নাটক সিনেমায় নারীদের গুরুত্ব কতটুকু?


নাটক সিনেমায় নারীদের গুরুত্ব কতটুকু?
আজ বিশ্ব নারী দিবস। দিনটি এলেই প্রশ্ন উঠে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের অবস্থান কোথায়। কর্মক্ষেত্রে কতটা এগিয়ে আছেন? কিংবা কতটা বৈষম্যের শিকার। সব প্রশ্নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক, দুই ধরনের উত্তরই নারীদের কাছ থেকে পাওয়া যায়। তবে নেতিবাচকই বেশি। বিশেষ করে বিনোদন মিডিয়ায়।শোবিজ অঙ্গনে নারীদের উপস্থাপনই ছিল বরাবরই আলোচ্য। এ অঙ্গনে কাজের ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারীরা কতটা প্রাধান্য পাচ্ছেন, এমন প্রশ্ন হরহামেশাই শোনা যায়। আশি-নব্বই দশকে নাটক সিনেমায় নারীদের প্রাধান্য দেয়া হতো, প্রায় সময়ই গল্পে নারী সংগ্রামের চিত্র ফুটে উঠতো। তবে গল্পে তা কতটা গুরুত্ব পেত?নারী মানেই ছিল অসহায়, নিপীড়িত কোনো চরিত্র অথবা ভোগবিলাসী পণ্য। গল্পে নারীদের সন্তান ও সংসার পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। এর বাইরে কী নারীর জীবন সংগ্রাম বলতে কিছু নেই? নাকি নারী স্বামী-সন্তান ও সংসারেই সীমাবদ্ধ? এর উত্তর খুঁজতে গেলে শিল্পী-নির্মাতা অনেকেই ‘না’ সূচক জবাব দেন। তবু নারী সংগ্রামের অন্যান্য বিষয়গুলো উঠে আসেনি নাটক বা সিনেমায়!বর্তমান সময়ে তো নাটক-সিনেমায় নারী প্রধান গল্পের প্রাধান্য নেই বললেই চলে। এক সময় নারী চরিত্রের কিছুটা গুরুত্ব থাকলেও, বর্তমানে নারীকে শুধুই শো-পিস হিসাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও মনে করছেন অনেকে। এমনকি শুধুই পর্দায় নয়, নারীপ্রধান গল্পে কাজ করতে নির্মাতারাও পাচ্ছেন না তেমন সুযোগ। আবার নাটক সিনেমা তৈরির ক্ষেত্রে নারী নির্মাতারাও পাচ্ছেন না সহযোগিতা! নাটক সিনেমায় পুরুষ নির্মাতাদের পাশাপাশি নারী নির্মাতারাও নিজেদের মেলে ধরেছেন। তাদের নাটক সিনেমার বিষয়বস্তু বেশিরিভাগ নারীকেন্দ্রিক। তারা চেষ্টা করেন পর্দায় নারীর সংগ্রাম ফুটিয়ে তোলার। কিন্তু তারা কি স্বাধীনভাবে কাজটি করতে পারছেন, নির্মাণের ক্ষেত্রে তারা কতটা সহযোগিতা পাচ্ছেন?বাংলাদেশের প্রথম নারী পরিচালক মনজন আরা বেগম রেবেকা। ১৯৭০ সালে তিনি পরিচালনা করেন ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’ নামে একটি সিনেমা। ২০০৬ সালে তিনি মারা যান। এরপর তার পথ ধরে নির্মাণে আসেন অনেক নারী। তাদের মধ্যে শুধু পরিচালনা নিয়েই কাজ করছেন নারগিস আক্তার, চয়নিকা চৌধুরী, সামিয়া জামান, নুজহাত আলভী আহমেদ, শবনম ফেরদৌসী, শামীম আকতার, ফৌজিয়া খান, শাহনেওয়াজ কাকলী, মতিয়া বানু শুকু, রুবাইয়াত হোসেন, ইরানী বিশ্বাস, প্রীতি দত্ত, শ্রাবণী ফেরদৌস, রওশন আরা নিপা, জেসমিন আক্তার নদী, মারিয়া তুষার প্রমুখ। এছাড়াও অভিনয়ের পাশপাশি নির্মাণে এসেছেন এমন নারীদের মধ্যে রয়েছেন রোজী আফসারী, কবরী, সুজাতা, সুচন্দা, রোজিনা, নিমা রহমান, মৌসুমী, হৃদি হক, তানিয়া আহমেদ প্রমুখ। বর্তমান সময়ে নাটক সিনেমায় নারীর গুরুত্ব কতটুকু এসব বিষয়ে জানতে কয়েকজন নারী নির্মাতা ও শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে।