মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে বাধা দুদক ও সিআইডির মামলা
অনলাইন নিউজ ডেক্স
মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ও সিআইডিতে তদন্তাধীন থাকা অর্থপাচারের মামলাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা। আর এমন পরিস্থিতির মাঝে কাল সোমবার মালয়েশিয়া সরকারের আমন্ত্রণে সেদেশ সফরে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আজ রোববার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) দুই দেশের সরকারপ্রধান পর্যায়ে হবে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। বৈঠকে গুরুত্ব পাবে মালয়েশিয়া শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের সমস্যা দূর করা এবং আরও শ্রমিক নেওয়ার মতো বিষয়গুলো। এছাড়া আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ–রাজনীতি নিয়েও হবে আলোচনা। পরে ৫টি সমঝোতা স্মারক সই ও ৩টি নোট বিনিময় হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এদেশে মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের অভিবাসন সংক্রান্ত মামলাগুলো নিয়ে সেদেশের সরকার উদ্বিগ্ন। এই মামলা মালয়েশিয়া সরকারের ডিজিটাল অভিবাসন সিস্টেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, যা অন্য ১৪টি দেশের শ্রমিকের জন্য ট্রান্সপারেন্ট মাইগ্রেশন নিশ্চিত করছে।
এসব মামলার কারণে সেদেশের টিআইপি র্যাংকিং নিম্নমুখী হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা, এমনকি আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা সৃষ্টি হতে পারে। যা সেদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। ফলে মালয়েশিয়া বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।
গত ২৩ এপ্রিল মালয়েশিয়ার মানব সম্পদ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে এসব মামলা ‘অপ্রমাণিত অভিযোগ’ ও ‘হয়রানিমূলক’ উল্লেখ করে তা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন।
পরে সরকারের পক্ষে মামলা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেদেশের সরকারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ওইসব চিঠির আলোকে ইতোমধ্যে পল্টন থানায় ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেনের করা মানবপাচারের মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে সিআইডি। আদালত ইতোমধ্যে সেটা গ্রহণ করেছে। কিন্তু পল্টন থানায় থাকা মামলার অপর অংশটি (অর্থপাচার) তদন্তাধীন আছে।
এছাড়া সরকারি সংস্থা হিসেবে দুদক বেশ কয়েকটি মামলা করেছে এবং কিছু অনুসন্ধান চলমান আছে। সেগুলো এখন পর্যন্ত প্রত্যাহার হয়নি।
জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলাগুলো প্রত্যাহার হলে এবং অনুসন্ধানে থাকা অভিযোগগুলো নিস্পত্তি করা গেলে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের দাবি, এসব মামলার ফলে মালয়েশিয়ার মানব পাচার সুচক (টিআইপি) ইতোমধ্যে তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দুদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত ২৬ এপ্রিল মালয়েশিয়ার মানব সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে একটি চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে মালয়েশিয়ায় ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ শ্রমিক নিয়োগ সম্পর্কিত উত্থাপিত অভিযোগ গুলো তারা পর্যালোচনা করেছে।
সেখানকার ফরেন ওয়ার্কার সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এফডব্লিউসিএমএস)কে তারা একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া এবং ডিজিটালাইজড নিয়োগ কাঠামো হিসেবে বলেছে।
তারা চিঠিতে আরও বলেছে, ‘সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় কর্মীদের অভিবাসন সম্পর্কিত সমস্ত বিচারাধীন মামলা ও অভিযোগের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করা হয়েছে।
মামলাগুলো হয়রানিমূলক ও অপ্রমাণিত হওয়ায় সেগুলো প্রত্যাহার করা, অনুসন্ধান বা তদন্ত থেকে বাদ দেওয়ার উপায় খোঁজার অনুরোধ করে। মালয়েশিয়া চিঠিতে আরও বলেছে, যাদের বিরুদ্ধে মামলার রেকর্ড হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সহায়ক প্রমাণ সরবরাহ করা হয়নি।
তাছাড়া ইতোপূর্বে খারিজ হওয়া মামলাগুলি পুনরুজ্জীবিত বন্ধের বিষয়ে তারা তাগিদ দেয়।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার বাংলাদেশী কর্মী মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। এটা মূলত উভয় সরকারের মধ্যামে পরিচালিত আনুষ্ঠানিক নিয়োগ চ্যানেলের মাধ্যমে হয়েছে।
এসব শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে মানব পাচারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। চিঠিতে মালয়েশিয়া সরকার স্বচ্ছ এবং নীতিগত নিয়োগ অনুশীলনের মাধ্যমে তাদের টিআইপি (মানব পাচার র্যাঙ্কিং) বজায় রাখা এবং উন্নত করার জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতা চেয়েছে। ’
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, মালয়েশিয়ার চিঠির পর গত মে মাসে ঢাকায় যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয়। ওই সভায় দুপক্ষই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে।
পরে গত আগস্ট মাসে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নেয়ামত উল্লাহ মালয়েশিয়ার মানব সম্পদ মন্ত্রণালয় করে চিঠির জবাব দেন।
ওই চিঠিতে কি উল্লেখ করা হয়েছে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ‘চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শ্রমিক নিয়োগ নিয়ে উত্থাপিত ‘মানব পাচার’ এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ গুলো মূলত: অপ্রমাণিত।
এসব অভিযোগ মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুন্ন করছে। ওই সময়ের মধ্যে উভয় সরকারের লাইসেন্সপ্রাপ্ত সংস্থাগুলির মাধ্যমে ৪ লাখ ৮০ হাজারের বেশি বাংলাদেশী কর্মীকে দু’দেশের সম্মতিতে নিয়োগ করা হয়েছে।
গত মে মাসের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সভায় সমস্ত বিচারাধীন অভিযোগ বা মামলা পর্যালোচনা করা এবং মালয়েশিয়ায় কর্মী সরবরাহের ‘অপ্রমাণিত অভিযোগ’ প্রত্যাহার করা এবং পারস্পরিক আস্থা পুনরুদ্ধার করার কথা বলা হয়।
বাংলাদেশ সরকার মনে করে এসব মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হলে মানব পাচার র্যাঙ্কিং (টিআইপি) সংরক্ষণ এবং উন্নত করা সম্ভব হবে।’
মামলা প্রত্যাহার বা মালয়েশিয়ার চিঠির বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নেয়ামত উল্ল্যা ভূঁইয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের কমিশনার (তদন্ত) মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী বলেন, ‘আমার কাছে এখন পর্যন্ত এবিষয়ে কোনো প্রস্তাব বা সুপারিশ আসেনি। আমার মনে হয় বিষয়টি এখনো সচিব বা ডিজি পর্যায়ে আছে।’
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশের শ্রমবাজার অনেক বড় ও রেমিট্যান্স আহরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বায়রার মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের কোন রিক্রুটিং এজেন্সি ব্যবসা করলো, কোন এজেন্সি করলো না সেটা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হচ্ছে কম অভিবাসন ব্যয় বা শুন্য অভিবাসন ব্যায়ে আমাদের শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মসংস্থান। আমরা চাই আমাদের শ্রমিকরা ভালো থাকুক, দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধিপাক।’
এজন্য মামলা প্রত্যাহারসহ সরকারের যা করণীয় সব করা উচিত বলে মনে করেন রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের সংগঠনের এই নেতা।
