দীর্ঘ এক বছরের টানা প্রস্তুতি শেষে ক্ষণগণনা শেষ। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’ স্লোগানে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে আজ থেকে শুরু হচ্ছে ২ দিনের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। প্রগতি ময়দানের ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার ‘ভারত মন্ডপম’-এ এবারের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন জি-২০ এর সদস্যসহ বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশের শীর্ষ নেতা। খবর জি নিউজ, হিন্দুস্থান টাইমস, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, আনন্দবাজার পত্রিকা, টাইমস অব ইনডিয়া।
জি-২০ এবারের সম্মেলন এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট প্রবল হয়ে উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ, বিভিন্ন মহামারিসহ ডিজিটাল ডিভাইসের কারণে সৃষ্ট বৈষম্যের পরিস্থিতিতে বিশ্বনেতারা কি বলেন সেদিকেই এখন তাকিয়ে আছেন সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ।
এ সম্মেলন উপলক্ষ্যে নয়াদিল্লিকে কড়া নিরাপত্তা চাদরে পুরোপুরি মুড়ে ফেলা হয়েছে। সারা বিশ্বের শীর্ষ রাষ্ট্রনেতারা এই সম্মেলনে যোগ দিতে এখন ভারতে রয়েছেন। তাই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভারত কোনো কমতি রাখেনি। শুক্রবার নয়াদিল্লিতে পৌঁছেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্য নেতারা। এ সম্মেলনের মাঝেই ১৫ দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
সম্মেলন শুরুর প্রাক্কালে নরেন্দ্র মোদি লিখেছেন, অনৈক্য উপেক্ষা করে একতা বজায় থাকবে এমন একটি পৃথিবীর লক্ষ্যে ভারত বিভেদ, বাধা দূর করে সহযোগিতার বীজ বপনে বদ্ধপরিকর। দেশের শীর্ষ দৈনিকে প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে মোদি লিখেছেন, এবারের সম্মেলনের মাধ্যমে ভারত শেষ সীমানা পর্যন্ত পৌঁছাবে আর বিশ্বের কেউই পেছনে পড়ে থাকবে না। এতে ভৌগোলিক সীমানা, ভাষা এবং মতাদর্শকে ছাড়িয়ে ভারত এবার জি-২০ সম্মেলনের মাধ্যমে মানবকেন্দ্রিক অগ্রগতির আহ্বান জানাবে বলে মোদি উল্লেখ করেন।
দিল্লির প্রগতি ময়দানের ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার ‘ভারত মন্ডপম’-এ আয়োজন করা হয়েছে এই শীর্ষ সম্মেলনের। কনভেনশন সেন্টারের সামনেই স্থাপন করা হয়েছে বিশাল এক নটরাজ মূর্তি। জি-২০ সম্মেলনে বিদেশি রাষ্ট্রনেতাদের স্বাগত জানাতে ২৮ ফুট লম্বা এ নটরাজ মূর্তি তৈরি করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, এই মূর্তিটিই বিশ্বের দীর্ঘতম নটরাজ মূর্তি। নটরাজ মূর্তি স্থাপনে কাজ করেছেন ১৮ জন কর্মী। তামিলনাড়ুর শিল্পী এস দেবসেনাথিপ্যাথির নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে ১৯ টন ওজনের মূর্তিটি। এছাড়াও অভ্যাগতদের স্বাগত জানাবে এআই নির্মিত অবতারও। ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ নামের এক প্রদর্শনী চলবে ভারত মন্ডপমে। সেখানে ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হবে। একেবারে বৈদিক আমল থেকে আধুনিক যুগ, সবটাই তুলে ধরা হবে ওই প্রদর্শনীতে। ১৬টি ভাষা ব্যবহৃত হবে প্রদর্শনীর অডিওতে। এর মধ্যে ইংরেজি ছাড়াও রয়েছে ফরাসি, ইটালিয়ান, কোরিয়ান ও জাপানি প্রভৃতি। এর পাশাপাশি শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষ্যে দিল্লির একাধিক এলাকা সুসজ্জিত করা হয়েছে।
সম্মেলন উপলক্ষ্যে কড়া নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছে রাজধানীকে। বিশ্বনেতারা যে পথ দিয়ে যাবেন, সেই অঞ্চলে সাধারণ মানুষ এবং যানবাহন চলাচলে জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। রাস্তার প্রতিটি মোড়ে মোতায়েন করা হয়েছে দিল্লি পুলিশের বিশেষ দল। তাদের সঙ্গে যৌথভাবে নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে এসপিজি কমান্ডাররা। নজরদারি চালানোর জন্য মোতায়েন করা হয়েছে ড্রোন। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনকে সামনে রেখে কড়া নিরাপত্তাবেষ্টনী দিল্লিতে চলছে যুদ্ধকালীন তৎপরতা।
