রাজধানীর খাবার পানিতে উচ্চমাত্রার বিষাক্ত রাসায়নিক


রাজধানী ও আশপাশের শিল্প এলাকা থেকে সংগৃহীত ভূপৃষ্ঠ ও কলের পানির নমুনায় ‘পিফাস’ নামক উচ্চমাত্রার বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। যা পানিদূষণের বড় উৎস। পিফাস, পার এবং পলিফ্লুরোঅ্যালকাইল, রাসায়নিকগুলো ‘চিরস্থায়ী রাসায়নিক’ হিসাবে পরিচিত। এটি পরিবেশে জমা হয় ও স্থায়ী থাকে। এগুলো মানুষের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, ভ্রুণের বৃদ্ধি এবং থাইরয়েড হরমোন ফাংশনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দীর্ঘমেয়াদে পিফাসের সংস্পর্শ শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। উচ্চ রক্তচাপ, ভারসাম্যহীনতা, কম ওজনের শিশুর জন্মদান এবং টিকার কার্যকারিতার ওপর প্রভাব ফেলে এটি। এছাড়া লিভার নষ্ট এবং ক্যানসারও সৃষ্টি করতে পারে। বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন (এসডো) এবং বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক- আইপিইএনের যৌথ গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। বুধবার রাজধানীর লালমাটিয়ায় এসডোর প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন সংশ্লিষ্টরা এমন তথ্য জানিয়েছেন। এ সময় জানানো হয়, গবেষণার জন্য এসডো এবং আইপেন বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকারখানার কাছে অবস্থিত লেক এবং নদীগুলো থেকে প্রায় ৩১টি উপরিভাগের পানির নমুনা সংগ্রহ করে। ২০১৯ এবং ২০২২ সালে সংগৃহীত পানির নমুনাগুলো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এবং পোশাকশিল্প কেন্দ্রের কাছাকাছি এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। যার মধ্যে রয়েছে টেক্সটাইল এবং অন্যান্য উৎপাদন শিল্প যেমন- পোশাক, ট্যানারি, ইলেকট্রনিক্স, রাসায়নিক, ফার্মাসিউটিক্যাল ও স্টিল প্ল্যান্ট। দুটি নমুনার সংগ্রহস্থল ছিল ইপিজেডের কাছে, বিশেষ শুল্কমুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে। সংগৃহীত নমুনাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ ল্যাবে বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে পাওয়া যায়নি এমন কিছু রাসায়নিক ২০২২ সালের নমুনা গবেষণায় পাওয়া গেছে। যা নির্দেশ করে যে কারখানা মালিকরা নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত পিফাস রাসায়নিক ব্যবহারের বদলে অনিয়ন্ত্রিত পলিমারিক রাসায়নিক ব্যবহারের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। গবেষণায় ২০১৯ সালে কর্ণফুলী নদীর পানিতে সর্বোচ্চ পিফাস শনাক্ত করা হয়েছিল, যা প্রস্তাবিত ইউরোপীয় সীমার চেয়ে ৩০০ গুণ বেশি। সেই নমুনায় দুটি নিষিদ্ধ পিফাসেরও উপস্থিতি ছিল, যা বর্তমান ডাচ সীমার চেয়ে ১ হাজার ৭০০ গুণ বেশি এবং ৫৪ হাজার গুণ বেশি। আরেকটি নমুনা ২০২২ সালে হাতিরঝিল লেক থেকে নেওয়া হয় যাতে পিএফওএ এবং পিএফওএস উভয়ই উপস্থিত ছিল, যা নেদারল্যান্ডের সীমার চেয়ে ১৮৫ গুণ বেশি ছিল। উচ্চ পিফাস পাওয়া গেছে এমন নমুনাগুলো পোশাক শিল্পকারখানার কাছাকাছি এলাকায় বেশি পাওয়া যায়। যা প্রমাণ করে পোশাক শিল্পে পাওয়া পিফাস পানি দূষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে। ২০২২ সালে দুটি জলপথে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ঢাকা এবং আদমজী ইপিজেড) কাছাকাছি আপস্ট্রিম ও ডাউনস্ট্রিমের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল, যেখানে ডাউন্সট্রিমের নমুনায় উঁচু পিফাস ঘনত্ব পাওয়া যায়। ২০১৯ সালের চারটি কলের পানির নমুনার মধ্যে তিনটিতে পিফাস পাওয়া গেছে যা যুক্তরাষ্ট্রের