পপি সিড খাবার নাকি মাদক?


পপি সিড খাবার নাকি মাদক?

গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বন্দরে জব্দ করা হয়েছে ২৪ হাজার ৯৬০ কেজি পপি সিড বা পপি বীজ। আমদানি-নিষিদ্ধ এই পণ্যটি আটক করে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই বিপুল পরিমাণ পপি বীজের বাজারমূল্য সাড়ে ৬ কোটি টাকার বেশি।

গত ৯ অক্টোবর পাকিস্তান থেকে পাখি খাদ্য আমদানির ঘোষণা দিয়ে দুটি কন্টেইনারে নিয়ে আসা হয় এই পপি বীজ, যা দেশের আইনে ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত মাদক হিসেবে বিবেচিত বলে চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে।

বাংলাদেশে বিদ্যমান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ অনুযায়ী পপি বীজ (সিড) যদি অঙ্কুরোদগম উপযোগী হয়, তাহলে তা ‘ক’ শ্রেণির মাদক হিসেবে গণ্য হবে। আমদানি নীতি আদেশ ২০২১-২৪ এর অনুচ্ছেদ ৩(১) (খ)- অনুসারে ‘ক’ শ্রেণির মাদকদ্রব্য হিসেবে দেশে পপি বীজের আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় পপি বীজের অবস্থান ১৫ নাম্বারে।

পাখি খাদ্য আমদানির মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানি-নিষিদ্ধ পপি বীজ নিয়ে আসায় কাস্টমস আইন-২০২৩ অনুসারে চালানটি আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস কর্তৃপক্ষ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে পপি সিড বা পপি বীজ আসলে কী, এটি কী সাধারণ কোনো খাবার নাকি মাদক দ্রব্য? কেনই-বা বিভিন্ন দেশে এটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে? চলুন এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর খুঁজে দেখা যাক।

পপি বীজ (সিড) কী, এবং এর উৎস কোথায়?
পপি বীজ হচ্ছে এক প্রকার তৈলবীজ যা পপি গাছ ‘পাপাভার সোমনিফেরিয়াম’ থেকে পাওয়া যায়। এই গাছটি আফিম পপি নামেও পরিচিত। ছোট, কিডনি-আকৃতির এই বীজগুলোর গায়ে ছোট ছোট গর্ত থাকে। পপি গাছের ফুল ঝরে যাওয়ার পর যে ফল বা ক্যাপসুল তৈরি হয়, তার অভ্যন্তরে থাকা ক্ষুদ্র, রেনুর মতো বীজই হলো পপি বীজ।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে রান্নাঘরে সাধারণ মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয় এই পপি সিড, যা পোস্তদানা নামে সুপরিচিত। সবজি রান্নায় পোস্তদানার বিশেষ কদর রয়েছে এবং বাজারে এর দাম অন্যান্য মসলার তুলনায় অনেক বেশি।

যেমনটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পোস্তদানা আসে মূলত আফিম পপি গাছ থেকে। এটি এমন একটি উদ্ভিদ যা মানবজাতির ইতিহাসে এবং অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। খাবার হিসেবে যেমন এর উপযোগীতা আছে, তেমনি আছে জীবন রক্ষাকারী ঔষধ (মরফিন) হিসেবেও। তবে এর পাশাপাশি জীবন ধ্বংসকারী মারাত্মক মাদক আফিম তৈরিতেও ব্যবহৃত হয় পপি বীজ। একে ঘিরে বিতর্কের শুরু মূলত এখান থেকেই।

Poppy_seeds 222
খাবারের পাশাপাশি মাদক হিসেবেও ব্যবহার করা হয় পপি সিড (পোস্তদানা)। ফাইল ছবি।
বিশ্বজুড়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই বীজটির ব্যবহার নিয়ে নিয়মিত সতর্কবার্তা জারি করে আসছেন। তাই জনমানসে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, পপি বীজ বা পোস্তদানা আসলে কতটা নিরাপদ, এটি কী শুধুই একটি খাবার নাকি মাদকের অন্ধকার জগতের প্রবেশপথ।

এই আলোচনায় যাওয়ার আগে চলুন পপি বীজ বা পোস্তদানার বিভিন্ন ব্যবহার সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

খাবার: তরকারিতে স্বাদ বাড়াতে এবং গ্রেভি বা ঘনত্ব ও সুগন্ধের জন্যে প্রচলিত মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে পোস্তদানা। পাশাপাশি বেকিংয়েও ব্যবহার করা হয় এটি। বিশেষ করে রুটি, কেক, মাফিন, পেস্ট্রির মতো খাবার তৈরিতে পোস্তদানা ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।

