বেয়াদব ও কিছু কথা


বেয়াদব শব্দের অর্থ অভদ্র বা উচ্ছৃঙ্খল, আদবহীণ, বেহায়া, লজ্জ্বাহীণ, অবাধ্য মানুষদের বেয়াদব বলে। যার আদব কায়দা জানা নেই,যে বড়দের সম্মান করে না।বড়দের মুখের ওপর কথা বলে,জাকে জেটা বলার অধিকার তার থাকে না সেটাও বলে বসে, কথা বলার লাগাম থাকে না এই ধরনের লোকদের বেয়াদব বলা হয়।

আদব শব্দটি আরবি শব্দ থেকে বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত ও প্রচলিত শব্দ; যার অর্থ হলো: বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, শোভনতা, শিষ্টাচার। আবার আদাব শব্দের অর্থ: নিয়মনীতি, পদ্ধতি ইত্যাদি। আর আদব-কায়দা মানে— ভদ্র সমাজের রীতি-পদ্ধতি; ভদ্র ব্যবহার। অন্যভাবে বলা যায়: আদব-কায়দা মানে কাঙ্খিত শিক্ষা, সভ্যতা ও মার্জিত সংস্কৃতির দ্বারা আত্মগঠনের অনুশীলন করা। আর আমাদের দেশীয় ভাষায় বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, শোভনতা ইত্যাদি গুণাবলী যে ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তাকে ‘মুয়াদ্দাব’ শালীন, ভদ্র ও সুশিক্ষিত বলে। আর এসব গুণাবলী যার মধ্যে বিদ্যমান নেই, তাকে ‘বেয়াদব’ অশালীন, অভদ্র, অসভ্য বলে।

আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন, তুমি আদব অন্বেষণ কর, কারণ, আদব হলো বুদ্ধির পরিপুরক, ব্যক্তিত্বের দলীল, নিঃসঙ্গতায় ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রবাসজীবনের সাথী এবং অভাবের সময়ে সম্পদ।” আর আদব বা শিষ্টাচার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার দ্বারা ব্যক্তির জীবন পরিশুদ্ধ ও পরিপাটি হয়; আর এ আদব হলো দীন ইসলামের সারবস্তু; সুতরাং মুসলিম ব্যক্তির জন্য জরুরি হলো আল্লাহ তা‘আলার সাথে, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এবং সাধরণ মানুষসহ সকল সৃষ্টির সাথে আদব রক্ষা করে চলা; আর এ আদবের মাধ্যমেই একজন মুসলিম জানতে পারবে তার খাবার ও পানীয় গ্রহণের সময় তার অবস্থা কেমন হওয়া উচিৎ; কিভাবে তার সালাম প্রদান, অনুমতি গ্রহণ, বসা, কথা বলা, আনন্দ ও শোক প্রকাশ করা, হাঁচি দেওয়া ও হাই তোলার মত বিবিধ কাজ সম্পন্ন হবে; আর কেমন ব্যবহার হবে তার পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে। এক কথায় এ আদব-কায়দা রক্ষা করে চলার মাধ্যমেই একজন মুসলিম কাঙ্খিত মানের ভদ্র ও সভ্য মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে এবং নিজেকে অন্যান্য জাতির চেয়ে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে; ফলে দীন ইসলামের সৌন্দর্য ছড়িয়ে যাবে সমাজ, রাষ্ট্র ও দুনিয়ার দিক দিগন্তে। তাইতো কেউ কেউ শিক্ষার চেয়ে আদব বা শিষ্টাচারের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন; ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: “তোমরা আগে সুসভ্য হও, তারপর জ্ঞান অর্জন কর।” আল-কারাফী তাঁর ‘আল-ফারুক’ গ্রন্থে বলেন:-“ব্যক্তি কোনো প্রকার জ্ঞান দ্বারা মহৎ হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার জ্ঞানকে আদব দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত করবে।

মুসলিম ব্যক্তি তার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অগণিত নি‘য়ামতের প্রতি লক্ষ্য করে; আরও লক্ষ্য করে ঐসব নি‘য়ামতের প্রতি, যেসব নি‘য়ামত তার মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময় থেকে শুরু করে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ (মৃত্যু) করা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে তাকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। ফলে সে তার নিজ মুখে তাঁর যথাযথ প্রশংসা ও গুণকীর্তন করার দ্বারা এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহকে তাঁর আনুগত্যের অধীনস্থ করে দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করে; আর এটাই হলো তার পক্ষ থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সাথে আদব; কেননা, নি‘য়ামতের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, অনুগ্রহকারীর অনুগ্রহকে অস্বীকার করা, তাকে এবং তার ইহসান ও অবদানকে অবজ্ঞা করাটা কোনো আদব বা শিষ্টাচরের মধ্যে পড়ে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন: “তোমাদের নিকট যেসব নিয়ামত রয়েছে, তা তো আল্লাহর নিকট থেকেই এসেছে। তোমাদের কী হল যে, তোমরা আল্লাহ‌র শ্রেষ্ঠত্বের পরওয়া করছ না। অথচ তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন পর্যায়ক্রমে। তিনি আরও বলেন, আর তিনি জানেন তোমরা যা গোপন কর এবং তোমরা যা প্রকাশ কর।

