ভয়াবহ সংকটে ছয় বিশেষায়িত ব্যাংক


ভয়াবহ সংকটে ছয় বিশেষায়িত ব্যাংক
ভয়াবহ সংকটে পড়েছে দেশের ছয়টি বিশেষায়িত ব্যাংক। অস্বাভাবিকভাবে খেলাপি ঋণ এবং মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় মূলত এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটির ঘাটতির অঙ্ক ঋণাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। শুধু তাই নয়, ঋণ বিতরণের অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিকনির্দেশনা। তবে অর্থ আদায়ে খেলাপিদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করলেও তা আটকে যাচ্ছে রিটের কারণে। সবমিলিয়ে গভীর উদ্বেগ, হতাশা ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে স্বয়ং সরকারের সংশ্লিষ্টরা।সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে বিশেষায়িত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) বৈঠকে উঠে এসেছে এসব তথ্য। ব্যাংকগুলো হচ্ছে-বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, বিএইচবিএফসি ব্যাংক ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক।ওই বৈঠকে পরিস্থিতি উত্তরণে খেলাপিদের তালিকা প্রস্তুতসহ শ্রেণিকৃত ঋণ কমিয়ে আনতে নতুন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনায় খেলাপিদের এবং অবলোপনকৃত খাত থেকে অর্থ আদায়সহ মূলধন ঘাটতি কমিয়ে আনার কথা বলা হয়। এছাড়া কর্ম-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রতিবেদন প্রতি তিন মাস অন্তর অর্থ বিভাগে দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ব্যাংক এমডিদের।বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর অবস্থা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়) ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী জানান, ব্যাংকের ফাংশনগুলো ঠিকমতো কাজ না করার কারণে এমন অবস্থা হয়েছে। ব্যাংকগুলো তাদের লক্ষ্য অনুযায়ী বিগত সময়ে কাজ করেনি। তবে ব্যাংকের বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর দেখেন। বিশেষায়িত ব্যাংকের পরিস্থিতি সম্পর্কে গভর্নরকে অবহিত করা হবে বলে তিনি জানান।এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ব্যাংক খাতের বিপর্যয়ের চিত্র উঠে আসে। যা এতদিন গোপন রাখা হয়েছিল। ব্যাংক খাতে ঋণের নামে লুটপাট, খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, আমানতের টাকা বিদেশে পাচারের মাধ্যমে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রায় শূন্য করে দিয়েছে দুর্নীতিবাজ কতিপয় ব্যবসায়ী। যারা দীর্ঘদিন বিগত সরকারের আশ্রয়ে প্রভাবশালী হিসাবে খ্যাত ছিলেন। এর পাশাপাশি বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর দুরবস্থার চিত্র উঠে আসে অর্থ বিভাগের পর্যালোচনায়।অবশ্য এর আগে ব্যাংক খাতে এ নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ একাধিকবার বলেছেন, ব্যাংকের আমানতের ৮০ ভাগ তুলে নিয়ে বিদেশে পাচার করার মতো ঘটনা বিশ্বের কোনো দেশে নেই। ফলে ব্যাংকগুলো বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।ওই বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, মার্চ পর্যন্ত বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে শ্রেণিকৃত ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ৬ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা ছিল, আর ২০২৩ সালের জুনে এ অঙ্ক ছিল ৯ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা।বৈঠকে খেলাপি ঋণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) সচিব নাজমা মোবারেক বলেন, ‘শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ক্রমশই বৃদ্ধি পেয়েছে যা অত্যন্ত অসন্তোষজনক। শ্রেণিকতৃ ঋণ হ্রাসকরণের লক্ষ্যে ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রস্তুতপূর্বক একটি কর্মপরিকল্পনা রোডম্যাপ প্রস্তুত করতে হবে এবং সে অনুযায়ী আদায় কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন।’এদিকে ঋণ পুনঃতফশিলিকরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রজ্ঞাপনটি নতুন করে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণকে বাড়িয়ে দিতে পারে বলে বৈঠকে আশঙ্কা প্রকাশ করেন কর্মসংস্থান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অরুন কুমার চৌধুরী। তিনি বলেন, ঋণ পুনঃতফশিলিকরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। সেখানে রিশিডিউলের সময়কাল হ্রাস করা হয়েছে। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে এ শঙ্কার কথা তুলে ধরে বিভিন্ন ব্যাংক অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংককে।এদিকে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বেড়েছে। কোনো কোনো ব্যাংকের ঘাটতি ঋণাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। মূলধন ঘাটতি সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ঋণাত্মক। মার্চ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা। এর আগে ২০২৪ সালে একই সময়ে ঘাটতির অঙ্ক ছিল ১৪ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। একই ভাবে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মার্চ পর্যন্ত ২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। এ ঘাটতি আগের বছর একই সময়ে ছিল ২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা।মূলধন ঘাটতি পরিস্থিতি নিয়ে ওই বৈঠকে হতাশাজনক উল্লেখ করে দুটি ব্যাংকের ঘাটতি দূর করতে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সঞ্চিয়া বিনতে আলী জানান, ব্যাংকের সম্পদের পরিমাণ ও গুণগত মান দুটোই কমে যাওয়ায় পারফর্মিং লোন কমেছে। তবে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াহিদা বেগম জানান ঋণ আদায়ের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে ২০০৩ এর পুনর্গঠন ও সংশোধনের কাজটি প্রক্রিয়াধীন আছে।এদিকে খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে সফলতা নেই ব্যাংকগুলোর। আদায়ের অঙ্ক খুবই সামান্য। যা পর্যালোচনা করে অনেকটা হতাশা প্রকাশ করেছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব। তিনি শীর্ষ ২০টি খেলাপির কাছ থেকে অর্থ আদায় করা, ঋণগ্রহীতার জামানত সম্পত্তির সঙ্গে অন্যান্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি অন্তর্ভুক্ত করে বিক্রয়ের লক্ষ্যে দ্রুত আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়।রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াহিদা বেগম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সার্কুলার আছে যেখানে সব প্রকার কৃষি ঋণের সুদসহ মূল ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হলে সে ঋণের ওপর সুদ ধার্য করা যাবে না। এ প্রজ্ঞাপনের পর অনেকে ঋণ পরিশোধ করছেন না। কারণ তারা জানে ঋণ পরিশোধ না করলে সার্কুলার অনুযায়ী দ্বিগুণের পর আর সুদ আরোপ হবে না। দ্বিগুণের বেশি আদায় করতে পারবে বিধায় ঋণ আদায় কম হয়। এছাড়া অবলোপনকৃত ঋণের বিপরীতে নগদ আদায়ের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আদায় না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয় ওই বৈঠকে। অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি কর্মপরিকল্পনা/রোডম্যাপ তৈরি এবং সে অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করতে বলা হয়।