সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সব ক্ষেত্রেই সফল


প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা নির্বাচন নিয়ে সমালোচনার জবাবে বলেছেন, নির্বাচন যে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুষ্ঠু হয়, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় সেটাই এই নির্বাচনের (রংপুর সিটি নির্বাচন, ছয়টি উপনির্বাচনসহ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচন) মধ্যদিয়ে আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আমি মনে করি এরপর আর কেউ নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা উত্থাপন করার সুযোগ পাবে না। কারণ আমরা ক্ষমতায় থাকলেও মানুষের ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য আমরাই সংগ্রাম করেছি। কাজেই সেই ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব বলেই মনে করি। আর সেভাবেই এদেশে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হচ্ছে। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার সংসদ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর সমাপনী বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ’৭৫ পরবর্তী অনেক নির্বাচন আমরা দেখেছি। জিয়াউর রহমানের আমলে হ্যাঁ-না ভোট, না বাক্সে কোন ভোট নেই, পাওয়া যায় না। এরশাদ সাহেবের আমলে ’৮৬ সালের নির্বাচনে আমরা অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু নির্বাচনের ৪৮ ঘণ্টার পরও ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি। খালেদা জিয়া ২০০৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রহসনের একতরফা ভোট করেছিলেন। কিন্তু দেশের মানুষ তাদের ছেড়ে দেয়নি। ভোট চুরির অপরাধে দেশের জনগণ আন্দোলন করে খালেদা জিয়াকে মাত্র দেড় মাসের মাথায় পদত্যাগে বাধ্য করেছিল। এটাই হলো বাস্তবতা। সংসদ নেতা ছাড়াও সমাপনী দিনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায় অংশ নেন বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ, সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী, সংসদের প্রধান হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী এবং বিরোধী দলের উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের। আলোচনা শেষে স্পিকার প্রস্তাবটি ভোটে দিলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এ সময় সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা তুমুল টেবিল চাপড়িয়ে বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। শত বাধা ও প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে দেশের উন্নয়নের গতিধারা ধরে রাখতে সক্ষম হওয়ার কথা উল্লেখ করে সংসদ নেতা বলেন, নানা প্রতিকূলতা আমাদের মোকাবিলা করতে হয়েছে। তবুও আমরা দেশের উন্নয়নের গতিধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছি। দেশের মানুষের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। দেশ আরও এগিয়ে যাক, সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি। একদিনে শত সড়ক, শত সেতু অতীতে কেউ কোনো দিন উদ্বোধন করতে পেরেছে? এটা আওয়ামী লীগ সরকার পেরেছে। বাংলাদেশের প্রত্যেকের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করছে। কাউকে আমরা বাদ দিচ্ছি না। প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের উন্নয়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে চ্যালেঞ্জ ছিল। নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের এই একটি সিদ্ধান্ত সারাবিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা অন্য জায়গায় নিয়ে গেছে। সারাবিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি বেড়েছে। আমরাও যে পারি তা আমরা প্রমাণ করেছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলতেন- বাঙালি জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। আমিও বলি, বাংলাদেশকে আর কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। ২০২১ সালে আমরা রূপকল্প ঘোষণা করেছিলাম, সেটা আমরা বাস্তবায়ন করেছি। এখন ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা গড়ে তুলবো স্মার্ট বাংলাদেশ। ইনশাল্লাহ সেই স্মার্ট বাংলাদেশও আমরা গড়ে তুলতে সক্ষম হব। গত ১৪ বছরে দেশের ব্যাপক উন্নয়ন ও সফলতার সামান্য তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালের রূপকল্প বাস্তবায়ন করে আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছি। ওয়াদা করেছিলাম, দেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে আলো জ্বালব। আমরা দেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে একটি মানুষও গৃহহীন-ঠিকানাবিহীন থাকবে না। আমরা এ পর্যন্ত ৩০ লাখ পরিবারকে বিনামূল্যে জমিসহ ঘর করে দিয়েছি, তাদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার ব্যবস্থা করেছি। আরও ৪০ হাজার ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। খবর নিচ্ছি আর কেউ ভূমিহীন আছে কিনা। দেশের একটি মানুষও গৃহহীন বা ঠিকানাবিহীন থাকবে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এ কাজটি শুরু করেছিলেন, আমরা তা শেষ করছি। