মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন ভারতের ওপরে ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন, তখন এ কথা বলা হচ্ছিল যে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল না কেনার জন্য বাধ্য করতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হলো।
মার্কিন সেনেটর লিণ্ডসে গ্রাহাম তো এও বলেছিলেন, ‘রাশিয়ার তেল কিনে ভারত ভ্লাদিমির পুতিনের সমরসজ্জাকে উৎসাহ দিচ্ছে।’
তবে এটাই প্রথমবার নয় যখন আমেরিকা ভারতের নীতিমালা প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।
ভারত যখন দ্বিতীয়বার পরমাণু বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফারণ ঘটায় ১৯৯৮ সালে, তখন আমেরিকা ভারতেও ওপরে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার ঘোষণা দিয়েছিল।
ভারতের পারমাণবিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত কূটনীতিক টিপি শ্রীনিবাসন এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘ক্লিনটন ওয়াশিংটনের ভারতীয় দূতাবাসে রীতিমতো হুমকির সুরে এক বার্তা পাঠিয়েছিলেন : ‘আমি বার্লিন যাচ্ছি। সেখানে পৌঁছতে আমার ছয় ঘণ্টা লাগবে। যদি ততক্ষণে ভারত সরকার বিনা শর্তে সিটিবিটি-তে সই না করে তাহলে আমি বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করব।’
সিটিবিটি হল কম্প্রিহেনসিভ টেস্ট ব্যান ট্রিটি।
‘প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত নরেশ চন্দ্রকে জানানো হয় যাতে তিনি পরের দিন দুপুর পর্যন্ত কোনও প্রতিক্রিয়া না দেন, যতক্ষণে পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফারণের বাকি অংশের কাজ শেষ না করা হচ্ছে,’ বলেছিলেন শ্রীনিবাসন।
ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘১৩ই মে সরকার ঘোষণা করল যে এখন থেকে আর কোনও পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফারণ ঘটানো হবে না এবং সিটিবিটি-এত সই করতে সরকার রাজি।’
বেশ কয়েকদিন ধরে পর্দার আড়ালে চলতে থাকা কূটনীতি এবং যশবন্ত সিং-স্ট্রোব ট্যালবটের মধ্যে বেশ কয়েকবার বৈঠকের পরে আমেরিকাকে ভারত নিজেদের পক্ষে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়।
ইরাকের ওপরে মার্কিন হামলায় ‘ধর্মসংকটে’ ভারত
অটল বিহারী বাজপেয়ীর বাসভবন, দিল্লির সাত নম্বর রেস কোর্স রোডে ২০০৩ সালের হোলির প্রস্তুতি শেষ। বাইরের লনে অনেক মন্ত্রী এবং তার চেনাশোনা মানুষ ঘিরে রয়েছেন বাজপেয়ীকে। কেউ তার মাথায় একটা পাগড়ি পরিয়ে দিয়েছিলেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী যশবন্ত সিনহা সব প্রথা ভেঙ্গে ঢোলের তালে তালে একটা হোলির গান ধরেছেন।
সকলের অনুরোধে মি. বাজপেয়ীও হাত-পা নেড়ে নাচার চেষ্টা করছিলেন। ততদিনে প্রধানমন্ত্রীর পদে তিনি পাঁচ বছর কাটিয়ে ফেলেছেন, ৭৯টি বসন্ত পেরিয়ে এসেছেন তিনি। কিছুটা ধীরে সুস্থে চলাফেরা করেন, কিন্তু ভাজাভুজি খাবার আর চিনি খাওয়া ছেড়ে দিয়ে ওজন প্রায় চার কিলোগ্রাম কমিয়ে ফেলেছেন তিনি। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর দেখাচ্ছিল তাকে।
