নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিন ঘোষণার সময় এসেছে


নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিন ঘোষণার সময় এসেছে
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ইতোমধ্যে ৯ মাস পার হয়ে গেছে। তাই এখন নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণার সময় এসেছে। তবে নির্বাচিত সরকার এলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন নয়।মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডির নিজস্ব কার্যালয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলা হয়। সংস্থাটির মতে- দুষ্টচক্রে বন্দি দেশের রাজস্ব আয়। চলতি অর্থবছর শেষে রাজস্ব আয়ে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন-সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও আগামী বাজেট (২০২৫-২৬) নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সিপিডির মতে, আগামী অর্থবছরে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বিনিয়োগ বাড়ানো। এ সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে জোর দিয়েছেন তারা।ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগামী অর্থবছরে দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগ বাড়ানো। তবে এটি সহজ নয়। কেউ কেউ মনে করেন, শুধু সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন না হওয়ায় বিনিয়োগে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এমন ধারণা ঠিক নয়। জ্বালানি সংকট, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে না পারা এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে না পারাও বড় কারণ।তিনি বলেন, দীর্ঘদিন থেকে বিনিয়োগে চাঞ্চল্য আনা যাচ্ছে না। নানা অনিশ্চয়তা কাজ করছে। ইতোমধ্যে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বড় একটা সম্মেলন করেছে। সেটি যৌক্তিক। কারণ আমাদের অবস্থান জানান দিতে হবে। এরপর অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। গ্যাসের সরবরাহ, মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ এবং ওয়ানস্টপ সার্ভিসের অনেকগুলোই দেওয়া সম্ভব হয়নি। এটাই বিনিয়োগে মূল চ্যালেঞ্জ।তার মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের জীবনমানে অবনমন হয়েছে। অর্থাৎ দেশের মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাপক চাপের মধ্যে আছে। সরকারের কিছু উদ্যোগ মূল্যস্ফীতি খানিকটা কমেছে। তবে এখনো তা সহনীয় পর্যায়ে আসেনি। এই মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হচ্ছে দেশে শোভন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। সেটা করতে হলে বিনিয়োগে চাঞ্চল্য আনতে হবে।ড. মোস্তাফিজ বলেন, নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন কথা আসছে। সরকার ঘোষণা করছে নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে। অর্থাৎ নির্বাচন ৯ মাস পর, না হয় ১৪ মাস পর। এখানে খুব বেশি সমস্যা দেখি না। আবার নির্বাচিত সরকার এলেই সব সমস্যার সমাধান হবে এমনটাও নয়।ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকার ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলছে। এক্ষেত্রে যে বড় অনিশ্চয়তা আছে তাও নয়। তারপরও সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঠিক করা যেতে পারে। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু সংস্কার কার্যক্রমে হাত দিলেও সমন্বিতভাবে তা পরিচালিত হচ্ছে না। এমনকি সংস্কার কার্যক্রমেও বাধা আসছে।ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, ২০২৩ সাল থেকে দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে একটু কমেছে। বিশেষ করে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেশি। এই খাদ্যপণ্যই সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর চালক হিসাবে কাজ করেছে।তবে তার মতে-বন্যা, বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতাসহ নানা কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়েছে।তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কয়েক মাস থেকে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে ১০ শতাংশ, তারপরেও কাঠামোগত দুর্বলতায় পুরোপুরিভাবে মুদ্রানীতি কাজ করতে পারেনি।সিপিডি জানায়, লোডশেডিং বৃদ্ধি, গ্যাসের সংকট ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি দেশের অর্থনীতি ও জনজীবনকে প্রভাবিত করছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে সরকার অনেক পিছিয়ে আছে। অর্থবছর অর্থাৎ ৩০ জুনের মধ্যে ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। এটা প্রায় অসম্ভব। তাই সিপিডি মনে করছে, রাজস্ব আয়ে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে।প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। এছাড়া জুলাই-জানুয়ারি পর্যন্ত সামগ্রিক রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। সংস্থাটির মতে, রাজস্ব আয় দুষ্টচক্রে আটকে আছে।মিডিয়া ব্রিফিংয়ে উত্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত কয়েক মাসে সরকার বেশ কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো-জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ভেঙে দুটি বিভাগ করা। এগুলো হলো-রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা। এর লক্ষ্য হচ্ছে-রাজস্ব আয় এবং দক্ষতা বাড়ানো। পাশাপাশি পুঁজিবাজারের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করতে পদক্ষেপ নিয়েছে।এছাড়া সুশাসনে ফেরাতে ব্যাংক খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা কাটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এসব উদ্যোগ এখন পর্যন্ত খুব বেশি সফলতা অর্জন করতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ এনবিআর সংস্কার উদ্যোগে কর প্রশাসনের ভেতরেই প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। এখানে অস্থায়ী অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সমস্যা সমাধানে আরও আলোচনা দরকার। পুঁজিবাজারে সুশাসনের ঘাটতি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার জটিলতা এখনো বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ন করছে। বাধাগ্রস্ত করছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে। সরকারের উচিত খণ্ড খণ্ড পদক্ষেপ থেকে বেরিয়ে এসে একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের প্রতি স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া। আর আগামী অর্থবছরে কয়েকটি খাতে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।এর মধ্যে রয়েছে- প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিশালীকরণ, সুশাসনের কাঠামো উন্নয়ন এবং নীতিমালা বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। সিপিডি মনে করে দৃশ্যমান ও সাহসী সংস্কারের মাধ্যমেই দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা অর্জন হবে। বাড়বে বিনিয়োগ।আগামী বছরগুলোতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হবে।