বহুমুখী চ্যালেঞ্জে পাতাল রেল
অনলাইন নিউজ ডেক্স
দেশের প্রথম পাতাল রেল বা মেট্রোরেল প্রকল্প-১ এর নির্মাণ কাজ বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। মূল কাজ শুরুর আগে পরিষেবা স্থানান্তর চলছে। এতে যানজটে স্থবির হয়ে পড়েছে বিমানবন্দর থেকে প্রগতি সরণি। পরিষেবা স্থানান্তরের পর মেট্রো স্টেশন নির্মাণ শুরু হলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আরও কঠিন হবে। কুড়িল থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত একটি বাইপাস সড়ক নির্মাণের কোনো কূলকিনারা করা যাচ্ছে না। ভূ-গর্ভস্থ টানেল নির্মাণ কাজ চলার সময় সড়ক দেবে যাওয়া ও আশপাশের ভবন হেলে পড়ার মতো ঝুঁকি রয়েছে। তখন পুরো করিডরের চলাচল বন্ধ করা ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না। প্রকল্পের সময় অনুযায়ী কাজের অগ্রগতি না হলে নির্মাণ ব্যয় ও সময় অনেকাংশে বাড়বে।
পরিষেবা স্থানান্তরের কাজের ক্ষেত্রেও সেবা সংস্থাগুলো যথাযথভাবে সহযোগিতা করছে না। ফুটপাতও নির্মাণ সামগ্রীর দখলে চলে গেছে। সরু সড়ক দিয়ে নানা ধরনের হাজার হাজার যানবাহন চলাচলে তীব্র যানজটে নাকাল মানুষ। ৫ থেকে ১০ মিনিটের দূরত্ব পাড়ি দিতে ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছে; অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার নগরবাসী।
এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত খুবই ব্যস্ত সড়ক। এর দুপাশে সড়ক লাগোয়া দুর্বল কাঠামোর শত শত বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। সাধারণত এ ধরনের সড়কে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ নিয়ে কোনো দেশ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে না। বাংলাদেশের নিকটবর্তী দেশ ভারত ১৯৮৪ সালে কলকাতায় পাতাল মেট্রোরেল তৈরি হয়েছে। কাজ শুরুর সময় বহুমুখী জটিলতায় একপর্যায়ে তারা কাজ বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তাও করেছিলেন। পরে অনেক জটিলতা ও দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে কাজ শেষ করে।
তিনি বলেন, ঢাকার বেশিরভাগ ভবনের ‘স্ট্রাকচারাল ডিজাইন’ ঠিক রাখা হলেও ‘কনস্ট্রাকশন’ দুর্বল থাকে। এ কারণে পাতাল মেট্রোরেলের টানেল তৈরির সময় সড়কের পাশ ঘেঁষে গড়ে ওঠা এসব ভবন হেলে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি সড়কও দেবে যেতে পারে বা ধসে পড়তে পারে। এই অবস্থা হলে পুরো করিডর বন্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
তিনি জানান, এমআরটি-১ এর পাতাল মেট্রোরেল নির্মাণ করিডরে শঙ্কা মোকাবিলায় সতর্কতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর এটা করতে হলে খরচ বাড়বে। এত খরচ হলে সে খরচ তো ভাড়ায় উঠবে না। এজন্য একথা বলা যায় যে-এমআরটি-১ প্রকল্প সস্তার বা স্বস্তির উন্নয়ন হবে না; শ্বেতহস্তীর উন্নয়ন হবে। এটিকে টেকসই উন্নয়ন বলা যায় না; কেননা টেকসই উন্নয়নের শর্ত হলো-কম খরচে উন্নয়ন কাজ করা।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, অপরিকল্পিতভাবে মেট্রোরেল-১ এর সেবা সংযোগ স্থানান্তর কাজের কারণে নতুন বাজার থেকে কুড়িল ফ্লাইওভার পর্যন্ত যানজটে স্থবির হয়ে পড়েছে। এই যানজটে প্রগতি সরণি সড়কের দুপাশের শতাধিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বেচা-বিক্রিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এখন হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর এবং কুড়িল থেকে কাঞ্চন ব্রিজ সেতু পর্যন্ত এআরটি-১ প্রকল্পের কাজকে কেন্দ্র করে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। তবে এর মধ্যে বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, কুড়িল, যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় চলছে পরিষেবা স্থানান্তর কাজ। এরপর এসব স্থানে নির্মাণ করা হবে ভূ-গর্ভস্থ স্টেশন। যমুনা ফিউচার পার্কসংলগ্ন আধুনিক এস্কেলেটর ওভারব্রিজ বন্ধ থাকায় গাড়ি থামিয়ে দৌড়ে সড়ক পার হচ্ছেন অনেকে। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে।
আরও জানা যায়, যানবাহনের বেপরোয়া চলাচল এবং যততত্র প্রকল্পের নির্মাণসামগ্রী রাখা বন্ধে ট্রাফিক পুলিশও নির্বিকার। ঢাকা ওয়াসা, বিদ্যুৎ বিভাগসহ যেসব সংস্থার সংযোগ স্থানান্তর করা হচ্ছে; তারা খেয়াল খুশিমতো কাজ করছে। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ তাদের কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এজন্য সমন্বয় সভা করেও কার্যকর সমাধান দিতে পারছে না।
দেশের প্রথম পাতালরেল প্রকল্প : ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি-১ দেশের প্রথম পাতাল রেল প্রকল্প। এটি দুটি অংশে বিভক্ত; এর একটি-বিমানবন্দর রুট; হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল থেকে খিলক্ষেত-কুড়িল-যমুনা ফিউচার পার্ক-বাড্ডা-রামপুরা-মালিবাগ-রাজারবাগ-কমলাপুর পর্যন্ত মাটির নিচ দিয়ে যাবে। এই অংশের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার এবং পাতাল স্টেশন সংখ্যা-১২টি। অপরটি-পূর্বাচল রুট; নতুন বাজার হতে কুড়িল হয়ে কাঞ্চন সেতুর পশ্চিম পাশ পিতলগঞ্জ পর্যন্ত উড়াল পথে যাবে। ৭টি উড়াল এবং ২টি পাতাল স্টেশনসহ পূর্বাচল রুটের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৩৬৯ কিলোমিটার। নর্দা ও নতুন বাজার স্টেশন বিমানবন্দর রুটের অংশ হিসাবে পাতালে নির্মিত হবে। নর্দা ও নতুন বাজার রুটের আন্তঃরুট সংযোগ ব্যবহার করে বিমানবন্দর রুট থেকে পূর্বাচল রুটে এবং পূর্বাচল রুট থেকে বিমানবন্দর রুটে যাওয়া যাবে। এ প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে-ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট লাইন-১ বা ঢাকার দ্রুতগামী গণপরিবহণ উন্নয়ন প্রকল্প প্রকল্পের মেয়াদকাল ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, তবে কাজের অগ্রগতি আশানুরূপ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না। ২০৩০ সালের আগে প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। সঙ্গে বাড়বে ব্যয়ও। আর এখন চলছে সেবা সংযোগ স্থানান্তর কাজ; এ কাজে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭০০ কোটি টাকা। প্রকল্পের মোট আকার ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হয় ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। এর আগে ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল।
প্রকল্পের সুবিধা : প্রকল্পটি চালু হলে উভয় রুটে দৈনিক ৮ লাখ যাত্রী চলাচল করতে পারবে। একমুখী মেট্রো ট্রেন প্রতিবারে ১২টি স্টেশনে থেমে ২৪ মিনিট ৩০ সেকেন্ডে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত যেতে পারবে। ১৬টি স্টেশনে থেমে ৩৫ মিনিট ৩০ সেকেন্ডে কমলাপুর থেকে পূর্বাচল টার্মিনাল পর্যন্ত যাতায়াত করবে। এতে অল্প সময়ে অধিক সংখ্যক যাত্রী পরিবহণ করা যাবে। ছোট ছোট যানবাহনের ব্যবহার উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যায় হ্রাস পাবে। ঢাকা মহানগরীর জীবনযাত্রায় ভিন্নমাত্রা যোগ করবে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : মেট্রোরেল লাইন-১ প্রকল্পের উপ-পরিচালক ফয়েজ আহমেদ বলেন, মেট্রোরেলের সেবা সংযোগ কাজের কারণে মানুষের দুর্ভোগ হচ্ছে, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে আমরা দ্রুততম সময়ে সেবা সংযোগ স্থানান্তরের কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, মেট্রোরেল লাইন-১ এর মূল কাজ শুরুর সময় ওই সড়কের সিংহভাগই বন্ধ হয়ে যাবে। তখন দুই পাশের দুটি লেন কোনো রকম খোলা রাখা যাবে। সে সময় মাদানী এভিনিউ হয়ে যানবাহন চলাচলের বিকল্প ব্যবস্থা করবে। এটা এখনি করা গেলে অনেক ভালো হতো। তবে কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও করা সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি জানান, সেবা সংস্থাগুলো খেয়াল-খুশিমতো কাজ করছে। মেট্রোরেলের নির্দেশনা তারা মানতে চাচ্ছেন না। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা হবে। জানুয়ারিতেই কুড়িল, যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকার সেবা সংযোগ স্থানান্তরের কাজ শেষ হবে বলে জানান।
মেট্রোরেল লাইন-১ এর প্রকল্প পরিচালক মো. আবুল কাসেম ভূঁঞা বলেন, সত্যি কথা বলতে এই মুহূর্তে কোনো সমাধান আমাদের কাছে নেই। আরও একটি মাস ওই এলাকার বাসিন্দা এবং নগরবাসীকে কষ্ট করতে হবে। জানুয়ারির মধ্যে কুড়িল, যমুনা ফিউচার পার্ক ও জোয়ার সাহারা এলাকার কাজ শেষ হবে।
তিনি বলেন, ৩০০ ফুট হয়ে মাদানী এভিনিউ দিয়ে চলাচল করতে একটি বাইপাস সড়ক তৈরি করা হবে। সেটি মেট্রোরেল লাইন-১ এর মূল কাজ শুরু করার সময়। সে লক্ষ্যে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আর প্রকল্পের সার্বিক কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিতে কাজও করছেন।
তিনি জানান, দেশের প্রথম পাতাল রেল প্রকল্প এটি। এটি বাস্তবায়নে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেগুলো মাড়িয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে তাদের তৎপরতা রয়েছে। টানেল নির্মাণের সময়ের চ্যালেঞ্জ মাড়িয়েও প্রকল্প বাস্তবায়ন করার মানসিক প্রস্তুতি রয়েছে। আর এ কাজে যুক্ত রয়েছেন-আন্তর্জাতিকমানের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞরা। এরপরও ঝুঁকির বিষয়ে তাদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) দিয়ে ভূগর্ভস্থ খনন কাজ করা হবে।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।