সম্প্রতি প্রকাশিত তার বই ‘বিলিভার্স ডিলেমা’তে লেখক অভিষেক চৌধুরী লিখেছেন, ‘বাজপেয়ী কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করতে চাইছিলেন, কিন্তু ইরাকের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের হামলা সম্ভাবনা ওই প্রচেষ্টায় জল ঢেলে দিতে বসেছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইরাকের কথিত ওয়েপন অফ মাস ডেস্ট্রাকশন বা গণবিধ্বংসী অস্ত্র থেকে নিজের দেশকে বাঁচাতে চাইছিলেন।’
‘গোড়ার দিকে মি. বুশকে অটল বিহারী বাজপেয়ী অনুরোধ করেছিলেন যাতে জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে নিয়ে ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্র নষ্ট করে ফেলা হয়,’ লিখেছেন চৌধুরী।
যুদ্ধ কি আদৌ উচিত? ভারতের আশংকা জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকরা ইরাকে তিনশো জায়গায় পর্যবেক্ষণ চালিয়েছিলেন, কিন্তু গণবিধ্বংসী অস্ত্রের কোনও প্রমাণ তারা পান নি। তা সত্ত্বেও বুশের উদ্দেশ্যের খামতি দেখা যাচ্ছিল না।
প্রাক্তন মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার তো রাখঢাক না করেই বলেছিলেন, ‘তালিবানকে ক্ষমতা থেকে সরানোটাই যথেষ্ট নয়। শুধু এতেই ইসলামি চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার যে মার্কিন উদ্দেশ্য, পুরোপুরি মেটে নি।’
তবে, বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ এটিকে অনর্থক লড়াই বলে মনে করেছিল। এই লড়াইয়ের আদৌ প্রয়োজন নেই এবং পুরো ভাষ্যটাই ভুল গোয়েন্দা তথ্যের ওপরে ভিত্তে করে গড়ে তোলা হয়েছে।
অভিষেক চৌধুরী লিখেছেন, ‘এই যুদ্ধের ফলে ভারতের লাভে থেকে ক্ষতিই বেশি হওয়ার কথা, কারণ উপসাগরীয় অঞ্চলের তেলের ওপরে দেশ পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল আর নির্বাচনের বছরে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি যে কোনও সরকারের কাছেই খুশির খবর বহন করে আনে না।
‘এই সংকটের ফলে তেলের ব্যাপারে কূটনীতির গুরুত্ব সরকার অনুধাবন করতে পেরেছিল। আর তারই ফলস্বরূপ হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম আর ভারত পেট্রোলিয়ামের বেসরকারিকরণ বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। তাদের বড় চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছিল উপসাগরীয় দেশগুলোতে কর্মরত ৪০ লক্ষ ভারতীয়কে কীভাবে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়,’ লিখেছেন চৌধুরী।
তিনি আরও লিখেছেন, ‘গুজরাত দাঙ্গার পর থেকে ভারতের মুসলমানরা বাগদাদকে কব্জা করার মার্কিন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে জোরেশোরে প্রতিবাদ করছিলেন এবং সেই ক্ষোভ বেশ খোলাখুলিই প্রকাশ করছিলেন।’
আমেরিকা ব্যাপক সমর্থন পায়নি
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটা প্রস্তাব নিয়ে আসে, যেখানে দাবি করা হয় যে ইরাক যেন ১৭ই মার্চের মধ্যে তার সব গণবিধ্বংসী অস্ত্র হস্তান্তর করে দেয়।
জিন এডওয়ার্ড স্মিথ তার বই ‘বুশ’-এ লিখেছেন, ‘যেদিন ওই প্রস্তাবের ওপরে ভোটাভুটি হওয়ার কথা, সেদিনই আমেরিকা ওই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়, কারণ তাদের ভয় ছিল যে ভোট হলে তারা হেরে যাবে। দুদিন পরে বুশ ইরাকের ওপরে হামলা শুরু করেন।’
