মানুষই এখন অতিমানব


‘অতিমানব’ হওয়া মানে এমন ক্ষমতা বা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, যা মানুষের স্বাভাবিক সীমা অতিক্রম করে। এই ধারণা বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিবেচিত হতে পারে। যেমন—শারীরিক ক্ষমতা। কোনো ব্যক্তি অসাধারণ শক্তি, গতি, সহনশীলতা বা তৎপরতা প্রদর্শন করতে পারে।

জ্ঞানগত ক্ষমতাও অতিমানব ধারণাটিকে সামনে টেনে আনে। কেউ হয়তো বুদ্ধিমত্তা, স্মৃতিশক্তি বা সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়িয়েছে, যা সাধারণ মানুষের ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে গেছে; তখন আমরা বিষয়টি বর্ণনার ক্ষেত্রে অতিমানব ধারণাটি ব্যবহার করি। চোখ-ধাঁধানো প্রযুক্তিগত উন্নয়নকেও আমরা অতিমানবিক বলে থাকি। যেমন—জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, সাইবারনেটিকস বা উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যা মানুষের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

আবার ব্যতিক্রমী নৈতিক গুণাবলির অধিকারী, যেমন—করুণা, সহানুভূতি বা পরার্থপরতা, যা অন্যদের অনুপ্রাণিত করে; এমন গুণ কারো কাছে দেখলে আমরা তখন বলি ‘অতিমানবিক গুণ’। এ ছাড়া বিভিন্ন সংস্কৃতি, পৌরাণিক কাহিনি ও ধর্মে অতিমানবীয় কিছু ব্যক্তিত্বকে চিত্রিত করা হয়েছে, যাঁদের মানুষ অতিমানব হিসেবে শ্রদ্ধাভক্তি করে। সোজা কথায় ‘অতিমানব’ শব্দটি শারীরিক, মানসিক বা নৈতিকভাবে সাধারণ মানুষের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার ধারণাটিকে ফুটিয়ে তোলে।
দার্শনিকরা মনে করেন, ভৌতজগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও উন্নত প্রাণী হিসেবে মানুষ যদি তার বিবর্তনের ধারাবাহিকতা, অগ্রগতি ও টিকে থাকাকে ধরে রাখতে চায়, তাহলে তার নিজের শারীরিক-মানসিক সত্তাকে নতুন রূপে, নতুন করে গড়ে নিতে হবে—তার নিজের আবিষ্কার করা বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক জ্ঞান-প্রকৌশল কাজে লাগিয়ে।

তবে সাধারণভাবে ‘অতিমানব’ অভিধাটি সায়েন্স ফিকশনের কাল্পনিক চরিত্র বা নতুন প্রজন্মের রোবটের চোখ-ধাঁধানো দক্ষতা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু হালে গবেষকরা বলছেন, সায়েন্স ফিকশন বা রোবট কেন অতিমানব হতে যাবে? বরং প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশই মানুষকে আজ ‘অতিমানব’ বানিয়ে দিচ্ছে। তাঁরা যুক্তি হিসেবে বলছেন, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে চিকিৎসাবিজ্ঞান মানব অঙ্গ প্রতিস্থাপনের যে ধারণা তুলে ধরেছিল, সেটা আজ অতি সাধারণ ঘটনা।

পঞ্চাশের দশকে যখন পেসমেকার বা কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড তৈরি হলো, তখনো এটার প্রতিস্থাপন ছিল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো। কিন্তু এখন পেসমেকার বসানো পুরনো ফোর্ড গাড়ির ওয়াটার পাম্প পাল্টানোর মতোই সহজ ব্যাপার।

