বেলুচিস্তানে ভারতের গোয়েন্দা কার্যক্রম ওপেন সিক্রেট
অনলাইন নিউজ ডেক্স

পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে জাফর এক্সপ্রেস নামের ট্রেনটি মঙ্গলবার ধুলিধূসর পার্বত্য এলাকার মাঝ দিয়ে কোয়েটা থেকে পেশাওয়ারে যাচ্ছিল। একটি টানেলের কাছাকাছি আসতেই ট্রেনটিতে সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে। ৪৪০ জন যাত্রীকে জিম্মি করে বালুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) নামের বিচ্ছিন্নতাবাদী একটি সংগঠন। কিন্তু ২৫ বছরে বিএলএর যে সহিংস হামলার ঘটনাগুলো ঘটেছে; তা ছিল নেহাত আঞ্চলিক একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সিগনেচার।কিন্তু জাফর এক্সপ্রেস হাইজ্যাক করার ক্ষেত্রে যে উন্নত সামরিক কৌশল ও পেশাদারত্বের পরিচয় পাওয়া গেছে; তা স্পষ্টতই কোনো প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর মতো। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উদ্ধার অভিযানে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা সময় লেগেছে ট্রেনটির নিয়ন্ত্রণ নিতে। এর মাঝে হাইজ্যাকারদের হাতে ২১ জন যাত্রীর মৃত্যু ঘটেছে। উদ্ধার যুদ্ধে ৩৩ জন হাইজ্যাকার নিহত হয়েছে এবং পাকিস্তানের আধা-সামরিক বাহিনীর চার সদস্যের মৃত্যু ঘটেছে।পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শাফকাত আলী খান অভিযোগ করেছেন, আমরা জানি ভারত কিভাবে তার প্রতিবেশী দেশগুলোকে অস্থিতিশীল করে রাখতে চায়। আর সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমা বিশ্বেও তাদের নাশকতা কার্যক্রমের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বেলুচিস্তানে ভারতের গোয়েন্দা কার্যক্রম ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে; এর আগে ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা কুলভূষণ যাদব গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে। যাদব এখনো পাকিস্তানের কারাগারে রয়েছেন। আর ট্রেন হাইজ্যাক করার ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা কৌশল ব্যবহৃত হওয়ায়; একে স্বাভাবিকভাবেই কেউ আর স্থানীয় সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম হিসাবে মনে করছে না।এছাড়া আফগানিস্তানে পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর অনেক ভারতীয় কনস্যুলেট স্থাপিত হওয়ায়; তা যে শুধু কনস্যুলার সার্ভিসের জন্য নিবেদিত নয়; এ সম্পর্কেও রয়েছে সন্দেহের বাতাবরণ।এর আগে করাচিতে জিন্নাহ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় হামলাকারীদের ফেলে যাওয়া ভারতীয় অস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল। করাচিতে চীনের নাগরিকদের ওপর হামলার তদন্তেও বালুচ সন্ত্রাসী ও এদের বিদেশি হ্যান্ডলারের যোগসাজশ খুঁজে পাওয়া যায়। বেলুচিস্তানের ট্রেন হাইজ্যাকিংয়ে হাইজ্যাকারদের সঙ্গে আফগানিস্তান থেকে হামলা পরিচালনাকারীদের কথোপকথনের রেকর্ড ধরা পড়েছে। ট্রেনে হামলাকারীদের আফগানিস্তানের মাটিতে বসে যারা নির্দেশনা দিয়েছে; তাদের গ্রেফতারের ব্যাপারে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাহায্য চেয়েছে।খালিস্তানপন্থি নেতা গুরপাতান্ত সিং পান্নু বেলুচিস্তানে ট্রেন হাইজ্যাকের ঘটনার জন্য ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততার অভিযোগ করেছেন। তিনি এই গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান অজিত দোভালের দক্ষিণ এশিয়াব্যাপী সন্ত্রাস সম্প্রসারণ নীতির কড়া সমালোচনা করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে কানাডা ও আমেরিকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ধরা পড়ার কথাও তুলে ধরেছেন।বেলুচিস্তানে ট্রেন হাইজ্যাকের ঘটনার পর পাকিস্তানের মিডিয়ায় ‘প্রতিবেশী রাষ্ট্র’ ও ‘শত্রু রাষ্ট্র’র ভূমিকার কথা আলোচিত হয়েছে। তবে ভারতের মিডিয়ায় যে রকম প্রতিবেশীকে দায়ী করে তোতাপাখির মতো ‘পাকিস্তান’ শব্দটি আউড়ানো হয়; পাকিস্তানের মিডিয়ায় সেভাবে ‘ভারত’ শব্দটি তোতাপাখির মতো আউড়ানো হয়নি। আলোচনায় একটা পরিশীলিত শব্দচয়নের ঝোঁক লক্ষ্য করা গেছে।