তেল: রান্নাসহ বিভিন্ন শিল্পে তেল হিসেবেও পপি বীজ ব্যবহার করা হয়।

ঔষধ: অনিদ্রা ও হজমের মতো সমস্যায় ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবেও ব্যবহৃত হয় পপি বীজ।

মাদক হিসেবে পপি সিডের ব্যবহার
ভয়ানক মাদক আফিম মূলত তৈরি হয় আফিম পপি গাছ থেকে। এই গাছের কাঁচা কষ (আলকালয়েডস) থেকে সংগ্রহ করা হয়ে আফিম তৈরির নির্যাস। দুধের মতো সাদা হয়ে থাকে এই কষ। উল্লেখ্য, আফিম তৈরিতে পপি সিড (বীজ) বা পোস্তদানার সরাসরি কোনো অবদান নেই। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বিশ্বের অনেক দেশেই পপি সিড আমদানি-নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকাভুক্ত?

এই প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে আরেকটি প্রশ্নের উত্তর- পপি সিড কী খাবার নাকি মাদক? এক কথায় উত্তর হচ্ছে, পপি সিড (পোস্তদানা) খাবার ও মাদক দুটোই। খাবার হিসেবে এর ব্যবহারের কথাতো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এবারে চলুন আফিম তৈরিতে পপি সিড ভূমিকা বা অবদান সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

আফিম তৈরিতে পপি সিডের ভূমিকা
পপি গাছ থেকে বীজ সংগ্রহের সময় বীজের গায়ে অনেক সময়ই লেগে থাকে আফিমের মাদকীয় কষ (আফিম ল্যাটেক্স)। এই বীজ বা পোস্তদানাকে মাদক হিসেবে ব্যবহার করার প্রধান উপায় হচ্ছে ‘পোস্তদানার চা’ তৈরি করা। কীভাবে তৈরি করা যায় এই চা?

পোস্তদানার চা
প্রথমেই প্রচুর পরিমাণে (কয়েকশো গ্রাম থেকে শুরু করে এক কিলোগ্রামেরও বেশি) পপি সিড (পোস্তদানা) সংগ্রহ করা হয় আধোয়া (আনওয়াশড্‌) অবস্থায়। এবারে বীজগুলোকে একটি পাত্রে রেখে ঠান্ডা বা হালকা গরম পানিতে (অনেক সময় মরফিন নিষ্কাশনের জন্য লেবুর রসের মতো সাইট্রিক অ্যাসিড যুক্ত করে) ভিজিয়ে রাখা হয়।

পাত্রটিকে প্রায় ৩০ মিনিট ধরে দ্রুততার সাথে ঝাঁকানো বা ঘোরানো হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বীজের খোসার উপরে লেগে থাকা আফিমীয় কষের (আফিম ল্যাটেক্স) মধ্যে থাকা মরফিন, কোডিন ও অন্যান্য অ্যালকালয়েডগুলো দ্রুত পানির সাথে মিশে যায়। এবারে ছেঁকে নেওয়া হয় পানি। ছেকে নেওয়া এই পানি-ই হচ্ছে মারাত্মক মাদক আফিমের নির্যাসযুক্ত ‘পোস্তদানার চা’।

উল্লেখ্য, আধোয়া অবস্থায় পপি সিডে (বীজে) মরফিন, কোডিনের মতো মাদকীয় উপাদানের ঘনত্ব অনেক বেশি মাত্রায় থাকতে পারে। আবহাওয়া ও বীজ তোলার পদ্ধতিভেদে পপি বীজে মাদকের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, ফলে এর সঠিক ডোজ অনুমান করা বেশ কষ্টসাধ্য বিষয়। এতে করে ব্যবহারকারী নিজের অজান্তেই মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে ব্যবহার করে ফেলতে পারেন এটি, যা প্রাণঘাতীও হতে পারে। এ কারণে আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই আধোয়া (আনওয়াশড্‌) পোস্তদানার বাণিজ্যিক বিক্রি ও আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত বা নিষিদ্ধ।

পপি বীজ থেকে তৈরি হতে পারে পপি গাছ
মাদক তৈরিতে পপি সিডের আরও একটি পরোক্ষ ভূমিকা থাকতে পারে। এটা সত্য যে, মূলত পপি গাছ থেকেই আফিম নামক ভয়ানক মাদকদ্রব্যটি তৈরি হয়; যেখানে পপি বীজের কোনো অংশগ্রহণ নেই। কিন্তু পপি বীজ থেকে তৈরি হতে পারে পপি গাছ, যেটা প্রকারান্তরে হয়ে উঠতে পারে আফিমের উৎস!