পরিচালক নারগিস আক্তার বলেন, ‘প্রযোজকরা সাধারণত নারী নির্মাতাকে দিয়ে সিনেমা নির্মাণ করতে চান না। তারা ধরেই নেন নারীরা দুর্বল, কম মেধাবী, ধীরগতিতে কাজ করেন। তাই নারীদের কোণঠাসা করে রাখা হয়। ফলে নারীরা নির্মাণে আগ্রহ হারাচ্ছেন। তাছাড়া সিনেমা পরিচালনায় এসে আমি যতটা বৈষম্য দেখেছি, সেটা আমার আড়ালে। আমার সামনে কেউ এসে ভয়েস রেইজ করতে পারেনি। আমি বলব, আমার আশপাশের পুরুষ সহকর্মীরা, তারা খুবই পজিটিভ ছিল।’দেশের আরেক নাট্যনির্মাতা ইরানী বিশ্বাস বলেন, ‘আমি মনে করি আমরা প্রাধান্য পাই না। কারণ, আমি মেনে নিই। আমরা যদি মেনে না নিই তাহলে তারা আমাদের মূল্যায়ন করতে বাধ্য। নারীকেন্দ্রিক গল্পের ক্ষেত্রেও তাই সব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই আমাদের নিজেদের গল্পগুলো বলতে হবে। সবাই সহযোগিতা করবে না এটাই স্বাভাবিক।’নাটক-সিনেমায় অভিনয়ে নিজেদের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন অনেক অভিনেত্রী। নারী হিসাবে তাদের অবস্থান বেশ শক্ত হলেও কর্মক্ষেত্রে এখনও বৈষম্যের শিকার বলে মনে করেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন, শবনম ইয়াসমিন বুবলী ও বিদ্যা সিনহা মিম। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তার দর্শকদের ভালোবাসা কুড়িয়েছেন দু’হাত ভরে। অভিনয়ের পাশাপাশি নারীদের নিয়ে বিভিন্ন কর্মকান্ডেও তারা এগিয়ে। নাটক-সিনেমায় নারীদের গুরুত্ব কতটুকু এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন এ তিন নারী।বিদ্যা সিনহা মিম বলেন, ‘বাংলাদেশের সিনেমা বলেন, টিভি নাটক বলেন আর ওয়েব সিরিজই বলেন-এখানে নারীকেন্দ্রিক গল্প খুবই কম হয়। এটা আসলে কেন হয় আমি ঠিক বুঝতে পারিনা। আমাদের আশেপাশের দেশগুলোতে নারীকেন্দ্রিক গল্পের কাজ হতে দেখি। সেগুলো দর্শকরাও উপভোগ করেন। কিন্তু আমাদের দেশেই এটা খুবই সীমিত। হয়তো বাণিজ্যিক কারণে ঝুঁকি আছে, কিংবা দর্শকরা নেবে না এমন গল্প, এটা মনে করেন নির্মাতারা। কিন্তু বিষয়টি আমি যৌক্তিক বলে মনে করি না। এদেশে নারীকেন্দ্রিক গল্পের নাটক সিনেমার সাফল্যও আছে অনেক।’শবনম ইয়াসমিন বুবলী বলেন, ‘নারীপ্রধান গল্পে হাতেগোনা কিছু সিনেমা হয়েছে। তবে নারীদের নিয়ে কাজ করতে এখনো অনেকে (প্রযোজক-পরিচালক) সাহস করেনা। জানি না এটা কেন। তবে নারীদের সংগ্রামের গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মাণের অনেক জায়গা রয়েছে, এসব বিষয় নিয়ে কেউ ভাবছে না। সবাই এটাকে রিস্ক মনে করে। এর থেকে বের হয়ে আসা উচিত আমাদের। তবে আমি বিশ্বাস করি. একদিন নারী পুরুষের সমতা আসবে। পুরুষদের সহযোগিতাও এক্ষেত্রে প্রয়োজন।’আজমেরী হক বাঁধন বলেন, ‘সমাজে নারীরা সবক্ষেত্রে বঞ্চিত। শুধু মিডিয়া কেন নারীরা পরিবারে হয়রানির শিকার হচ্ছেন, কর্মক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সর্বক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। শোবিজে এখনো নারী প্রতিভা মেলে ধরার সেভাবে কোনো সুযোগ দেয়া হয় না বা থাকে না। নারী চরিত্রগুলোকে গল্পেই হত্যা করা হয়। চরিত্রের যদি ব্যাপ্তি না থাকে বা চরিত্রের যদি কাজ না থাকে তাহলে সে তার প্রতিভা কীভাবে দেখাবে। প্রযোজক-পরিচালকরা এগিয়ে আসলে আমাদের দেশে নারীপ্রধান গল্পের ভালো ভালো কাজ করা সম্ভব।’