বেলুচিস্তানে বিএলএ ও বেলুচ রাজি আজোই সাংগার জাতীয় সশস্ত্র সংগঠনগুলো তৈরি হওয়ার কারণ সেখানকার বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থা। আদিম সামন্ত ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে সেখানে। কথিত জমিদার পরিবারগুলো রাজনৈতিক নেতৃত্ব দখল করে রাখে। উন্নয়নের সমুদয় বাজেট তারা ভাগ করে নেয়। পাকিস্তানের প্রদেশগুলো যেহেতু স্বশাসিত, ফলে কেন্দ্রের পক্ষে সরাসরি সেখানে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। কথিত সামন্ত শ্রেণি শিক্ষা বিস্তারের বিপক্ষে কাজ করে, যাতে সাধারণ মানুষ শিক্ষিত হয়ে সামন্ত শ্রেণিকে চ্যালেঞ্জ না করে। সীমাহীন বৈষম্য সেখানে দ্রোহের সঞ্চার করে। সেনাবাহিনী সেই বিদ্রোহ দমনে সচষ্টে হলে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের খড়গ নেমে আসে। সামন্ত শ্রেণিটি সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে ব্যবহার করে খনিজসম্পদ সমৃদ্ধ এই জনপদ থেকে তেল ও গ্যাস অন্যান্য প্রদেশে পরিবহণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে বখরা আদায়ের লক্ষ্যে।প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্রীড়নক হতেও এই সামন্ত শ্রেণি এগিয়ে থাকে। নিজের সন্তানদের পশ্চিমে পড়তে পাঠিয়ে বেলুচিস্তানে শিক্ষার আলো জ্বলতে না দেওয়াই এদের এ যাবতকালের রাজনীতি। ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে জমিদারি ব্যবস্থা বিলোপ না করায়; বেলুচিস্তানের সমস্যা টিডিয়াস আর্গুমেন্ট হয়ে আছে। বৈষম্যমূলক সমাজে জন-অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র সেখানে এত সক্রিয় থাকে যে, বেলুচিস্তান অ্যাডভেঞ্চারের ফ্যান্টাসি নিয়ে বলিউড মুভিও নির্মিত হয়। ফলে বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রমের একটি ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তো রয়েছেই।সম্প্রতি ভারতের সেনাপ্রধানের পাকিস্তানকে হুমকি দেওয়া ও পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের ভারতকে হুমকি দেওয়া দেখে ধারণা করা যাচ্ছিল প্রতিবেশীর উঠানে ঢুকে নাশকতার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। পাকিস্তানে ভারতের ব্যর্থ সার্জিকাল অ্যাটাক ও যুদ্ধ বিমান ভেঙে পড়ে বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা অভিনন্দন গ্রেফতার হওয়ার ঘটনার পর থেকে ভারত তার পাকিস্তান অ্যাডভেঞ্চার বন্ধ রেখেছিল। তাতে উভয় রাষ্ট্রই লাভবান হচ্ছিল।বিশ্বব্যাংক তো সেই কবেই বলে রেখেছে, যদি এই দুটি রাষ্ট্র তাদের ইগোর লড়াই বন্ধ রাখে, তাহলে অর্থনীতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে তাদের বহির্বিশ্বের শরণাপন্ন হতে হবে না।গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বাংলাদেশে ভারত সমর্থিত হাসিনা সরকারের পতন ঘটার পর থেকে দিল্লির সাউথব্লকের মুখমুণ্ডলে হতাশার রেখা স্পষ্ট। ভারতের চিরশত্রুতা পাকিস্তানের সঙ্গে হলেও মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান কারো সঙ্গেই তার সুসম্পর্ক নেই। হাসিনার জ্বেলে রাখা একমাত্র আনুগত্যের দেউটি ঢাকায় নিভে গেলে; দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামে পঞ্চায়েতির অমল আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে ভারত।ভারত তার অনুগত হাসিনাকে পাকিস্তানের সঙ্গে মেলামেশা করতে নিষেধ করে দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ও নাগরিকদের যাতায়াতের সম্পর্ক স্থাপন করায় ভারত বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সেনাপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রভাবিত মিডিয়া একসঙ্গে ক্রোধ প্রকাশ করেছে রাখঢাক না করেই।দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামটিতে কে কার সঙ্গে মিশবে বা মিশবে না; তা নির্ধারণ করার একটি গ্রামীণ মনোভঙ্গি ভারত সবসময় লালন করে। ভারতের বর্তমান সরকার একটি হিন্দুত্ববাদী সরকার। মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ এর রাজনৈতিক আদর্শ। ফলে সে হিন্দুত্ববাদকে মৌলবাদ বলে মনে না করলেও ইসলামকে মৌলবাদ বলে মনে করে। ইসলামের প্রতি অপছন্দ প্রকাশে পাকিস্তান শব্দটিকে ইসলামের প্রতিশব্দ হিসাবে বেছে নিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।সাংস্কৃতিকভাবে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষকে জনপ্রিয় করতে সম্প্রতি বলিউড মুঘল শাসক আওরঙ্গজেবের চরিত্র হননে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি দিয়েছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সামনের দিনগুলো রীতিমতো ধর্মীয় বিদ্বেষের মাইন পাতা ভূমিতে হাঁটার মতো।১৯৭৭ সালে একটি ডাচ ট্রেন সফলভাবে হাইজ্যাক করেছিল মলুক্কান বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। এরপর ২০২৫ সালে বেলুচ লিবারেশন আর্মি একটি পাকিস্তানি ট্রেন হাইজ্যাক করে দেখাল। আঞ্চলিক একটি সন্ত্রাসী দলের আন্তর্জাতিক গেরিলা কৌশল ও সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার নেহাত ঘটনা চক্রের সংঘটন নয়। তাই বৃহত্তর তদন্ত প্রয়োজন এই ট্রেন হাইজ্যাককে ঘিরে উত্থাপিত অভিযোগ অনুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখতে।