‘নিজেকে তিনি এমনভাবে তুলে ধরেছিলেন যেন তিনিই ঈশ্বরের ইচ্ছা পূরণ করছেন, যিনি ইরাকের একনায়কতন্ত্রকে সরিয়ে পশ্চিমা দেশগুলির মতো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু বেশ কয়েকটি দেশ ইরাকের বিরুদ্ধে মার্কিন যুদ্ধে সামিল হতে অস্বীকার করে,’ লেখা হয়েছে ওই বইটিতে।
ভারতের সংসদে মার্কিন হামলার \'নিন্দা\'
মার্কিন হামলার আগেই ভারতের সংসদে সরকারের ওপরে চাপ তৈরি হয় যাতে স্পষ্টভাবে এটা বলা হয় যে ‘কোনও দেশে রাষ্ট্রক্ষমতা বদলের জন্য পরাশক্তি তার শক্তি ব্যবহার করবে – এটা ভুল এবং এই নীতি সমর্থন করা যায় না।’
এরপরেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতি জারি করে বলে, ‘ইরাকে যে সামরিক কর্মকাণ্ড চলছে, তাকে উচিত বলে মেনে নেওয়া যায় না।’
পরের দিন বুশ অটল বিহারী বাজপেয়ীকে ফোন করে অনুরোধ করেন যে ভারত যেন তার বিরোধিতার সুর কিছুটা নরম করে।
প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী যশবন্ত সিনহা তার আত্মজীবনী \'রিলেন্টলেস\'-এ লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাকে হামলা করল তখন ভারতে সংসদের অধিবেশন চলছিল। কংগ্রেস দল বিশ্বকে দেখাতে চাইছিল যে তারা আমেরিকা-বিরোধী। তাই তারা জোর দিচ্ছিল যাতে সংসদ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এই কর্মকাণ্ডের নিন্দা করা হয়, নাহলে সংসদ চলতে দেবে না তারা।
‘ব্যক্তিগতভাবে আমি এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিলাম। তবে আমি যে ইরাকে মার্কিন কর্মকাণ্ডের সমর্থন করছিলাম, তা নয়। তবে সংসদে এধরণের প্রস্তাবের ফলে সরকারের নীতি প্রণয়নের নমনীয়তার সুযোগ করে যায়,’ লিখেছেন সিনহা।
তার ভাষায়, ‘পরে, সংসদ যাতে চলতে পারে, সেজন্য আমরা প্রস্তাবটা পাশ করি যেখানে হিন্দি শব্দ \'নিন্দা\' কথাটার উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ইংরেজিতে ব্যবহার করা হয়েছিল \'ডিপ্লোর\' শব্দটা। এই শব্দটার ধার \'নিন্দা\'র থেকে কিছুটা কম।’
ইরাকে ভারতীয় সেনা পাঠানোর অনুরোধ আমেরিকার
ভারত-মার্কিন সম্পর্কে আরও একটা সমস্যা সামনে এসেছিল সেই সময়ে। মে মাসে ওয়াশিংটন সফরে গিয়েছিলেন তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র। তখন আমেরিকা তাকে অনুরোধ করে যে যুদ্ধের পরে পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে যে বাহিনী যাবে ইরাকে, তার মধ্যে যেন যে ভারতও তাদের সেনা পাঠায়।
মিশ্র এর পক্ষেই ছিলেন। এর আগে ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদ’-এর সঙ্গে লড়াই করতে ভারত-আমেরিকা-ইসরায়েল জোটের পক্ষে সরব ছিলেন।
লাল কৃষ্ণ আদভানি যখন ২০০৩ সালের জুন মাসে আমেরিকা যান, তখন তিনিও মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে ভারত সেনা পাঠাতে ইচ্ছুক।
আসলে আমেরিকা চাইছিল যে ভারত আর পাকিস্তান দুই দেশই ওই \'শান্তি সেনাবাহিনী\'তে নিজেদের সৈন্য পাঠাক। ভারতকে বলা হয়েছিল যে উত্তর ইরাকে প্রশাসন চালানোর জন্য একটা পুরো ডিভিশন সেনা যাতে পাঠানো হয়।
