি, জনি, পানি রুবেল ও ভাইগ্না বেলাল সব এক।’ গত সোমবার রাত ১১টার সময় আদাবর থানা-পুলিশ খবর পায় থানা এলাকার সুনিবিড় হাউজিংয়ের একটি গ্যারেজে দুজনকে জিম্মি করে রেখেছে রনি-জনি গ্যাং। জিম্মিদের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা আদায় করতে মারধর করা হচ্ছে। এই খবরে ভুক্তভোগীদের (প্রেমিক যুগল) উদ্ধারে সেই গ্যারেজের কাছে যায় থানার একটি টহল টিম। পুলিশ সেখানে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে চাপাতি ও ছুরি নিয়ে অতর্কিত হামলা করে রনি-জনিসহ পঞ্চাশ-ষাটজন। এতে আল আমিন নামে এক পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আহত আরও দুই পুলিশ সদস্য প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে কাজে ফিরেছেন। এ ঘটনায় আদাবর থানায় একটি মামলা হয়েছে। সেই মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে রনি-জনিসহ নয়জন। গতকাল বুধবার রাজধানীর কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর এলাকায় অভিযান চালিয়ে রনি-জনিকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) তেজগাঁও বিভাগ। ডিবি তেজগাঁও বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ রাকিব খান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘ডিবি তেজগাঁও বিভাগের একাধিক দল এই গ্যাং সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করে। পরবর্তী সময়ে আজ (গতকাল) ভোরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কেরানীগঞ্জ ও সাভার থানার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে কবজি কাটা গ্রুপের সক্রিয় সদস্য জনি ও রনিসহ নয় জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।’ তিন ভাইয়ের এক গ্যাং ‘রনি-জনি গ্রুপ’: আদাবর বালুর মাঠ থেকে গড়ে ওঠা ‘রনি-জনি গ্রুপ’ দুই ভাইয়ের নামে পরিচিত হলেও এই গ্যাং চালায় তিন ভাই। অপর ভাইয়ের নাম ওসমান। রনি ও জনির নাম সবাই জানলেও ওসমান থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাকেও পুলিশের ওপর হামলায় ঘটনায় গতকাল গ্রেপ্তার করা হয়। অপরাধে বড় ভাইয়ের চেয়ে এগিয়ে ছোট ভাই: রনি ও জনির মধ্যে রনি বড়। তবে অপরাধ কর্মকাণ্ডে এগিয়ে জনি। এ দুজনের পিসিপিআর (অপরাধীদের পূর্ববর্তী দণ্ড ও রেকর্ডসমূহের পরিসংখ্যান) ঘেঁটে জানা গেছে, গত প্রায় দুই বছরে জনির নামে আদাবর থানায় মামলা হয়েছে বারোটি। এসব মামলার মধ্যে বেশিরভাগই হত্যাচেষ্টা, অবৈধ অস্ত্র বহন, অপহরণ, মাদকসহ ইত্যাকার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রনির নামে ঢাকার আদাবর থানাসহ ঢাকার বাইরে কুড়িগ্রামের উলিপুর থানায় মোট পাঁচটি মামলা রয়েছে। পিসিপিআরের তথ্যমতে মাসখানেক আগেও এ দুজন একটি মামলায় জামিন নিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে এসেছে। ওসমান, রনি ও জনির পৈতৃক নিবাস কুড়িগ্রামের উলিপুরে। বাবা রফিকুল ইসলাম খোকন প্রায় পনেরো বছর আগে পরিবার নিয়ে ঢাকার আদাবর এলাকায় আসেন। আদাবরের তৈরি পোশাক কারখানা অধ্যুষিত এলাকায় এই তিন ভাই বেড়ে ওঠার এক পর্যায়ে জড়িয়ে যায় নানা অপরাধে। এক সময় চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ দিয়ে শুরু করলেও এখন গড়ে তুলেছে গ্যাং। নানা অপরাধের সঙ্গে করছে মাদক ব্যবসা। স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রনি-জনি গ্যাং বালুর মাঠে একটি নতুন গাজার স্পট খুলেছে। সেটা নিয়ে পুলিশের অভিযানের ভয় ছিল তাদের মধ্যে। ঘটনার দিন যখন এক গাড়িতে মাত্র তিনজন পুলিশ সদস্য এসেছিল, সেটা দেখেই তারা পুলিশের ওপর হামলে পড়ে। গ্রেপ্তার অভিযানে এক ডিবি সদস্য বলেছেন, মূলত এ স্পট নিয়ন্ত্রণ হয় কবজি কাটা গ্রুপের আনোয়ারের নির্দেশনায়। সে-ই জেলে বসে নির্দেশনা দেয় ও নানা অপরাধের কলকাঠি নাড়ে। যেমন গ্যাংগুলো কোথায় ভাড়ায় যাবে। কার ওপরে আক্রমণ করতে হবে এসব। গ্রেপ্তারের পর রনি, জনিসহ অন্যান্য গ্যাং সদস্যকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তেজগাঁও বিভাগের গোয়েন্দা শাখার ডিসি রাকিব খান বলেন, ‘আদাবর সুনিবিড় হাউজিং এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে গিয়ে মারামারি ও হাতের কবজি কাটাসহ বহু মানুষকে কুপিয়ে আহত ও পঙ্গু করেছে। শুধু কবজি কেটেই ক্ষান্ত হয়নি এই গ্রুপ, কবজি কেটে টিকটকে ভিডিও করে উল্লাসও করত। তারা আশপাশের এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মারামারি, মাদক সেবন, ইভটিজিংসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়াও অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, জবর-দখল, ভাড়ায় শক্তি প্রদর্শন, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন অপকর্মে চিহ্নিত এসব বেপরোয়া ও মাদকসেবী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।’