চারপাশে চোখ বুলালেই বুঝতে পারবেন, প্রযুক্তির আশীর্বাদে বধির লোকও এখন শুনতে পায়। আর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী চোখে দেখার অনুভূতি পায়। বলা যায়, বর্তমানে মেডিক্যাল প্রযুক্তি সায়েন্স ফিকশনের মতোই। কারণ গাড়ির পুরনো পার্টস পাল্টানোর মতোই মানুষ একদিন অকেজো যেকোনো অঙ্গ পাল্টে নিতে পারবে। তবে গবেষকরা বলছেন, আগামী দিনে মানুষের জন্য বেশ কয়েকটি চমক অপেক্ষা করছে, যা মানুষকে চূড়ান্ত অর্থে অতিমানব বানিয়ে দেবে।
ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেসের কথাই ভাবুন। এটা সংক্ষেপে বিসিআই নামে পরিচিত। মানব মস্তিষ্কের সঙ্গে বাইরের কোনো ডিভাইসের সংযোগ ও লেনদেনই বিসিআই। কয়েক দশক ধরে বিসিআই ধারণাটি সায়েন্স ফিকশনগুলোতে জীবন্ত হয়ে আছে। ১৯২০-এর দশকেই মানুষ জেনে যায়, মানব মস্তিষ্ক থেকে এক ধরনের সিগন্যাল বের হয়। সংগত কারণে এটা অন্য কোনো ডিভাইসের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে সক্ষম। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা বিসিআই প্রযুক্তিকে বাস্তবতার ছোঁয়া দিতে যাচ্ছেন।

ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস হলো এমন ডিভাইস, যা লাগানো থাকবে ব্যবহারকারীর শরীরে (মূলত মস্তিষ্কে) এবং এটি ব্যবহারকারীকে একটি কম্পিউটারের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করিয়ে দেবে। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা শুধু তাদের মস্তিষ্কের সংকেত ব্যবহার করে কম্পিউটারের বিভিন্ন কমান্ড দিতে পারবে, অর্থাৎ শুধু মস্তিষ্ক ব্যবহার করেই কম্পিউটারে বিভিন্ন কাজ করতে পারবে। এখানেই শেষ নয়, ভবিষ্যতের উন্নত ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেসের সাহায্যে দৃষ্টিশক্তি নেই এমন কাউকে ক্যামেরার সাহায্যে প্রাপ্ত দৃশ্যের বিস্তারিত তথ্য সরাসরি ব্রেনে প্রবেশ করিয়ে দিলেই মানুষটি সাধারণ মানুষের মতো দেখতে পারবে।

মার্কিন কম্পিউটারবিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তি নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী রে কার্জউইল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০৫ সালে তিনি ‘দ্য সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ার’ নামের একটি বই লেখেন। বইটিতে তিনি দাবি করেন, ২০২৯ সালের মধ্যে কম্পিউটার মানবস্তরের বুদ্ধিমত্তায় পৌঁছে যাবে। বইটিতে কার্জউইল ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ‘২০৪৫ সালের দিকে আমরা কম্পিউটারের সঙ্গে একত্র হয়ে অতিমানব হয়ে উঠব।’ তিনি একে ‘দ্য সিঙ্গুলারিটি’ বলেছেন।

সিঙ্গুলারিটি মূলত এক ধরনের রূপক, যা পদার্থবিদ্যা থেকে নেওয়া। আমাদের মস্তিষ্ক যখন ক্লাউডের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন সিঙ্গুলারিটি তৈরি হয়। আমাদের প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা ও আমাদের সাইবারনেটিক বুদ্ধিমত্তার সংমিশ্রণ হতে যাচ্ছে এবং উভয়ই একটিতে পরিণত হবে। এটাকে সম্ভব করতে তৈরি হচ্ছে ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস, যা মূলত এক ধরনের ন্যানোবটস বা রোবট আকৃতির কণা। এসব কণা মস্তিষ্কের কোনো ক্ষতি ছাড়াই সূক্ষ্ম রক্তনালি দিয়ে মস্তিষ্কে ঢুকবে। ২০৪৫ সাল নাগাদ আমরা আমাদের বুদ্ধিমত্তা কয়েক লাখ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে নিতে পারব। এটা আমাদের সচেতনতা ও চেতনাকে আরো গভীর করতে চলেছে।

এ ছাড়া মানুষকে জন্ম থেকে অতিমানব হয়ে ওঠার পথ দেখাতে চাইছে জিন প্রকৌশল। বলা হচ্ছে, চ্যাটজিপিটি-৪ও মানুষকে অতিমানব বানিয়ে ফেলতে পারে।