অভিষেক চৌধুরী লিখেছেন, ‘ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের একটা অংশ চাইছিল যে ভারত এই প্রস্তাব মেনে নিক, কারণ তাহলে ভারত-মার্কিন সম্পর্কে নাটকীয় পরিবর্তন আসবে। প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছিল।
‘ভারতে মার্কিন দূতাবাস বিবৃতি জারি করে জানিয়েছিল যে শান্তি সেনাবাহিনীতে ভারত যোগ দিক, এটাই আমেরিকার ইচ্ছা, কারণ শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে, তাদের ভাবমূর্তিও পরিষ্কার এবং তাদের যথেষ্ট সংখ্যক সেনা রয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী যেসব ইউনিটকে এই মিশনে পাঠাবে তার তালিকাও তৈরি করে ফেলেছে,’ লিখেছেন চৌধুরী।
মার্কিন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বাজপেয়ী
সেই সময়ে পাকিস্তানে ভারতের রাষ্ট্রদূত শিবশঙ্কর মেনন, যিনি আবার পরে পররাষ্ট্র সচিবও হয়েছিলেন, তিনি অনেক পরে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘যশবন্ত সিং আর ব্রজেশ মিশ্র ছাড়া মি. আদভানি আর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসাররাও ইরাকে ভারতীয় সৈন্য পাঠানোর পক্ষে ছিলেন। আমেরিকা-বিরোধী জর্জ ফার্ণান্ডেজ প্রকাশ্যে এই প্রস্তাবের সমর্থন তো করেন নি, কিন্তু সেনাবাহিনীকে এর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করার অনুমতি দিয়েছিলেন।’
কিন্তু বাজপেয়ী এ ব্যাপারে কোনও নিশ্চিত অবস্থান নেন নি। এধরণের যে কোনও পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বাজপেয়ীকে একটা চিঠি লিখেছিলেন সোনিয়া গান্ধী।
যশবন্ত সিনহা লিখেছেন, সঙ্গে সঙ্গেই বাজপেয়ী সোনিয়া গান্ধীকে বৈঠকের জন্য ডাকলেন। প্রণব মুখার্জী, মনমোহন সিং আর নটবর সিংকে সঙ্গে নিয়ে সোনিয়া গান্ধী তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বাজপেয়ী খুব মন দিয়ে তাদের বক্তব্য শুনলেন। এনডিএ জোটে তার সহযোগী দলগুলোর সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলেন তিনি।
বেশিরভাগ মানুষই ইরাকে ভারতীয় সৈন্য পাঠানোর পক্ষে ছিলেন না। এমনকি চিকিৎসকদের টিম পাঠানোরও বিরোধিতা হচ্ছিল। এটা বাজপেয়ীর কাজের ধরণ। তিনি সবার মতামত শুনলেন, কিন্তু শেষমেশ সেটাই করলেন, যেটা দেশের স্বার্থের পক্ষে ঠিক। তার মত ছিল নিজের কাছের মানুষদের মতামত এড়িয়ে যাওয়ার সবথেকে ভাল উপায় হল সেই মতের বিরুদ্ধে একটা মত গড়ে তোলা,’ লিখেছেন মি. সিনহা।
সৈন্য না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল সরকার
ইরাকে ভারতীয় বাহিনী পাঠানোর ব্যাপারে অটল বিহারী বাজপেয়ী অন্যান্য দলের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন। তিনি কমিউনিস্টদের খুব সুচারুভাবে উস্কাচ্ছিলেন যাতে তারা বাহিনী পাঠানোর বিপক্ষে জোরেশোরে বিরোধিতা করে।
মন্ত্রীসভার নিরাপত্তা সংক্রান্ত কমিটি বা সিসিএস-এর বৈঠকের বিবরণ একটি সাক্ষাতকারে শুনিয়েছিলেন শিবশঙ্কর মেনন।
তিনি বলেছিলেন, ‘বৈঠকে আদভানি চুপ করে ছিলেন। বাজপেয়ী তার কাছে জানতে চান যে আপনি কি ভাবছেন? সবাই ভারতীয় সেনাবাহিনী পাঠানোর পক্ষেই মতামত দিচ্ছিলেন। বাজপেয়ী চুপ করেই ছিলেন। তিনি একটা শব্দও উচ্চারণ করেন নি। এরপরে বৈঠকে সবাই নিশ্চুপ হয়ে যান।