দিল্লির আকাশসীমাকে সুরক্ষিত রাখতে ভারতীয় বিমানবাহিনী ফ্যালকন বিমানগুলোকে কাজে লাগাচ্ছে। শত্রুপক্ষের বিমান বা ড্রোন হামলা প্রতিহত করতে সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেমগুলোকেও দিল্লির আশপাশের এলাকায় মোতায়েন রাখা হয়েছে। প্রগতি ময়দানে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনস্থলে বসানো হয়েছে ডিআরডিও-র তৈরি ‘অপটিক্যাল টার্গেট লোকেটার’। কেউ স্নাইপার নিয়ে হামলা চালাতে গেলেও, তা ধরে ফেলবে এই যন্ত্র।
শুক্রবার থেকে সম্মেলন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে দিল্লির সব সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বন্ধ রাখা হয়েছে বাজারও। শুধু চিকিৎসাসংক্রান্ত সব পরিষেবা খোলা রাখা হয়েছে। বিদেশি অতিথিদের আনাগোনার জন্য দিল্লির একাধিক রাস্তায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা হলেও, মেট্রো পরিষেবা স্বাভাবিক রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই মেগা ইভেন্টের জন্য রাজধানী দিল্লিকে একেবারে কনের মতো সাজানো হয়েছে। বাঁদরের উপদ্রব ঠেকাতে নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা।
জি-২০ এর সদস্যসহ বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশের শীর্ষ নেতা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কর্মকর্তা, আমন্ত্রিত অতিথি দেশ এবং ১৪টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানরা জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন। জি-২০ এর সদস্য দেশের মধ্যে রয়েছে-আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, মেক্সিকো, কোরিয়া, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
এই প্রথমবারের মতো ভারত এত শক্তিশালী রাষ্ট্রনেতাদের আতিথেয়তার সুযোগ পেয়েছে। ভারতের সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠানের থিম রাখা হয়েছে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’। অর্থাৎ, গোটা বিশ্বই হলো একটি পরিবার। এবারের জি-২০ সম্মেলনে বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আরও বেশি ঋণ দেবে কিনা, সেই বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্রেডিট সিস্টেমের উন্নতি এবং ক্রিপ্টোকারেন্সির নিয়মগুলো নিয়েও আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার ওপর ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাব নিয়েও আলোচনা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা, জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ এবং ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির মতো পরিচিত রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে নয়াদিল্লিতে ২ দিনের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন আরও বেশ কয়েক জন প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী।
তবে আমন্ত্রণ পেয়েও আসছেন না কয়েকজন প্রভাবশালী রাষ্ট্রপ্রধান। অনুপস্থিতির তালিকায় প্রথমেই রয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ক্রেমলিন জানিয়েছে ‘গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বিষয়ে’ ব্যস্ততার কারণে তিনি থাকছেন না। তার প্রতিনিধি হিসাবে আছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। অন্যদিকে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও দিল্লি না এসে জি-২০তে পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াংকে। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রিজ ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রেডরও অভ্যন্তরীণ কর্মসূচির কারণে জি-২০ তে যোগ দিচ্ছেন না। তার পরিবর্তে থাকছেন অর্থমন্ত্রী রাকুয়েল স্যাঞ্চেজ। ‘পর্যবেক্ষক’ হিসাবে আমন্ত্রিত হলেও শেষ মুহূর্তে কোভিড আক্রান্ত হওয়ায় স্পেনের রাষ্ট্রপ্রধান পেড্রো স্যাঞ্চেজও দিল্লি সফর বাতিল করেছেন। তার বদলে ভাইস প্রেসিডেন্ট নাদিয়া ক্যালভিনোকে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন।