খাবার পানির জন্য নির্ধারিত পিএফওএ সীমার উপরে শনাক্ত করা হয়েছে। গবেষণাটিতে বাংলাদেশের পোশাকও পরীক্ষা করা হয়েছে। পাঁচটি স্যাম্পল পোশাকের সবকটিতেই পিফাস পাওয়া গেছে এবং একটি পুরুষের জ্যাকেটে নিষিদ্ধ রাসায়নিক পিএফওএ পাওয়া গেছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মোট বৈশ্বিক পিফাস ব্যবহারের প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যবহার করে টেক্সটাইল শিল্প। যা পিফাস নির্গমনে বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বিশ্বব্যাপী রপ্তানির ক্ষেত্রে ফাস্ট ফ্যাশন হিসাবে পরিচিত। কিন্তু বিভিন্ন পোশাক পণ্যে পিফাসের উপস্থিতি রয়েছে। এসব পণ্য পানি, তেল এবং দাগ-প্রতিরোধ করতে পারে। এই খাত থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক নির্গমন জনস্বাস্থ্যকে উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলছে। সংশ্লিষ্ট গবেষকরা বলেন, বাংলাদেশে পিফাস নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। তাই এই গবেষণার ফলাফল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নেদারল্যান্ডস এবং যুক্তরাষ্ট্রের মানদণ্ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ৩১টি পৃষ্ঠের পানির নমুনার মধ্যে ২৭টিতে পিফাস পাওয়া গেছে। যার ১৮টি নমুনায় নিষিদ্ধ পিফাস রাসায়নিক- পিএফওএ, পিএফওএস, অথবা পিএফএইচএক্সএস পাওয়া গেছে। এছাড়া ১৯টি নমুনায় প্রস্তাবিত ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রক সীমা অতিক্রম করেছে। অনেক নমুনায় পিফাসের পরিমাণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং নেদারল্যান্ডসের নির্ধারিত মাত্রার চেয়েও বেশি। এর মধ্যে কিছু নমুনায় নিষিদ্ধ পিফাসের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে। এসডোর সিনিয়র পলিসি এবং টেকনিক্যাল উপদেষ্টা এবং গবেষণার প্রধান ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন- নদী, লেক, কলের পানি এবং পোশাকে পিফাস জনস্বাস্থ্যের জন্য এবং পরিবেশের জন্য গুরুতর হুমকি হিসাবে দেখা দিচ্ছে। তবুও শিল্পকারখানা এবং নীতিনির্ধারকরা সাড়া দিচ্ছে না। তিনি বলেন, পিফাস রাসায়নিকগুলোকে একে একে নিয়ন্ত্রণ করতে কয়েক দশক সময় লাগবে যা পরবর্তী প্রজন্মকে ঝুঁকিতে ফেলবে। তাই জরুরিভাবে সব পিফাস রাসায়নিকের ওপর একটি বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন। এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, নদী-নালা ও কলের পানিতে পিফাস দূষণ ঘটছে। এ কারণে রপ্তানি শিল্পকারখানাগুলোকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। যদিও দেশের তৈরি পোশাকের বাজার বিশ্বব্যাপী। কিন্তু দূষণ স্থানীয় পর্যায়ে বেশি হচ্ছে। স্টকহোম কনভেনশনের সদস্য হিসাবে বাংলাদেশকে পিফাস নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক মান বাস্তবায়ন করা জরুরি। এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, আইপেন গ্লোবাল গবেষক এবং গবেষণার সহ-লেখক জিটকা স্ত্রাকোভা। অনুষ্ঠানে জুম অনলাইনে যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, মানুষের বিকাশের সব পর্যায়ে পিফাসের স্থায়ী এক্সপোজারের কারণে প্রচুর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে। টেক্সটাইল শিল্পকে তাদের পিফাস ব্যবহার দ্রুত বন্ধ করা উচিত এবং তাদের পণ্যে পিফাস সামগ্রী সম্পর্কে স্বচ্ছতা থাকা উচিত। ইতোমধ্যে কিছু পিফাস স্টকহোম কনভেনশনের মাধ্যমে সারা বিশ্বে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আরও কিছু পিফাস নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।