তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বড় ধাক্কা আসতে পারে
অনলাইন নিউজ ডেক্স

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ সব রপ্তানি পণ্যে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে এ বিষয়ে সতর্ক করে সোমবার চিঠি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সময়সীমা বাড়ালেও বাণিজ্য ঘাটতি ও নীতিগত প্রতিবন্ধকতা দূর না হলে অর্থাৎ আলোচনায় সমাধান না হলে শুল্ক কার্যকর হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ট্রাম্প।যুক্তরাষ্ট্রের পলিসিরি বিপরীতে নিজেদের মতো করে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে শতাধিক পণ্যের শুল্কহার জিরো করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে প্রত্যাশিত ফল মেলেনি। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের জন্য শুল্ক হার নির্ধারণ করেছেন ৩৫ শতাংশ। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল এই শুল্ক হার ১০ থেকে ২০ শতাংশ থাকবে; কিন্তু পুরো বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ীদের অন্ধকারে রাখা হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেছেন তারা। এতে বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে। বাকি তিন মাসে তা ৯৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। প্রধান এই রপ্তানি খাতের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক-কর্মচারী। যুক্তরাষ্ট্রের এই পাল্টা শুল্কের ধাক্কায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এ কর্মসংস্থানে। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ চেয়েছেন তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমই নেতারা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত শুল্ক ঠিক হবে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কিছু দেশ তো শুল্ক কমিয়ে নিয়েছে, তাহলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যারা নেগোসিয়েশনে করেছেন বা করছেন, তাদের তুলনায় আরও অধিকতরযোগ্য কেউ ছিলেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে সিংহভাগই পোশাক খাতের পণ্য। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছিল ৭৫ হাজার ৬০৩ কোটি টাকার পণ্য। এর মধ্যে পোশাক খাতের পণ্য ছিল ৬৬ হাজার ৮০৬ কোটি টাকায়। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮১ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। ওই বছর তৈরি পোশাক পাঠানো হয়েছিল ৭১ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকার। নতুন করে শুল্কারোপের কারণে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্কহার হবে প্রায় ৫১ শতাংশ। এতে খরচ প্রায় অর্ধেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তরা। তাদের অভিযোগ, নেগোসিয়েশন সম্পর্কে তারা অনেকটা অন্ধকারেই ছিলেন। সব মিলিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ চেয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা। এ ছাড়া অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তুতি কেমন ছিল, কারা আলোচনায় ছিলেন এবং আলোচনার জন্য আরও অধিকতরযোগ্য লোক ছিলেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।এ বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ১০ থেকে ২০ শতাংশ হতে পারে। এ সংক্রান্ত কোনো আলোচনায় তৈরি পোশাক খাতের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ ছিল না। সমঝোতার বিষয়টি কাউকে সেভাবে জানানো হয়নি। এজন্য প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ চেয়েছি আমরা। আশা করি বুধবার (আজ) সাক্ষাৎ পাব। আর না পেলে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিস্তারিত উপস্থাপন করা হবে বলেও জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।জানা গেছে, দেশের পুরো রপ্তানির প্রায় সিংহভাগ আসে তৈরি পোশাক খাতের মাধ্যমে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ থেকে শুরু করে দেশের প্রধান রপ্তানি খাতই হচ্ছে তৈরি পোশাক। আর এই খাতের প্রধান বাজার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রায় ১৬ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। নতুন করে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হলে নতুন শুল্কহার দাঁড়াবে প্রায় ৫১ শতাংশ। এতে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়বে পারে তৈরি পোশাক খাত। এতে খরচের সঙ্গে বাড়বে নতুন প্রতিযোগিতা। এ ছাড়া তৈরি পোশাক খাত দেশের সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থানের জায়গা। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। এ খাতে চ্যালেঞ্জ তৈরি হলে, এ কর্মসংস্থান নিয়েও শঙ্কা তৈরি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক নিয়ে এরই মধ্যে চীন ও ভিয়েতনাম সুবিধাজনক অবস্থায় চলে গেছে। ভিয়েতনাম তাদের শুল্ক ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এ ছাড়া চীনও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ৩৫ শতাংশ নতুন শুল্ক তৈরি পোশাক খাতের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত এপ্রিলে জারি হওয়া এই পাল্টা শুল্কের নেগোসিয়েশন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি ছিল কি না, তা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সরকারের কথাবার্তায় গোছালো প্রস্তুতি আছে বলে মনে হয়নি। যাদের দিয়ে নেগোসিয়েশন করানো হচ্ছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে, তারা কি আসলে সেই যোগ্যতা রাখেন সবাই? অথবা এর চাইতে অধিকতর যোগ্য লোক কি দেশে বা বিদেশে ছিলেন না বলেও প্রশ্ন তোলেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, আলোচনা চলতে পারে, তবে বাংলাদেশকে এখন ভবিষ্যতের জন্যও প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। বাংলাদেশ নতুন ৩৫ শতাংশ সামাল দেবে এই চিন্তাও করা উচিত বাংলাদেশের। পোশাক খাতের জন্য নতুন বাজার খোঁজার পাশাপাশি বায়ারদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার পরামর্শ দেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপের এই পলিসিতে যেসব বিষয় উল্লেখ ছিল, আমরা কি সে অনুযায়ী প্রস্তাব তৈরি করেছি বা বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমরা কী করেছি, কী করতে পারব, তা উপস্থাপন করতে পেরেছি কি না সে প্রশ্ন রাখেন তিনি। এ ছাড়া ট্যারিফ নিয়ে বায়ারদের সঙ্গে কতটা প্রাইস নেগোসিয়েশন করা যায় সে চেষ্টাও সংগঠিতভাবে শুরু করা উচিত। পুরো চাপ বাংলাদেশকে নিতে হলে আমাদের ফ্যাক্টরিগুলো চলবে কীভাবে সে বিষয়েও প্রস্তুতি শুরু করা উচিত বলেও জানান এই অর্থনীতিবিদ।জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের হার কমিয়ে আনতে সরকার বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। এতে শতাধিক পণ্যের শুল্কহার জিরো করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন খাতে বেশ পরিবর্তন আনা হয়। এই শুল্কের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন খাতে নতুন করে অগ্রিম আয়কর আরোপ করা হয়। এ ছাড়া সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে তুলা থেকে শুরু করে উড়োজাহাজ পর্যন্ত কেনা হবে বলেও গতকাল সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ওয়ান টু ওয়ান আলোচনার মাধ্যমে ঘোষিত শুল্ক ঠিক হবে। বুধবার ভোরে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রতিনিধিদের বৈঠক হবে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিবও এই বৈঠক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছেন।যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক নিয়ে জানতে চাইলে পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, এরই মধ্যে কিছু দেশ নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে তাদের শুল্কহার কমিয়ে এনেছে। এক্ষেত্রে আমাদের নেগোসিয়েশন কী ধরনের ছিল, কেন আমরা পারলাম না, বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে হবে। এ ছাড়া শুধু বিজনেস এবং ট্রেড পলিসির মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসনের পাল্টা শুল্ক কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আমরা পলিটিক্যাল ইনফ্লুয়েন্স করতে পেরেছি কি না, সেটাও একটা বড় বিষয়। তবে যেহেতু আরও কিছু সময় আছে, সে হিসাবে পাল্টা শুল্কের হার কমাতে সব ধরনের নেগোসিয়েশনের বিকল্প নেই বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।তবে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক নিয়ে হতাশ ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে চীন, ভিয়েতনাম সুবিধা করে নিয়েছে। আমরা তা এখনো পারিনি। এ বিষয়ে ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক বাংলাদেশের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। এতে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঢাকা চেম্বার মনে করে, এমন সংকটে সরকারের দ্রুত ও কার্যকর কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যদিও প্রথম ঘোষণার পর বাংলাদেশ কিছু কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালায়, তবে তা ছিল খণ্ড খণ্ড ও সমন্বয়হীন। উচ্চপর্যায়ের উদ্যোগের অভাব পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুর্বলতা সৃষ্টি করেছে। এখনো সময় আছে একটি ঐক্যবদ্ধ, সুপরিকল্পিত কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে শুল্ক কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোরালোভাবে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ারও—পরামর্শ এই ব্যবসায়ী নেতার।
