‘পবিত্র’ কাফনের রক্ত-রহস্য


‘পবিত্র’ কাফনের রক্ত-রহস্য
বিশ্বের ধর্মীয় বস্তুগত নিদর্শনগুলোর অন্যতম ধরা হয় ইতালির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর তুরিনের এক গির্জায় রক্ষিত এমন এক লিলেন কাপড়ের টুকরোকে, যা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস, এটি যেনতেন কাপড় নয়; বরং স্বয়ং যিশুখ্রিষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যার পর এ কাপড় দিয়েই তাঁর মরদেহ ঢেকে রাখা হয়েছিল। সময়ের পরিবর্তনে হলদেটে রং ধারণ করা কাপড়টিতে একজন নগ্ন মানুষের সামনে এবং পেছনের অস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। যেহেতু প্রতিচ্ছবিটি যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর পর তাঁর ঐতিহাসিক চিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তাই কাপড়টি শতাব্দী ধরে বিশেষ করে ক্যাথলিক চার্চের সদস্যদের দ্বারা, যিশুর কাফন হিসেবেই সম্মানিত হয়ে আসছে। বিশেষ এই কাপড়টি নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কম বিতর্ক হয়নি। কারণ, কাপড়টির মধ্যে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের চিহ্নও রয়েছে। ১৯৮০-এর দশকে রেডিওকার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে গবেষকরা নিশ্চিত হন, কাপড়টি মধ্যযুগীয়। তবে সেটি দিয়ে আসলেই যিশুর মরদেহ ঢেকে রাখা হয়েছিল কিনা, তা নিশ্চিত নয়। এর মধ্যে থাকা রক্তের দাগও অন্য কিছুর হতে পারে। সম্প্রতি বাইবেল বিশেষজ্ঞ ড. জেরেমি জনস্টন অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম টাকার কার্লসন নেটওয়ার্কে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘শ্রাউড অব তুরিন’ নামে পরিচিত ওই লিলেন কাপড়ে লেগে থাকা রক্তের দাগ ১৯৯০-এর দশকে পরীক্ষা করা হয়। সেখানে জানা যায়, লেগে থাকা রক্তের গ্রুপ ‘এবি’ ধরনের, যা সেমিটিক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই ধরনের রক্ত জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশের মধ্যে বিদ্যমান। এ ছাড়া এ রক্ত একজন পুরুষের বলেও প্রমাণ মিলেছে। এখানে ওই ব্যক্তির মৃত্যুর আগের এবং পরের উভয় সময়ের রক্ত ছিল। ড. জনস্টন আরও বলেন, কাফনে মৃত্যুর আগের এবং পরের উভয় সময়ের রক্তের উপস্থিতি অস্বাভাবিক, যা প্রাকৃতিক পচনের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ প্রক্রিয়া নির্দেশ করে। তাঁর দাবি, লিলেন কাপড়টিতে যে ব্যক্তির শরীরের প্রতিচ্ছবি রয়েছে, তাতে অন্তত ৭০০টি আঘাতের চিহ্ন দৃশ্যমান। ওই ব্যক্তি সম্ভবত খুব খারাপভাবে আহত মানুষ ছিলেন, যার শরীরে প্রচুর পরিমাণে ‘এবি’ গ্রুপের রক্ত ছিল। আঘাতগুলো যিশুর রোমান ক্রুশবিদ্ধকরণ সম্পর্কে যা জানা যায়, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। জানা গেছে, রক্তের ‘এবি’ ধরনটি প্রথম ১৯৮২ সালে ইতালীয় জীবনীকার ড. পিয়েরলুইগি বাইমা বলোন ও তাঁর সহকর্মীরা নথিভুক্ত করেছিলেন। তারাই কাফনে লেগে থাকা রক্তের নমুনা বিশ্লেষণ করেছিলেন। পরবর্তী পরীক্ষায় কাপড়টিতে থাকা প্রতিচ্ছবির পায়ের অংশ থেকেও রক্তের এম, এন এবং এস অ্যান্টিজেন শনাক্ত করা হয়েছিল। যার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়, এই রক্ত নিঃসন্দেহে মানুষের। ড. পিয়েরলুইগি ও তাঁর সহকর্মীরা রক্তের দাগ ও অ্যান্টিজেন পরীক্ষার জন্য শক্তিশালী ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করেছিলেন। তবে তুরিনের সেই কাপড়টি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন খ্যাতনামা ইমিউনোলজিস্ট ড. কেলি কিয়ার্স। তিনি সেখানে রক্তের ‘এবি’ ধরনের উপাদান পাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ড. কিয়ার্স যুক্তি দেন, রক্তের সেই দাগ পরীক্ষায় যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, তা নির্ভুল নাও হতে পারে। কারণ, ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ বা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রক্তের অবক্ষয়ের মতো দূষণের কারণে তা ভুল ফল দিতে পারে। এর আগে ‘শ্রাউড অব তুরিন’-এ থাকা শরীরের প্রতিচ্ছবি যিশুর কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক ওঠে। নৃতত্ত্ববিদ ডেভিড অ্যাকিনসন বলেন, শ্রাউড অব তুরিনে প্রতিচ্ছবিটি কার, এর উত্তর পেতে ফিরে যেতে হবে মধ্যযুগীয় ব্রিটেনে। সঙ্গে আসবে হোলি গ্রেইল বা যিশুর পবিত্র পানপাত্রের প্রসঙ্গও। এই ঐতিহাসিক সামগ্রীটি রক্ষার দায়িত্ব ছিল ইউরোপের গোপন সংগঠন ‘দ্য নাইট টেম্পলার’-এর। নির্যাতনের শিকার হয়ে নাইট টেম্পলাররা ফ্রান্স থেকে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন ব্রিটেনের বার্টন-অন-ট্রেন্ট শহরে। সেই সময় দ্য নাইট টেম্পলারের নেতৃত্বে ছিলেন রাজা ফিশার। তুরিনের লিলেন কাপড়টি মূলত তাঁর মূর্তিকে মুড়িয়ে রাখতেই ব্যবহৃত হয়েছিল সম্ভবত। কারণ, কাপড়টি বিশ্লেষণে ‘অ্যালাবাস্টার’ নামে এক ধরনের বিশেষ জিপসামের উপস্থিতি পাওয়া যায়। মূলত এই বিশেষ পাথর ব্যবহার করেই মূর্তি তৈরি করতেন বার্টন শহরের মধ্যযুগীয় ভাস্কররা। কারণ, বার্টনে আলাবাস্টারের খনি ছিল। পৃথিবীর অন্যত্র মূর্তি তৈরিতে এই বিশেষ পাথরের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় না বললেই চলে। খবর মেইল অনলাইনের।