বাজেটে প্রাধান্য গরিবের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি


বাজেটে প্রাধান্য গরিবের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি
প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে আগামী (২০২৫-২৬) অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে খাদ্য ভর্তুকি ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। দুস্থদের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আইএমএফের ঋণের শর্ত উপেক্ষা করেই ভর্তুকি বাড়ানো হচ্ছে।এই কর্মসূচির মেয়াদ বছরে পাঁচ মাসের পরিবর্তে ছয় মাস করা হচ্ছে। সংকটময় অর্থনীতি ও টানা ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির প্রভাবে দেশের মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান দুটি কমেছে, কর্মহীন হয়েছে অনেকে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকার তার প্রথম বাজেটে ‘খাদ্যবান্ধব’ কর্মসূচি অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এর আওতায় আগের চেয়ে উপকারভোগীর সংখ্যা ও স্বল্পমূল্যে চাল বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রে।নতুন কর্মসংস্থান কম হচ্ছে এবং মূল্যস্ফীতির কারণে কিছু লোকের কষ্ট হচ্ছে এটা স্বীকার করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তার মতে, ‘সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ নয়। তবে মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় আয়ের বিষয়টি বড়।’ সে অনুপাতে আয় কমছে।অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কষ্টে থাকা মানুষগুলো খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে সহায়তা পাবেন। এর আওতায় আগামী অর্থবছরে ৫৫ লাখ মানুষকে ১৫ টাকা কেজি দরে ছয় মাস চাল দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রতি মাসে একজন উপকারভোগী পাবেন ৩০ কেজি চাল। অবশ্য চলতি অর্থবছরে ৫০ লাখ মানুষকে পাঁচ মাস এ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ১০ লাখ মেট্রিক টন বরাদ্দ থাকছে। চলতি অর্থবছরে ছিল সাত লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন চাল।সরকারের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, প্রতি বছরের মার্চ, এপ্রিল, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর গরিব মানুষের কাজের অভাব থাকে। তাই এ পাঁচ মাস নামমাত্র দামে পরিবারগুলোকে চাল কেনার সুযোগ দেওয়া হয়। এখন তা ছয় মাস করা হচ্ছে। কর্মসূচিটি বাস্তবায়নে ইউনিয়ন পর্যায়ে বসবাসরত বিধবা, বয়স্ক, পরিবারপ্রধান নারী, নিম্ন আয়ের দুস্থ পরিবার প্রধানদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার একটি তালিকা করা হয়।জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ জানান, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় আগামীতে সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া বয়স্ক ও বিধবাসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কর্মসূচির ভাতার অঙ্ক বাড়ানো হচ্ছে।তিনি আরও বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আরও বেগবান করতে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করে যাচ্ছে।সূত্র মতে, খাদ্যবান্ধব ছাড়াও সরকারের অন্যান্য কর্মসূচিতে আগামী অর্থবছরে ৩৭ লাখ মেট্রিক টন চাল বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। কিন্তু দেশীয়ভাবে সর্বোচ্চ ২০ লাখ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করা সম্ভব। প্রয়োজনীয় চালের চাহিদা মেটাতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এ বছর ৯ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে চুক্তি হয়েছে সাড়ে আট লাখ মেট্রিক টনের।বৈশ্বিক বাজারদর অনুযায়ী প্রতি মেট্রিক টন চালের মূল্য ৪৭০ থেকে ৪৮০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত পড়বে। ওই হিসাবে প্রতিকেজি চালের মূল্য ৬২ টাকা। কিন্তু গরিব মানুষকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে যে চাল দেওয়া হবে তার মূল্য ৩০ টাকা।মূল্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিকেজি চালে সরকারকে ভর্তুকি গুনতে হবে ৪৭ টাকা। যে কারণে খাদ্য ভর্তুকির অঙ্ক চলতি বছরের তুলনায় বেড়ে ১০ হাজার কোটি টাকায় ঠেকছে। চলতি অর্থবছরে খাদ্য ভর্তুকির অঙ্ক হচ্ছে আট হাজার ৫৯ কোটি টাকা।অবশ্য উৎপাদন ও চাহিদার কারণে চালের আমদানি বাড়ছে। বিগত ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চাল আমদানি করতে হয়নি।জানতে চাইলে অর্থ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ জানান, আইএমএফ ভর্তুকি বাড়ানোর বিপক্ষে থাকলেও মনে রাখতে হবে খাদ্য খাতে ভর্তুকি এক ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় পড়ে। এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট গরিব মানুষের কাছে খাদ্য সহায়তা পৌঁছানো হয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনেকের চাকরি নেই, বেকার হয়ে পড়ছে, আবার মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের আয়ও কমছে। সেদিক বিবেচনায় এই কর্মসূচি আরও শক্তিশালী হচ্ছে এটি ভালো উদ্যোগ।এদিকে এপ্রিলে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাব চলছে বিগত তিন বছর ধরে। যার প্রভাবে দেশের মানুষের প্রকৃত আয় কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী উচ্চ মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরির হার কম হলে দারিদ্র্যসীমার উপরে মোট জনগোষ্ঠীর ১০ শতাংশ মানুষ অতিঝুঁকিতে থাকে। সেই হিসাবে দেড় কোটি মানুষ বছরজুড়ে এমন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে।বিবিএস তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। সে সময় জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বাড়লেও মজুরি বেড়েছে তার চেয়ে বেশি। তাই মূল্যস্ফীতির চাপ মানুষের ওপর ততটা পড়েনি।কিন্তু ২০২৩ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ওই বছর মজুরি বৃদ্ধির হার কোনোভাবে ৮ শতাংশ ছাড়ায়নি। সর্বশেষ ২০২৪ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২৪ সালের ১২ মাসের মধ্যে প্রথম আট মাস মজুরি বৃদ্ধি হার ছিল ৭ শতাংশের ঘরে। শেষ চার মাস ৮ শতাংশের উপরে ছিল এই হার।মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ৩৭ লাখ মানুষ হতদরিদ্র হয়ে পড়ছেন বলে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় বেরিয়ে আসছে। এছাড়া রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানে শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। বেতন-ভাতা না দেওয়া অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছে। ফলে আসন্ন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।