‘বাজপেয়ী ওই নিস্তব্ধতা আরও কিছুক্ষণ চলতে দিলেন। তারপরে বললেন, ‘এই অভিযানে যারা মারা যাবেন, সেইসব সন্তানের মায়েদের আমি কী জবাব দেব?’ বৈঠকে আবারও নিস্তব্ধতা। বাজপেয়ী সেই নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বললেন, ‘না, আমরা আমাদের ছেলেদের ওখানে পাঠাতে পারব না।’
বন্ধুত্ব, তবুও স্বাধীন বিদেশ-নীতি
জুলাই পর্যন্ত ভারত আমেরিকাকে বলে আসছিল যে ইরাকে সেনা পাঠানোর ব্যাপার নিয়ে জাতিসংঘের সমর্থন নেওয়া উচিত। কিন্তু সেটা সম্ভব হয় নি। বাজপেয়ী তখন ওই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যুক্তি দিলেন যে তার হাত-পা বাঁধা।
বছরের শেষে যখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে ইরাকে কোনও গণবিধ্বংসী অস্ত্র নেই, তখন মি. বাজপেয়ী প্রথমবার জনসমক্ষে বলেন, ‘আমরা চাই নি যে আমাদের সেনাসদস্যরা একটি বন্ধু দেশে গিয়ে গুলির নিশানা হয়ে উঠুক।’
যশবন্ত সিনহা লিখেছেন, ‘আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতি করতে চান না বাজপেয়ী, এমনটা নয়। কিন্তু তিনি এটা কিছুতেই চাইতেন না যে আমেরিকার প্রতিটা কথাই ভারত মেনে নিক। তার কাছে সম্পর্ক হবে সমানে-সমানে, পারস্পরিকভাবে এবং একে অপরকে সম্মান করবে।
\"কার্গিল যুদ্ধের সময়ে বিল ক্লিন্টন যখন বাজপেয়ী আর নওয়াজ শরিফকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানালেন, তখন বাজপেয়ী এই যুক্তি দেখিয়ে এড়িয়ে যান যে যতক্ষণ পাকিস্তানের একজন সৈনিকও ভারতের মাটিতে থাকবে, ততক্ষণ আমেরিকা যাব না,’ লিখেছেন সিনহা।
সিকিম নিয়ে চীনের চাপ সামলিয়েছেন যেভাবে
একইভাবে একবার চীনের চাপও সামলাতে হয়েছে ভারতকে। অটল বিহারী বাজপেয়ী ২০০৩ সালের জুলাই মাসে চীন সফরে গিয়েছিলেন। আলোচনার তালিকায় সবথেকে ওপরে ছিল বাণিজ্যের জন্য নাথু লা উন্মুক্ত করার বিষয়টি।
তবে নাথু লা গিরিপথ যে সিকিম, অর্থাৎ ভারতের অংশ, তা মেনে নিতে চায় নি চীন। ব্রজেশ মিশ্র থেকে শুরু করে অন্য ভারতীয় কূটনীতিকরা চীনকে রাজি করানোর জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তারা সফল হন নি।
অভিষেক চৌধুরী লিখেছেন, ‘সমস্যার সমাধান করতে বাজপেয়ী যৌথ বিবৃতিতে সই করে দিলেন, যেটা আবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিসারদের পছন্দ হয় নি। যখন সংবাদ মাধ্যম তার কাছে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করল, তখন তিনি এটা মানতে অস্বীকার করেন যে তিনি ভারতের স্বার্থের সঙ্গে আপস করেছেন।
‘দুটি দেশ একে অন্যের উদ্দেশ্য নিয়ে শঙ্কিত ঠিকই। সীমান্তের অন্যান্য এলাকায় বিবাদ চলতে থাকলেও চীন কিন্তু খুব দ্রুতই সিকিমকে ভারতের অংশ বলে দেখাতে শুরু করল,’ লিখেছেন চৌধুরী।
পাকিস্তান নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান
জানুয়ারি ২০০৪ সালে ঘোষণা হয় যে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে সার্ক সম্মেলন হবে। অটল বিহারী বাজপেয়ী ইঙ্গিত দেন যে তিনি ওই সম্মেলনে যোগ দিতে চান। তবে শর্ত একটাই, সীমান্ত-পারের ‘সন্ত্রাসবাদ’ শেষ করার প্রতি নিজেদের অঙ্গীকার আনুষ্ঠানিকভাবে জানাক পাকিস্তান।
