প্রতি বস্তায় বেড়েছে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা, মিলারদের কারসাজিতে চালের দামে উল্লম্ফন


সরকারের গুদামে চালের মজুত পর্যাপ্ত। পাশাপাশি মিল থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে কোনো সংকট নেই। এরপরও বাজারে হুহু করে বাড়ছে দাম। এক মাসের ব্যবধানে মিল পর্যায়ে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজারে। চাল ছাড়া অন্য সব নিত্যপণ্যের দামও ঊর্ধ্বগতি। সবমিলিয়ে কপালে ভাঁজ পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের। আর ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে চলছে হা-হুতাশ। তাদের আক্ষেপ- ভোক্তাদের এ কষ্ট দেখার যেন কেউ নেই। এদিকে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ- মিলারদের কারসাজির কারণেই মূলত চালের দামে উল্লম্ফন হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে রহস্যজনক কারণে ‘নীরব দর্শকের ভূমিকা’য় কর্তৃপক্ষ। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, খুচরা বাজারে মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম ২.০৪ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি মাঝারি আকারের চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ২.৮৬ শতাংশ আর কেজিপ্রতি সরু চালের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে ২.২৭ শতাংশ। রোববার খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকারি গুদামে মোট ১৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৫২ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। এর মধ্যে ধান ৪৬৯ ও ১৪ লাখ ৬ হাজার ৮৩৮ টন; যা একটি আদর্শ মজুত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নওগাঁ ও দিনাজপুর মিল পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিলপর্যায়ে প্রতি বস্তা মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ টাকা, যা এক মাস আগে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি প্রতি বস্তা মাঝারি আকারের বিআর-২৮ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ টাকা, যা এক মাস আগে ২ হাজার ২০০ টাকা ছিল। আর প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার টাকা, যা আগে ২ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মিলাররা সব সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। চাল কাটার মৌসুম এলেই মিলাররা চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ায়। এবারও সেটাই হয়েছে। তাই মূল্য নিয়ন্ত্রণে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে বাজারে চাল কিনতে ক্রেতার ভোগান্তি বাড়বে। রাজধানীর কাওরান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক ও পাইকারি চাল ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই মিল পর্যায়ে সব ধরনের চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। যে কারণে বেশি দাম দিয়ে এনে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তিনি জানান, বাড়তি দামে কিনতে হওয়ায় প্রতি বস্তা মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল ২৩৫০-২৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ২২০০ টাকা ছিল। বিআর-২৮ জাতের চালের বস্তা ২৫৫০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে, যা আগে ২৩০০ টাকা ছিল। আর মিনিকেট চালের বস্তা ৩১০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে, যা আগে ৩ হাজার টাকা ছিল। তিনি জানান, কয়েকদিন ধরে মিল পর্যায় থেকে চালের সরবরাহ করা হচ্ছে না। যে পরিমাণ চাল অর্ডার করা হচ্ছে, দিচ্ছে তার কম। একধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছে। এখনই যদি নজরদারি করা না হয়, তাহলে অন্যান্য পণ্যের মতো চালের বাড়তি দামে ক্রেতার ভোগান্তি বাড়বে। এদিন রাজধানীর একাধিক খুচরা বাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫৫-৫৬, যা এক মাস আগে ৫০ টাকা ছিল। মাঝারি আকারের মধ্যে প্রতি কেজি বিআর-২৮ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা। আগে এ চালের দর ছিল ৫২ থেকে ৫৪ টাকা। আর প্রতি কেজি মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭২ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৬২ থেকে ৬৫ টাকা। বাংলাদেশ মেজর ও হাসকিং মিল মালিক সমিতির সহসভাপতি সহিদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন বলেন, দিনাজপুরে মোট ২ হাজার ১৮৫টি অটো চালকলের মধ্যে সচল রয়েছে ৩৫০টি। এর মধ্যে চালু আছে ১৫০টি। এছাড়া হাসকিং মিল আছে ৪০০টি। তবে ধানের সংকটে হাসকিং মিলগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ। এখন যেসব ধান রয়েছে বাজারে, সেগুলো মজুতদার ব্যবসায়ীদের। এসব ব্যবসায়ীর কোনো লাইসেন্স নেই। লাইসেন্সহীন মজুতদারি বন্ধ হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, খুচরা ব্যবসায়ীরা ধানের মনে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বাড়িয়েছেন। অনেকে চাল গুদামজাত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াচ্ছেন। ফলে চালের দামও বেড়েছে। বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল বলেন, চালের দাম কেন বেড়েছে, তা তদারকি করা হচ্ছে। কোন পর্যায় থেকে দাম বৃদ্ধি হয়েছে, তা দেখা হবে। এ সময় অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ানোর তথ্য পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে আইনের আওতায় আনা হবে। প্রসঙ্গত, ২৬ আগস্ট ভারত চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এতে বিশ্ববাজারে বাড়ে চালের দাম। ওই সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট এবং চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের আশ্বাস ছিল, ফলন ভালো হওয়ায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ধান-চালের মজুত পর্যাপ্ত। এ চাল শেষ হওয়ার আগেই উঠবে আমন। তাই আমদানি করতে হবে না, দামও বাড়বে না। তবে আমন ওঠার আগেই বাজারে বেড়েছে দাম।