মোমেনকে নিয়ে হজম করতে চেয়েছিলেন ডিসি


মোমেনকে নিয়ে হজম করতে চেয়েছিলেন ডিসি
সিলেটের সাবেক জেলা প্রশাসক কাজী এমদাদুল ইসলাম। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করে বর্তমানে ওএসডি। ১৯ ফেব্রুয়ারি যুগ্ম সচিব থাকাবস্থায় তাকে দপ্তরবিহীন করা হয়। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনকে খুশি করতে সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রায় ৮ একর জমি খাস হিসাবে নিজের জিম্মায় নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আম্বরখানা মৌজায় জমিটি ‘কালামাঠ’ হিসাবে পরিচিত। সাবেক মন্ত্রীর খায়েশ পূরণ করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকে এই জমি লিজ দেওয়ার পাঁয়তারা করেন তিনি। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জমির বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। ৫৫ বছর এই জমি নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে চলমান মামলায় পাউবোর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর উচ্ছেদ না করে ডিসি প্রভাবশালীদের সঙ্গে গোপনে হাত মেলান। আর পুরো বিষয়টি মনিটরিং করেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন। তথ্যানুসন্ধানে পাওয়া নথিপত্র ও পাউবোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য পাওয়া যায়। সোমবার ছিল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদায়ি সচিব নাজমুল আহসানের শেষ কর্মদিবস। তিনি অবসরোত্তর ছুটিতে চলে গেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এদিন তিনি বলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবৈধভাবে দখল হওয়া সম্পদ পর্যায়ক্রমে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কবজায় নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে পাউবোর দখলকৃত জমি উদ্ধারে যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। সরকারি সম্পদ কেউ অবৈধভাবে দখল করতে পারবে না। সিলেটের সাবেক জেলা প্রশাসক কিসের ভিত্তিতে পাউবোর জমি খাস হিসাবে শ্রেণিভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা তদন্ত করে দেখা উচিত। অভিযোগের বিষয়ে জানতে সিলেটের সাবেক জেলা প্রশাসক কাজী এমদাদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। ওএসডি হওয়ার পর থেকে তিনি নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি পলাতক থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। এদিকে নথিপত্রে দেখা গেছে, গত বছরের ৩ নভেম্বর এ বিষয়ে পাউবোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) এসএম অজিয়র রহমান পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে দাপ্তরিক পত্র দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘পাউবো সিলেট জেলার আম্বরখানা মৌজায় ১৫ একর ২ শতক জমি ১৯৬৩ সালে অধিগ্রহণ করে। এল এ কেস নং ১০/৬৩-৬৪। অথচ পাউবোকে না জানিয়ে অধিগ্রহণকৃত এই জমির মধ্যে ৮ একর জমি জেলা প্রশাসক খাস হিসাবে নিজের জিম্মায় নেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেন। এমনকি জেলা প্রশাসক এলএ রিজিউম মামলার (নং-০২/২০১৯) কার্যক্রম গ্রহণ করেন। বর্ণিত ৮ একর জমির রিজিউম (পুনরায় শুরু করণ) কার্যক্রম স্থগিতের বিষয়ে বিভিন্ন সময় সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, প্রধান প্রকৌশলী এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু জেলা প্রশাসক পাউবোর বিষয়টি বিবেচনা না করে রিজিউম কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন।’ পাউবোর তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক সচিবের কাছে লেখা চিঠিতে এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের একটি রায়ও তুলে ধরেন। বলা হয়, ‘আলোচ্য ভূমির কতিপয় সাবেক মালিক তাদের অনুকূলে জমি অবমুক্তকরণের আদেশ চেয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন নং-৫১২/২০১৭ দায়ের করেন। উক্ত মোকদ্দমায় সুপ্রিমকোর্ট ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর রিভিউ পিটিশন খারিজ করে আদেশ দেন। আদেশে বিচারক বলেন, ‘অধিগ্রহণকৃত জমিটি অব্যবহৃত অবস্থায় পাওয়া গেলেও তা ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।’ জানা যায়, সিলেট বিভাগ বাস্তবায়ন পরবর্তী সময়ে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পাউবোর অধিগ্রহণকৃত এই জমিতে পাউবোর সিলেটের প্রধান প্রকৌশলীর বাসভবন ও অফিস ভবন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক ভবন, খেলার মাঠ, অফিসার্স ক্লাব, ওয়ারপো ভবন, হাওর গবেষণা ইনস্টিটিউট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে পাউবোর। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, জমিটির ওপর যেসব প্রভাবশালীর চোখ পড়েছে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক কাজী এমদাদুল ইসলাম। আওয়ামীপন্থি এসব প্রভাবশালীদের শেলটার দিয়েছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন। পাউবো অধিগ্রহণকৃত এই জমি ডিসির খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করে প্রভাবশালীদের লিজ দিয়ে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ফন্দি করেন এমদাদুল ইসলাম। যে কারণে পাউবোর ৮ একর জমি রিজিউম কার্যক্রমের নথিপত্রের অনুলিপির কপি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে না পাঠিয়ে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাতেন। ওই সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন আব্দুল মোমেন। ক্রমান্বয়ে বিষয়টি প্রকাশ পায়। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ৮ একর জমি ভূমিদস্যুদের নামে স্থায়ী বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। নথিপত্র পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড মনু প্রকল্পের কলোনি ও অফিস বিল্ডিং নির্মাণের জন্য আলোচ্য ৮ একরসহ মোট ১৫ একর ২ শতক জমির মধ্যে ৬ একর ৬০ শতক জমি বিধি মোতাবেক অধিগ্রহণ করা হয়নি মর্মে নিম্ন আদালতে স্বত্ব মামলা করা হয়। মামলাটি বিভিন্ন আদালতে রায় আপিল শেষে ১৯৮৩ সালের ৭ মার্চ চূড়ান্তভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনুকূলে রায় দেওয়া হয়। এর আগেই অন্তত দুই একর জমি বেদখল হয়ে যায়। পাউবোর পক্ষে রায় পাওয়ার পর অবৈধ দখল উচ্ছেদের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু যখন যে দল ক্ষমতায় সেই দলের প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় উচ্ছেদ কার্যক্রম বিলম্ব হতে থাকে। আদালতের রায়ে হেরে গিয়ে এই চক্রটি ভিন্ন কৌশলে জমিটি হাতিয়ে নিতে তৎকালীন জেলা প্রশাসককে ম্যানেজ করে। আর কাজী এমদাদুল ইসলাম ‘অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে’ অজুহাত তুলে পাউবোর ৮ একর জমি খাস খতিয়ানে নেওয়ার পাঁয়তারা করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক এনায়েত উল্লাহ মঙ্গলবার বলেন, বিষয়টি খুবই রহস্যজনক। পাউবো একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯৬৩-৬৪ সালে অধিগ্রহণ করা হয়, সেই জমি জেলা প্রশাসক কী করে অপ্রয়োজনীয় বলেন তা বুঝতে পারিনি। নথিপত্রে বেশ কিছু অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। যা একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে তৎকালীন জেলা প্রশাসক করতে পারেন না। বিষয়টি তদন্তের দাবি রাখে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে অবৈধ দখল উচ্ছেদ পরিচালিত হচ্ছে। সিলেটের কালামাঠ দখলের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে তুলে ধরা হবে। জানতে চাইলে সিলেটের বিদায়ি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ মঙ্গলবার বলেন, পাউবোর অধিগ্রহণকৃত জমি খাস হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগের বিষয়টি আমার জানা নেই। কেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক এটি করেছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) বলে যাব বিষয়টি খতিয়ে দেখতে।