এই কারণেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই অঙ্কুরোদগম উপযোগী পপি সিডের আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ, অঙ্কুর বেরিয়েছে এমন পপি বীজ, যেগুলো থেকে পপি গাছ উৎপন্ন হতে পারে- সেগুলো আমদানি-নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় আছে বহু দেশেই।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, পপি বীজের গড় অঙ্কুরোদগমের হার প্রায় ৫২ শতাংশ, যদিও পরিবেশগত বিভিন্ন কারণে এই হার শতকরা ৩০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। আধোয়া বা অপ্রক্রিয়াজাত পপি বীজে সাধারণত উচ্চ মাত্রার উপক্ষার (আলকালয়েডস) থাকে, ফলে এগুলো থেকে চারা জন্মানোর হার অনেক বেশি। অনুকূল পরিবেশে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে অঙ্কুরোদগমের হার।

পপি সিডের বৈধ ব্যবহার নিশ্চিত করার উপায়
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, খাবার ও মাদক (আফিম) দুই উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হয় পপি সিড। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পপি সিড বা পোস্তদানার নিরাপদ ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত করা যায়। মূলত প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির ওপরই নির্ভর করে এর নিরাপদ ব্যবহার। এক্ষেত্রে দুই ধরণের পপি সিড বা বীজ পাওয়া যায়:

প্রক্রিয়াজাত বা ধোয়া বীজ: প্রক্রিয়াজাত পপি সিড হচ্ছে সেই বীজ যেগুলোকে গাছ থেকে সংগ্রহের পর ভালোভাবে ধোয়া হয়েছে, যাতে করে বীজের উপরিভাগে লেগে থাকা আফিমের উপক্ষারের (আফিম অ্যালকালয়েডস) পরিমাণ কমে আসে। এর ফলে সাদা রঙের মাদকীয় কষের ঘনত্ব আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত নিরাপদ সীমার নিচে চলে আসে।

ধোয়া (ওয়াশিং) ও তাপীয় প্রক্রিয়া (থার্মাল প্রসেসিং)- এই দুটি উপায়ে পপি বীজ প্রক্রিয়াজাত করা যায়। এভাবে প্রক্রিয়াকরণের ফলে বীজের গায়ে লেগে থাকা উপক্ষারের পরিমাণ কমে আসে, ফলে এগুলো থেকে মাদক তৈরির সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাত বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বহুলাংশে হ্রাস পায়, ফলে এগুলো থেকে আফিস গাছের নতুন চারা জন্মানোর ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।

আধোয়া বা অপ্রক্রিয়াজাত বীজ: ধোয়া (ওয়াশিং) বা তাপীয় প্রক্রিয়ার মতো প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যায়নি এমন বীজই হচ্ছে অপ্রক্রিয়াজাত পপি সিড। এই ধরণের বীজ থেকে সহজেই তৈরি হতে পারে আফিমের মতো মাদক।

অপ্রক্রিয়াজাত বীজের অঙ্কুরোদগমের হার বেশি হয়ে থাকে। কেননা তাদের প্রাকৃতিক আবরণ অক্ষত থাকে এবং প্রক্রিয়াকরণের ফলে হওয়া ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় না এই বীজগুলোকে। ফলে বীজগুলোতে উচ্চ মাত্রার উপক্ষার (আফিম অ্যালকালয়েডস) থাকতে পারে এবং এগুলো থেকে চারা জন্মানোর হার-ও অনেক বেশি হতে পারে।

আফিম পপি চাষের নিয়ন্ত্রণ
নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য আফিম যেহেতু পপি গাছ থেকে তৈরি হয়, তাই আন্তর্জাতিক মাদক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি অনুসারে আফিম পপি চাষ কেবলমাত্র কঠোর সরকারি তত্ত্বাবধানে লাইসেন্সিংয়ের অধীনে করা হয়ে থাকে। ভারতসহ কয়েকটি দেশ কেবলমাত্র ওষুধ শিল্পে মরফিন উৎপাদনের জন্য পপি চাষের অনুমতি দেয়, কিন্তু সেটাও কঠোর নজরদারিতে থাকে যাতে করে অবৈধ মাদক তৈরির জন্য এর কোনো অংশ পাচার না হয়।

সার্বিকভাবে বলতে গেলে, পপি সিড বা পপি বীজ (পোস্তদানা) খাবারে মশলা কিংবা তেল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, এ নিয়ে কোনো বিধিনিষেধ নেই। পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাত এবং অঙ্কুরোদগম উপযোগী নয় এমন পপি সিডের আমদানিও বৈধ বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে।

কিন্তু অপ্রক্রিয়াজাত পপি সিড আমদানিতে আরোপ করা হয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ-ই একে আমদানি নিষিদ্ধ মাদক হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।

তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, সেন্ট্রাল ব্যুরো অব নারকোটিক্স (ভারত), সিএসপিআই, ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইউএস), মায়োক্লিনিক, ইউএস ফেডারেল রেজিস্টার, উএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন