দখল হয়ে যাচ্ছে দোকানপাট ঘাট ঘের জমি বালুমহাল


দখল হয়ে যাচ্ছে দোকানপাট ঘাট ঘের জমি বালুমহাল
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে খুলনা মহানগরীসহ উপজেলাগুলোতে বেড়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের দখলের দৌরাত্ম্য। দোকানপাট, খেয়াঘাট, মৎস্য ঘের, জায়গাজমি, বালুমহালসহ সর্বত্র দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এদিকে বিএনপি নেতাকর্মীদের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে গঠন করা হয়েছে মনিটরিং সেল। যেখানে প্রায় দুইশ অভিযোগ জমা পড়েছে। বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে নগর ও জেলার শতাধিক নেতাকর্মীকে শোকজ এবং ২০/২৫ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ দেখানো হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ১৯ সেপ্টেম্বর জেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত করা হলেও বহাল রয়েছে নগর বিএনপির কমিটি। খুব দ্রুতই নগর বিএনপির কমিটি সম্মেলনের মাধ্যমে পুনরায় গঠন করা হবে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। অনুসন্ধানে খুলনা মহানগরের তুলনায় জেলার ৯টি উপজেলায় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দখল ও লুটপাটের অভিযোগ বেশি পাওয়া গেছে। তবে দখলের বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’ হলেও মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যে দখলগুলো বেশি প্রচার হয়েছে তার বিরুদ্ধে দলের শীর্ষ নেতারা বহিষ্কার ও শোকজসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। অনুসন্ধানে একাধিক দখলের বিষয়ে খোঁজ নিলে অনেক ভুক্তভোগী সরাসরি বিএনপি নেতাকর্মীদের নির্দেশনায় দখলের বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। এমনকি অনেকের বিরুদ্ধে স্থানীয় নেতাসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছেও লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, মহানগরীর খানজাহান আলী থানা এলাকার শিরোমনি বিআইডব্লিউটিএ সার গুদামের ঘাট ইজারার টেন্ডার জমা দেওয়ার সময় খুলনা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে থানা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক কাজী মিজানুর রহমানের লোকজন বাধা দেন। একই এলাকায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকার ৫০ কোটি টাকার সম্পত্তি দখলের অভিযোগ রয়েছে থানার সাবেক আহ্বায়ক কাজী মিজান ও সাবেক ছাত্রদল নেতা মাসুম বিল্লাহর বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে মিজান বলেন, জেলা প্রশাসকের ঘটনা একটা নাটক ছিল। প্রশিকার সম্পত্তি দখলের বিষয়টি সত্য নয়। এর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। নগরীর ২১নং ওয়ার্ডের একটি ঘাট সাবেক এক আওয়ামী লীগ নেতার কাছ থেকে লিখে নিয়েছেন স্থানীয় বিএনপির এক নেতা। আওয়ামী লীগ নেতা চৌধুরী মিনহাজ উজ জামান সজল বলেন, আমি যে ঘাটটি ইজারা নিয়েছিলাম সেটার মূল্য পরিশোধ করে বিএনপির এক নেতা ঘাটটি নিয়েছেন। এছাড়া ওয়ার্ডটির আওয়ামী লীগ অফিসও দখল করা হয়েছে। এদিকে নগরীর রেলওয়ে মার্কেটের ভেতর ডাক্তার বাড়ি নামে খ্যাত পুরাতন একটি ভবন দখলের অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে সদর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোল্লা ফরিদ আহমেদ বলেন, কোনো দখলের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কেউ প্রমাণ দিতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেব। তবে আওয়ামী লীগ অফিসটা আগে বিএনপির অফিস ছিল। সেটা পুনরুদ্ধার হয়েছে। এদিকে খুলনার সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালের ‘জেলা বাস-মিনিবাস কার্যালয়’ দখল করে ‘খুলনা বিভাগীয় বাস-মিনিবাস মালিক সমিতি’ নামে পরিচালিত হচ্ছে। সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন বিএনপি সমর্থকরা। এ বিষয়ে রবিউল করিম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা শুধুমাত্র পুনরুদ্ধার করেছি। এছাড়া ‘রূপসা-বাগেরহাট বাস-মিনিবাস কোচ ও মাইক্রোবাস মালিক সমিতি’ কার্যালয়টি এখন চালাচ্ছেন রূপসা উপজেলা নেতারা। এছাড়া ঘাট দখলসহ ঠিকাদারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে খালিশপুর থানা বিএনপির এক নেতার বিরুদ্ধে। পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি বাজারে শতাধিক দোকানপাট ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য শাহাদাৎ হোসেন ডাবলুর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় তাকে শোকজ করা হয়েছে বলে জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মনিরুল হাসান বাপ্পী নিশ্চিত করেছেন। গত ১০ জানুয়ারি উপজেলার বোয়ালিয়া ব্রিজের কাছে হিতামপুর মৌজায় প্রায় ৫০ বিঘা ঘের দখলের অভিযোগ মিলেছে