কয়েকদিন আগে জুম্মার নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম একটি হোটেলে।নিয়মমাফিক ইমাম খোদবা দিলেন। খোদবার পরে তিনি নামাজীদেরকে বললেন যে যা পারেন আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে নির্মাণাধীন মসজিদ/ মাদ্রাসার জন্য সাহায্য করবেন। কথা শেষ না হতেই এক বাংলাদেশী দাঁড়াইয়া চিল্লান দিয়ে উঠে বলতেছে আজ পাঁচ বছর ধরে টাকা তুলতেছেন! আপনাদের আর কত টাকা লাগবে? এগুলো বন্ধ করেন এইবার? তখন নরম সুরে ইমাম সাহেব বললেন আপনি নামাজের পরে আমাদের সাথে কথা বলবেন। আপনাকে বিস্তারিত জানাবো। নামাজের পরে আমি ইমাম সাহেবের কাছে জানতে চাইলাম। সেই ভদ্রলোক এসেছে কিনা। তিনি জানালে উনি আসেনি। তারপর ইমাম বলতেছিলেন এই পাঁচ বছরে এই লোক এক পয়সা ও দেয় নাই! প্রায়ই উনি সাথে আরও কয়েকজন আছে এমন করে। মনে হয় যেন উনাদের পকেটের পয়সাগুলো অন্যান্য লোকগুলো দিয়ে দিতেছে! আমি বললাম ওনাদেরকে পুলিশে দেন না কেন? ইমাম সাহেব বললেন দেখি যদি আল্লাহ্‌র রাস্তায় ফিরে আসে তাই। আর যদি দেখি আল্লাহ্‌র রাস্তায় ফিরে না এসে আরও উচ্ছৃঙ্খল হয় তখন পুলিশের কাছে দেওয়া ছাড়া আর কোন পথ থাকবে না। আমাদের বড় প্রজেক্ট তাই সবার কাছে সাহায্য চাই। এই দুনিয়ায় যত মসজিদ মাদ্রাসা হয়েছে সবই সবার সহায়তায়। দেশে শুনতাম বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসায় সাহায্য সহযোগিতা চাইলে ও ইমামদের সাথে এই ধরনের ব্যাবহার করে। আর আজ দেখলাম প্রবাসে এসে ও ওরা মানুষ হয়নি। আসলে কয়লা ধুইলে তার ময়লা যেমন যায় না, ঠিক এই ধরনের বেয়াদপ বা উচ্ছৃঙ্খল লোকগুলো দুনিয়ার যেখানেই যাক না কেন পরিবর্তন হবে না। এক আল্লাহ পারেন পরিবর্তন করতে।

পরিশেষে বলব, যে কোন মুসলিম ব্যক্তি কর্তৃক তার প্রতিপালকের নি‘য়ামতের জন্য তাঁর শুকরিয়া আদায় করা, তাঁর অবাধ্যতার দিকে ধাবিত হও সময় তাঁকে লজ্জা পাওয়া, তাঁর কাছে সত্যিকার অর্থে তাওবা করা, তাঁর উপর ভরসা করা, তাঁর রহমতের প্রত্যাশা করা, তাঁর শাস্তিকে ভয় করা, তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে এবং তাঁর ইচ্ছা মাফিক তাঁর কোনো বান্দার প্রতি শাস্তিমূলক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ব্যাপারে তাঁর প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করাটাই হলো আল্লাহ তা‘আলার সাথে তার আদব রক্ষা করে চলা; আর বান্দা কর্তৃক এ আদবের যতটুকু ধারণ ও রক্ষা করে চলবে, ততটুকু পরিমাণে তার মর্যাদা সমুন্নত হবে, মান উন্নত হবে এবং সম্মান বৃদ্ধি পাবে; ফলে সে আল্লাহর অভিভাবকত্ব ও তা তাঁর তত্ত্ববধানে থাকা ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং তাঁর রহমত ও নি‘য়ামত পাওয়ার উপযুক্ত হবে।আর এটাই মুসলিম ব্যক্তির দীর্ঘ জীবনের একমাত্র চাওয়া এবং চূড়ান্ত প্রত্যাশা। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আপনার অভিভাবকত্ব নসীব করুন, আপনি আমাদেরকে আপনার তত্ত্ববধান থেকে বঞ্চিত করবেন না এবং আমাদেরকে আপনার নিকটতম বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত করুন; হে আল্লাহ! হে জগতসমূহের প্রতিপালক! আপনি ওদেরকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসুন। আমাদের আবেদন কবুল করুন। আমিন।