বকেয়া পরিশোধে হিমশিম বিপিসির বাংলাদেশ ব্যাংকে জরুরি চিঠি জ্বালানি বিভাগের


জ্বালানি আমদানির বকেয়া পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জমে থাকা বকেয়া আমদানি বিল নিষ্পত্তির জন্য জরুরিভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা চেয়ে এই চিঠি দিয়েছে। জানা যায়, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীদের কাছে বিপিসির বকেয়া ৬৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদিও ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীদের কাছে বিপিসির বকেয়া ছিল মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার। দেড় মাসেই বকেয়া বেড়েছে ৬২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীদের কাছে বিপিসির বকেয়া পেমেন্ট ৬৭০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ২৬০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া আছে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের কাছে এবং ৪১০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া অন্যান্য সরবরাহকারীদের কাছে। এ অর্থ পরিশোধে আরও বিলম্ব হলে সরবরাহকারীরা জরিমানা আরোপ করতে পারে বলে জানা গেছে। এ পরিস্থিতিতে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী, সচিব, বিপিসি ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানসহ জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বিষয়টি সমাধানের জন্য ২৮ সেপ্টেম্বর একটি জরুরি বৈঠক করেন। উচ্চপর্যায়ের এ বৈঠকের একটি সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রণালয় বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসের শুরুতে ডলার সংকটের কারণে বিপিসি আমদানি বিল পরিশোধ করতে হিমশিম খায়। সেসময় কিছু সরবরাহকারী পেমেন্ট পাওয়ার আগে চট্টগ্রাম বন্দরে তেল আনলোড করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর বিপিসি অর্থ পরিশোধ করলে একজন সরবরাহকারী বন্দরে তেল আনলোড করে। এরপর থেকে বিপিসি নিয়মিতভাবে আমদানি বিল পরিশোধের চেষ্টা করছে। কিন্তু ডলারের অভাবে আগস্টের মাঝামাঝিতে পরিস্থিতি খারাপ হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, করপোরেশনে টাকার অভাব নেই, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে তারা পর্যাপ্ত ডলার পাচ্ছে না। ওই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের যা দিচ্ছে, তা অপর্যাপ্ত। তিনি জানান, আমদানি বিলের চাহিদা মেটাতে বিপিসির দৈনিক গড়ে ৩৫ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। কিন্তু এ বছরের ২৫ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তারা প্রতিদিন ১৫ মিলিয়ন ডলার থেকে সর্বোচ্চ ২৫ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে। এদিকে ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এখন আর জ্বালানি আমদানির এলসি খুলতে চাচ্ছে না। স্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি ব্যাংক সর্বশেষ গত বছরের মার্চে বিপিসির জন্য এলসি খোলে। এরপর এ বছরের জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার পাওয়ার পর আরেকটি ব্যাংক ৫ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলে। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ করে। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে বড় ধরনের গ্যাপ দেখা দেয়। বর্তমানে চার মাসের বেশি সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় আমদানির সমপরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে রিজার্ভ পরিস্থিতির কারণে এলসি খোলা পেছানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের সরবরাহ বাড়াবে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। জানা যায়, বিপিসি প্রতিমাসে ৫ লাখ টন পরিশোধিত এবং ১ লাখ টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করে। এজন্য ১৭ থেকে ১৮টি এলসি খুলতে হয়। এর খরচ ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ডলার। ডলারের দাম বৃদ্ধিতে এখন প্রতিমাসে আরও ২৫ শতাংশ বেশি খরচ হচ্ছে তাদের। বিপিসি মোট ১০টি প্রতিষ্ঠান থেকে জ্বালানি তেল সংগ্রহ করে থাকে। এর মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করে। বাকি আট প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করে পরিশোধিত জ্বালানি তেল। বিপিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সোমবার পর্যন্ত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভিটলের বকেয়া দাঁড়িয়েছে ১১৬.৪৮ মিলিয়ন ডলার। চারটি এলসির পাওনা সময়মতো পরিশোধ না হওয়ায় এ পরিমাণ বকেয়া জমেছে। এসব পাওনা ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিশোধ করার কথা ছিল। এলসিগুলো খোলা হয়েছিল সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে। আরেক সরবরাহকারী ইউনিপেকের পাওনা ৩৩.৫৪ মিলিয়ন ডলার। সোনালী ব্যাংকে খোলা একটি এলসির বিপরীতে এই পরিমাণ পাওনা রয়েছে, যেটি ১১ সেপ্টেম্বর পরিশোধ করার কথা ছিল। একইভাবে বিএসপি নামের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অগ্রণী ব্যাংকের একটি এলসির বিপরীতে ৩২.৩৩ মিলিয়ন ডলার পাবে, যা ৩০ আগস্ট পরিশোধের দিন ধার্য ছিল। এছাড়া পেট্রোবাংলাও আমদানি করা এলএনজির মূল্য সময়মতো পরিশোধ করতে পারছে না। সরবরাহকারীদের কাছে তাদের বকেয়া দেনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার। পেট্রোবাংলার কাছেও টাকার ঘাটতি রয়েছে বলে জানা গেছে। আশা করা হচ্ছে, বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির টাকা ছাড় হলে পেট্রোবাংলার বকেয়া পরিশোধ করা সহজ হবে। বাংলাদেশ যত জ্বালানি তেল আমদানি করে, এর ৭০ শতাংশ পরিশোধিত তেল। বাকিটা অপরিশোধিত। মোট জ্বালানি তেলের ৭০ ভাগ ডিজেল। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩২ লাখ ৬৫ হাজার টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল কেনার পরিকল্পনা রয়েছে বিপিসির। এ সময়ে ৬ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিরও পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থাটির। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিপিসি পরিশোধিত ও অপরিশোধিত মিলিয়ে প্রায় ১৮ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করেছে।