পৌরসভা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোড়লের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমার নাম কেউ ব্যবহার করতে পারে। আমি এই দখলের সঙ্গে জড়িত না। দিঘলিয়া উপজেলায় সেনহাটি মৌজার গোয়ালপাড়া এলাকায় ইসমাইল হোসেনের এক আত্মীয়দের বসতবাড়ির জমি দখল, দিঘলিয়ার নগর ফেরিঘাট নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের হুমকিসহ ভয়ভীতি দেওয়ার অভিযোগ মিলেছে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুর রহমান মিন্টু মোল্লার বিরুদ্ধে। ফেরিঘাট নিয়ে মারামারির ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। এই বিষয়ে মিন্টু মোল্লা বলেন, জমিটি আমরা কয়েকজন ৭/৮ মাস আগে কিনেছি। যারা অভিযোগ করেছে তাদের কোনো কাগজ নেই। ফেরিঘাট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তিনি বলেন, আমার নামে অযথা মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি ফেরিঘাট নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। মামলায় জামিন নিয়েছি। কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের প্রায় ১০০ বিঘা জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাঈদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। গত ১৯ জানুয়ারি তার অনুসারীরা জমিটি দখল করেন। এ বিষয়ে সাঈদ বিশ্বাস বলেন, তার ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য এমন প্রচারণা করা হয়েছে। কোনো জমি বা খাল দখল হয়নি। এদিকে কয়রা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন বাবুলকে নানাবিধ অভিযোগের ঘটনায় দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া কয়রায় বাজারে দোকান লুটপাটের ঘটনায় তার বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। বটিয়াঘাটা উপজেলার দশগেট সংলগ্ন বালুমহালটি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে আছে বিএনপি ও যুবদলের নেতাদের। এর আগে যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা শেখ সোহেলের বন্ধু বালুমহালটি পরিচালনা করতেন। তবে বালুমহালের সঙ্গে জড়িত বটিয়াঘাটা উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব বাহাদুর মুন্সী বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, তিনি এর সঙ্গে জড়িত নন। জেলা বিএনপির সাবেক কয়েকজন নেতা এটার নিয়ন্ত্রণ করেন। ফুলতলা উপজেলার সিকিরহাটের মন্দিরের ঘাটটি ৫ আগস্টের পর বন্ধ করে দেওয়ার কথা স্বীকার করেন উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ সাব্বির হোসেন রানা। তিনি বলেন, স্থানীয় সনাতন ধর্মীদের অনুরোধে ঘাটটি বন্ধ করেছিলেন। তবে সেটা এখন সচল রয়েছে। ডুমুরিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোল্লা মোশাররফ হোসেন মফিজকে গত ১ সেপ্টেম্বর দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর আগে তার গ্রামের পুরোনো বাড়ি থেকে আওয়ামী লীগ নেতার একটি গাড়ি উদ্ধারের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। তেরখাদা উপজেলায় শেখ হাসান আল মামুন নামে এক ব্যক্তিকে মারধর করে ১৩ লাখ টাকা লুট করেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। মামুন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের কাছে এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ করেন। এর প্রেক্ষিতে গত ১২ সেপ্টেম্বর তেরখাদা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বাবু মোল্লা, সদস্য ফেরদৌস মেম্বার, গাউস মোল্লা ও রবিউল ইসলাম লাকুকে শোকজ করা হয়। রূপসা উপজেলায় জেলা কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদের নেতৃত্বে একটি প্রতিষ্ঠানে কয়েক কোটি টাকা লুটের অভিযোগ দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর কাছে। দাকোপ উপজেলার চালনা পৌরসভার সাবেক নেতা শেখ শাকিল আহমেদ দিলুও যুগ্ম মহাসচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন যে, উপজেলার তিলডাঙ্গায় তার ঘের লুট করেন স্থানীয় বিএনপি নেতা মোজাফফর গং। জেলা বিএনপির এক শীর্ষ নেতা বলেন, ৫ আগস্টের পর প্রতিনিয়ত বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী যত দ্রুত সম্ভব সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগে ১ জন নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি, দুজনকে বহিষ্কার এবং অর্ধশতাধিক নেতাকে শোকজ করা হয়েছে। খুলনা মহানগর বিএনপির মনিটরিং সেলের আহ্বায়ক রেহেনা ঈসা বলেন, জায়গাজমি দখল, চাঁদাবাজি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবস্থান, বিরোধী মতের লোকদের সঙ্গে উঠাবসাসহ বিভিন্ন অভিযোগ আসে মনিটরিং সেলে। অভিযোগগুলো সার্চ কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। নগরীতে প্রায় দুইশ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে। উল্লেখ্য, মহানগরে অর্ধশতাধিক নেতাকে শোকজসহ প্রায় ২০ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।