বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রায় কাটছাঁট


বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বমুখীর প্রভাবে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। অতিরিক্ত ব্যয়ের চাহিদা মেটাতে গিয়ে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আইএমএফ’র মানদণ্ডের হিসাবে এরই মধ্যে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন (দুহাজার কোটি) মার্কিন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। আবার ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে হামলার ঘটনায় জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে নতুন করে রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হতে পারে। এতে চলতি অর্থবছরে ৩০ বিলিয়নের রিজার্ভ গড়ে তোলার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় লক্ষ্যমাত্রা ৯০ কোটি ডলার কাটছাঁট করে ২৯১০ কোটি ডলারে নামিয়ে আনা হয়। সংশোধিত এ লক্ষ্যমাত্রার অনুমোদন দেওয়া হয় আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিয়ম হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেন্স কাউন্সিল বৈঠকে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। ওই বৈঠকে অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি। আগামীতে রিজার্ভের অবস্থা কেমন যাবে সেটিও আলোচনায় আসে। রিজার্ভ কমে যাওয়া প্রসঙ্গে বৈঠকে অর্থ সচিব মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার বলেন, উন্নত দেশের সুদের হার বৃদ্ধিও একটি কারণ। এছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রিজার্ভ হ্রাস পেয়েছে। তবে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হিসাব দিয়ে তিনি বলেন, গ্রস রিজার্ভ যা আছে তা দিয়ে আগামী ৪.৬ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। রিজার্ভের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাকেও উচ্চাভিলাষী বলে মন্তব্য করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরী। তিনি জানান, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বড় চ্যালেঞ্জ হবে। তবে অর্জন করতে পারলে সেটি ভালো। এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বিগত এক বছরে রিজার্ভ খুব বেশি বাড়াতে সক্ষম হয়নি। ২০-২৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অবস্থান করেছে। এখন ইরান-ইসরাইলসহ বিশ্ব পরিস্থিতি মাথায় রাখতে হবে। কারণ যুদ্ধ পরিস্থিতি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ কতটা খারাপের দিকে যাচ্ছে সেটি দেখার বিষয়। এটি বিশ্ব অর্থনীতি পরিস্থিতিকে খারাপের দিকে নিতে পারে। এতে জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্য আমদানি ব্যয় বাড়তে পারে। যা রিজার্ভকে আবারও চাপের মুখে ফেলতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগদ তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারিতে গ্রস রিজার্ভের অঙ্ক ২৫ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন (২৫৯৭ কোটি) মার্কিন ডলার ছিল। গত ১৭ এপ্রিল তা ২৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ( ২৫৩০ কোটি) ডলারে নেমে আসে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ১৯ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৯৮৯ কোটি ডলারে নেমেছে। এরই মধ্যে ইরান ও ইসরাইলের হামলার ঘটনায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও স্বর্ণের দাম বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক ব্রেন্ট ক্রুডে তেলের দাম ১.৮ বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৮৭.৩৯ (রোববার হিসাবে) ডলার হয়। এ মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে উসকে দেবে। এতে দেশের আমদানি ব্যয় বাড়বে। যা শেষ পর্যন্ত রিজার্ভের ওপর গিয়ে পড়বে। কারণ ব্যাংকগুলো বিশেষ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা আমদানি দায় পরিশোধের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে মার্কিন ডলার সহায়তা নিচ্ছে। এতে ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ কমছে। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বৃদ্ধির দুটি প্রধান উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয় প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) রপ্তানি আয় হয় ৪৩ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মাত্র ৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেশি। একই সময়ে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৭.০৭ বিলিয়ন (১৭০৭ কোটি) ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬.০৩ বিলিয়ন (১৬০৩ কোটি) ডলার। এছাড়া অন্যান্য উদ্যোগের পরও রিজার্ভ বাড়ছে না। এমন পরিস্থিতিতে আইএমএফ থেকে সরকার ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ নিয়েছে। এই ঋণের দুটি কিস্তি ইতোমধ্যে পেয়েছে সরকার। রিজার্ভ ধরে রাখার জন্য পণ্য আমদানির ওপর দেওয়া বিধিনিষেধ এখনো বহাল রাখা হয়েছে। তবে বিধিনিষেধ সত্ত্বেও আমদানি ব্যয় এখনো উচ্চ পর্যায়ে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে আমদানি বিগত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ কমেছে। এতে আমদানি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪০ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারে। রিজার্ভ হিসাবের দুটি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। একটি হচ্ছে গ্রস, অন্যটি নিট হিসাব। কিন্তু ঋণের শর্ত হিসাবে আইএমএফ রিজার্ভ হিসাব করার জন্য বিপিএম৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) নামে একটি নীতিমালা জারি করে। এ পদ্ধতিতে হিসাব করলে বৈদেশিক সম্পদ গণনায় সব বৈদেশিক দায় ও ঋণ এবং রিজার্ভের অর্থ অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করলে তা মূল রিজার্ভ থেকে বাদ যাবে। জানা গেছে, দেশের রিজার্ভের অর্থে ৭ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল গঠন ছাড়াও একাধিক তহবিল পরিচালনা করা হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রায় ইডিএফ ছাড়াও আরও দুটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। আইএমএফ’র হিসাব পদ্ধতি মানলে এই ৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারও রিজার্ভ থেকে বাদ দিতে হবে।