পর্যবেক্ষক দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে প্রথমেই রয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জি-২০র সদস্য না হলেও দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসাবে বাংলাদেশ ২ দিনের এই শীর্ষ সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেয়েছে। নাইজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা টিনুবুও যোগ দেবেন ‘আমন্ত্রিত’ হিসাবে। এই তালিকায় আরও রয়েছেন নেদারল্যান্ডসের মার্ক রট, মিসরের আবদেল ফাতা, মরিশাসের প্রবীন্দ জগন্নাথ, ওমানের হাইতাম বিন তারিক, সিঙ্গাপুরের লি সেইন লং, কমোরোসের অসুমনি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মহম্মদ বিন জায়েদের মতো রাষ্ট্রনেতারাও।
জি-২০ সম্মেলনের লোগো তাৎপর্য : জি-২০ সম্মেলন উপলক্ষ্যে বিশেষ লোগো প্রকাশ করেছে ভারত। এ লোগোতে সাত পাপড়ির এক পদ্মফুলের ছবি রয়েছে। পদ্ম ভারতের জাতীয় ফুল, ভারতের আধ্যাত্মিক ধারণাতেও এই ফুলটি পবিত্র বলে স্বীকৃত। জি-২০ সভাপতিত্বের লোগোতে পদ্মের চিহ্নকে তাই ভারতের সংস্কৃতি, আধ্যাত্মিকতা, সম্পদের প্রতীক বলেই জানিয়েছে ভারত। লোগো উন্মোচনের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, পদ্মের সাতটি পাপড়ি পৃথিবীর সাতটি মহাদেশ এবং সংগীতের সাতটি সুরের প্রতিনিধিত্ব করছে। একইসঙ্গে লোগোতে রয়েছে গেরুয়া, সাদা, সবুজ ও নীল রংয়ের সংমিশ্রণ। জি-২০ সম্মেলন গোটা বিশ্বকে একত্রিত করবে। সেই একতাকেই তুলে ধরছে এই লোগো। পাশাপাশি তা প্রকৃতির প্রতি দায়বোধকেও তুলে ধরছে। আর এই লোগোর নিচেই দেবনাগরী হরফে লেখা রয়েছে ‘ভারত’ এবং ইংরেজি হরফে ‘ইন্ডিয়া’।
সোনা-রুপার বাসনে অতিথিদের ভোজ : বিশ্বের অতিথিদের আপ্যায়ন করতেই এবার সোনা-রুপার বাসন সাজিয়েছে মোদি সরকার। মধ্যাহ্নভোজ ও নৈশভোজে সেই বিশেষ বাসনেই খাবার পরিবেশন করা হবে রাষ্ট্রনেতাদের। আর সেই বাসনে খোদাই করা থাকছে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নানা নিদর্শন। ভারতের ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকেই বিদেশি অতিথিদের সামনে প্লেটে সাজিয়ে পরিবেশন করার উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। জয়পুরের বিখ্যাত ধাতুর পাত্র তৈরির কারখানা আইরিস-জয়পুর এই পাত্রগুলো তৈরি করেছে। এই অনুষ্ঠানের জন্য ১৫ হাজারের বেশি রুপার পাত্র তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। রাজস্থান, কর্নাটক, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ এবং আরও কয়েকটি রাজ্যের প্রায় শ-দুয়েক কারিগরের পরিশ্রমে তৈরি হয়েছে ওই পাত্রগুলো। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খাবার, স্ট্রিট ফুড, সবই থাকছে আমন্ত্রিত অতিথিদের খাবারের তালিকায়।
১৯৯৯ সালে এশিয়ার আর্থিক সংকটে পরে বিশ্বের ২০টি প্রধান দেশ একটি অর্থনৈতিক গোষ্ঠী গঠন করে, যা জি-২০ নামে পরিচিত। এই জোট বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মোট জিডিপির ৮০ শতাংশ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশ পরিচালনা করে। এখন পর্যন্ত ১৭টি জি-২০ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর এবারের ১৮তম জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে নয়াদিল্লিতে। শীর্ষ সম্মেলনের আগে ভারতের ৬০টি শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে জি-২০র ২২০টি বৈঠক। এসব বৈঠকে প্রায় ৩০ হাজার প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন। মূল বৈঠকের পাশাপাশি অন্য অনুষ্ঠানগুলো মিলিয়ে এক লাখেরও বেশি মানুষ অংশ নিয়েছেন।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।