তীব্র অর্থ সংকটে সরকার


তীব্র অর্থ সংকটে সরকার
তীব্র আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাজস্ব আদায় হ্রাস, বিগত সরকারের নেওয়া ঋণ পরিশোধ বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির কারণে পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাওয়া-এ তিন কারণে মূলত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই সংকট মোকাবিলা করে সামনে এগোতে ও সরকারের পরিকল্পিত চলতি ব্যয় মেটাতেও ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আর্থিক দুরবস্থার কারণে সরকার কৃচ্ছ সাধনের নীতি গ্রহণ করেছে। উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় একেবারেই কম। এরপরও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ বাড়ছে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। সরকারি খাতের ঋণ বাড়ায় সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ সামান্য বেড়েছে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সূচকগুলোর হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে আইএমএফের এক প্রতিবেদনে সরকারি খাতের ঋণ কমাতে এবং বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে বলেছে। তারা বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ অব্যাহতভাবে নিম্নমুখিতাকে উদ্বেগজনক হিসাবে চিহ্নিত করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়েনি। বরং কমেছে দশমিক ০৩ শতাংশ। এ নিয়ে চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট এই দুই মাসেই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ নেতিবাচক। বেসরকারি খাতে আমদানি বাড়লেও রপ্তানি খাত, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ছে না। কয়েক বছর ধরেই এ খাতে মন্দা যাচ্ছে। গত বছরের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু হলে এ খাতে মন্দা আরও প্রকট হয়। এখনও সেই মন্দার প্রভাব কাটছে না। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের মাত্র ২৮ শতাংশ সরকারি খাতে যাচ্ছে। বাকি ৭২ শতাংশই যাচ্ছে বেসরকারি খাতে। এর মধ্যে গ্যাস, জ্বালানি তেল আমদানির ঋণ সরকারি খাতে গেলেও এর বড় অংশই ভোগ করে বেসরকারি খাত। ফলে বেসরকারি খাতের ঋণের অংশ আরও বেশি হবে। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি ২৩ লাখ কোটি টাকার মধ্যে বেসরকারি খাতে রয়েছে সাড়ে ১৭ লাখ কোটি টাকা, সরকারি খাতে সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমলেও কেবল সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ার কারণে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ বেড়েছে দশমিক ৩৬ শতাংশ। ঋণপ্রবাহ সরকারি খাতে বাড়ার কারণে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে এর তেমন কোনো ভূমিকা নেই। সরকার মূলত পরিকল্পিত চলতি ব্যয় নির্বাহ করতেই এসব ঋণ নিয়েছে। হঠাৎ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলে সরকারের অপরিকল্পিত ব্যয় বেড়ে যাবে, তখন ঋণ আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে সরকারি খাতে ঋণ বৃদ্ধির জন্য মূলত তিনটি কারণকে শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার সময়ে ব্যাপকভাবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে। এসব ঋণ ওই সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ে ডলার ও টাকার সংকটে পরিশোধ করতে পারেনি। ফলে ঋণের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। এতে ঋণের বিপরীতে সুদ ও দণ্ড সুদ বেড়ে ঋণ পরিশোধের স্থিতিও বেড়েছে। দেশের সুনাম ধরে রাখা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে ওইসব ঋণ এখন বর্তমান সরকার পরিশোধ করছে। একদিকে সরকারের কাঁধে বিগত সরকারের ঋণ পরিশোধের বোঝা, অন্যদিকে রাজস্ব আদায় একেবারেই তলানি। এ দুটো মিলে সরকারের অর্থ সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সরকার এখন ব্যয় নির্বাহ করছে মূলত আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কম সুদের ঋণের টাকায়। মাঝে মধ্যে সংকট এতটাই প্রকট আকার ধারণ করে যে, সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও ছাপানো টাকায় ঋণ নিতে হয়। তবে ছাপানো টাকার ঋণ সাময়িকভাবে নিলেও তা স্বল্প সময়ের মধ্যেই পরিশোধ করে দিচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট এই দুই মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় নেওয়া ঋণ পরিশোধ করেছে ৩ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংক খাত থেকেও ঋণ নিচ্ছে না সরকার। বরং এ খাত থেকে আগের নেওয়া ঋণের মধ্যে ২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। এর বিপরীতে সরকার ঋণ নিয়েছে নন-ব্যাংকিং খাত থেকে। এ খাত থেকে গত জুলাই-আগস্টে নিয়েছে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেছে। তবে নন-ব্যাংক খাতের ঋণের সুদহার বেশি। এ খাতের সবচেয়ে বেশি ঋণ নিচ্ছে সঞ্চয়পত্র ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। এতে সুদের হার ১১ থেকে পৌনে ১২ শতাংশ। ব্যাংক থেকে ঋণের সুদহার ৫ থেকে ১০ শতাংশ। এছাড়া বৈদেশিক ঋণ শোধ করতে গিয়ে চড়া দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। এছাড়া ঋণের কিস্তি স্থগিত করার কারণে সুদও বেশি দিতে হচ্ছে। ফলে ঋণের বিপরীতে সরকারকে বাড়তি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির হার এখনো ৮ শতাংশের ওপরে রয়েছে। প্রায় তিন বছর মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ শতাংশের বেশি থেকে ১১ শতাংশের ওপরে। দীর্ঘ সময় মূল্যস্ফীতির হার বেশি থাকার কারণে পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়েছে। পাশাপাশি স্বল্প আয়ের মানুষের আয় কমায় তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়াতে হয়েছে। এতেও সরকারের খরচ বেড়েছে। সরকারের আয়ের প্রধান খাত হচ্ছে রাজস্ব আদায়। দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনৈতিক মন্দা ও সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সংস্কার কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের কারণে রাজস্ব আয় বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আয় বেড়েছে ২১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে আয় বাড়েনি, বরং কমেছিল আড়াই শতাংশের বেশি। জুলাই-আগস্টে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬১ হাজার কোটি ২৬ লাখ টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৫৪ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। ঘাটতি হয়েছে ৬ হাজার ৫৭৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি হয়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ৪৫ হাজার ৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। প্রাপ্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, সব খাতে সরকারের খরচ বেড়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে সেই হারে আয় বাড়েনি। ফলে সরকারকে বড় ধরনের ঘাটতিতে পড়তে হচ্ছে। এ ঘাটতি মোকাবিলায় সরকারকে ঋণ নিতে হচ্ছে। এদিকে সরকারের ঋণের বাজারও ছোট হয়ে আসছে। ব্যাংকে তারল্য সংকট, অর্থনৈতিক মন্দা ও চড়া মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তার আয় কমায় অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেও চাহিদা অনুযায়ী ঋণের জোগান পাচ্ছে না। প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত আগস্টের শেষে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমানত বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। যা ব্যাংক খাতে তারল্যের জোগান বাড়ানোর জন্য যথেস্ট নয়। এর মধ্যে মেয়াদি আমানতের হিসাব বাড়ার কারণেই সার্বিকভাবে আমানত বেড়েছে। মেয়াদি আমানত বাড়ার ফলে ব্যাংক খাত দীর্ঘ মেয়াদে আমানত সংকট ঘোচানোর দিকে এগোচ্ছে। তবে চলতি আমানত কম হওয়ার মানে হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কম। প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক খাতে আমানত বাড়ায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ বেড়েছে, ডলারের প্রবাহ বাড়ায় বৈদেশিক সম্পদ বেড়েছে। এ দুটি মিলে দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে। ফলে টাকার প্রবাহ বেড়েছে দশমিক ৩৩ শতাংশ।