পাকিস্তানে প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শিবশঙ্কর মেনন বলেছিলেন, ‘মুশাররফ জানতেন যে বাজপেয়ী যদি ওই সম্মেলনে না যোগ দেন তাহলে সম্মেলনের কোনও গুরুত্বই থাকবে না। আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলে আসছিলাম যে যদি পাকিস্তান আমাদের কথা না মানে তাহলে বাজপেয়ী নিজের জায়গায় অন্য কাউকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেবেন। শেষমেশ পাকিস্তান আমাদের কথা মানতে হয়।’
দিল্লি থেকে বাজপেয়ীর বিএমডব্লিউ গাড়িটি ইসলামাবাদে নিয়ে যাওয়া হল। সেটাতে চেপেই বিমানবন্দর থেকে হোটেল পর্যন্ত আধঘণ্টার রাস্তা গিয়েছিলেন তিনি। মুশাররফের সঙ্গে আলোচনার সময়ে বাজপেয়ী অভিযোগ করেন যে ভারতে লাগাতার \'সন্ত্রাসী হামলা\' হচ্ছে, যে কারণে নির্বাচনের বছরে তার পক্ষে কোনও লিখিত বক্তব্যে সই করতে সমস্যা হবে।
\'সন্ত্রাসবাদীদের\' বিরুদ্ধে কী কী পদক্ষেপ তারা নিচ্ছেন, তার বিস্তারিত জানান জেনারেল মুশাররফ।
অভিষেক চৌধুরী লিখেছেন, ‘৯/১১-র পরে পশ্চিমা দেশগুলি কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদকে বিদেশ-নীতির একটা অংশ হিসাবে দেখার পক্ষপাতী ছিল না। আমেরিকা পাকিস্তানের ওপরে চাপ বাড়াচ্ছিল যাতে তারা নিজেরাই সন্ত্রাসবাদের উৎস বন্ধ করে দেয়। কয়েক সপ্তাহ আগে চীন সফরের সময়ে মি. মুশাররফকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল যে তিনি যেন ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। মি. বাজপেয়ী চীনের সঙ্গে বাণিজ্য-চুক্তিতে যে ভূমিকা রেখেছিলেন, তার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছিল।’
যৌথ বিবৃতির একটি বাক্য নিয়ে অস্বস্তি
ভারত আর পাকিস্তানের কর্মকর্তারা যখন যৌথ বিবৃতির খসড়া নিয়ে কাজ করছিলেন, তখন পাকিস্তানের পেশ করা খসড়ার একটি বাক্য নিয়ে ভারত আপত্তি তুলেছিল।
সেই বাক্যটা ছিল এরকম : ‘সন্ত্রাসবাদের সমর্থনের জন্য পাকিস্তানের মাটি ব্যবহার করা যাবে না।’
ইসলামাবাদে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত অজয় বিসারিয়া তার বই \'অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট\'-এ লিখেছেন, ভারত জোর দিয়েছিল যে খসড়ায় \'পাকিস্তানের মাটি\'-র বদলে \'পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত জমি\' শব্দ ব্যবহার করতে হবে। এর অর্থ ওই কথার মধ্যেই পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরকেও সামিল করা হয়ে যাবে।
‘শিবশঙ্কর মেনন ফোন করে তারিক আজিজকে ভারতের আপত্তির কথা জানান। ঘটনাচক্রে সেই সময়ে আজিজ মুশাররফের পাশেই বসেছিলেন। মুশাররফ এক সেকেন্ডের মধ্যেই ভারতের আপত্তির সমাধান করে দিলেন,’ লিখেছেন বিসারিয়া।
‘আজিজ তখন রিয়াজ খোখড়কে ফোন করে পাঞ্জাবী ভাষায় বলে যে খসড়ায় ভারতের ইচ্ছানুসারে বদল করে দেওয়া হোক। কয়েক বছর আগে আগ্রা ও লাহোরের বৈঠকে ভারত যা অর্জন করতে পারে নি, এই বৈঠকে ভারত তাতে সফল হয়েছিল,’ তার বইতে মন্তব্য করেছিলেন অজয় বিসারিয়া।