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, দেশের মানুষকে কথা দিয়েছিলাম ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলব, আমরা তা গড়ে তুলেছি। একদম ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত আমরা ব্রডব্যান্ড পৌঁছে দিয়েছি। মহামারি কোভিড-১৯ আমরা সফলভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি। অনেক উন্নত দেশও বিনামূল্যে ভ্যাকসিন বা করোনা টেস্ট করতে পারেনি, কিন্তু আমরা পেরেছি। সারাবিশ্বের মধ্যে করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ পঞ্চম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে। করোনা মহামারি পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সংকটের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংকট মোকাবিলায় আমরা কৃষি উৎপাদনের ওপর জোর দিয়েছি। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ১৯ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য মজুত আছে। যুদ্ধের কারণে সারাদেশে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। যত টাকাই লাগুক আমরা যেখান থেকে পারছি আমদানি করছি, যাতে দেশের কোনো মানুষের কষ্ট না হয়, সংকটে না পড়েন। টাকার দিকে তাকাচ্ছি না। কারণ আমাদের রাজনীতিই হচ্ছে দেশের মানুষের কল্যাণ করা। প্রধানমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, এক সময় দেশের কোনো উচ্চ পদে নারীদের কোনো পদ ছিল না। আমরা ক্ষমতায় এসে সশস্ত্র বাহিনী, বিচার বিভাগসহ সব স্থানে নারীদের পদ আমরা নিশ্চিত করেছি। আমরা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করেছি। দেশের প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের স্মার্ট করে গড়ে তুলতে পারে, সেই ব্যবস্থাও আমরা নিয়েছি। অর্থনৈতিক চাপ সত্ত্বেও আমরা বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের বই দিয়েছি, সামাজিক নিরাপত্তা আওতায় ৫৭ লাখ বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রায় ২৪ লাখ প্রতিবন্ধীকে বিশেষ ভাতা দিয়ে যাচ্ছি। নারী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি, উপবৃত্তি দিয়ে যাচ্ছি। ’৭৫ পরবর্তী ক্যু-পাল্টা ক্যু এবং অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পালাবদলের কথা উল্লেখ করে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন। এরপর দেশে দীর্ঘদিন অবৈধ ক্ষমতা দখলের পালা চলেছে। ইতিহাসে মাত্র একটিবার ২০০১ সালে ক্ষমতার পাঁচ বছর পূর্ণ করে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলাম। এরপর কখনো শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেনি। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আমরা মহাজোটগতভাবে অংশ নিয়েছিলাম। সেই নির্বাচনে আমরা বিপুল আসনে বিজয়ী হয়েছিলাম। ওই আসনে বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোট পেয়েছিল মাত্র ৩০টি আসন। ২০১৪, ২০১৮ সালের নির্বাচনেও জনগণের ভোটে আমরা ক্ষমতায় আসি, কিন্তু এসব নির্বাচনের আগেও অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। এই রাষ্ট্রপতি (মো. আবদুল হামিদ) নিজের অবস্থানে অটল থেকেছেন। যার ফলে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ রয়েছে। কিন্তু এর মাঝেও আমাদের অনেক চড়াই-উতরাই পার করতে হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বর্ণাঢ্য সফল রাজনৈতিক জীবনের কথা তুলে ধরে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, অত্যন্ত প্রাণবন্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি সংসদে শেষ ভাষণ দিয়ে গেছেন। কারণ আমাদের সংবিধানে রয়েছে কেউ দুই বারের বেশি রাষ্ট্রপতি পদে থাকতে পারবেন না। সেই ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। খুব অল্প বয়সে তিনি এই সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সাতবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। বিরোধী দলে থাকতে তিনি (আবদুল হামিদ) সংসদ উপনেতা, পরে প্রথমে ডেপুটি স্পিকার, এরপর স্পিকার এবং পরবর্তীতে দুইবারের রাষ্ট্রপতি, সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সফল। নিজের, সকল সংসদ সদস্য এবং দেশবাসীর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক জীবনে তিনি অত্যন্ত সফল ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। জাতির পিতা আহ্বানে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছেন। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও রাষ্ট্রপতিকে আমি শ্রদ্ধা জানাই। ডেপুটি স্পিকার ও স্পিকারের দায়িত্ব পালনের সময়ও তিনি সংসদকে সবসময় প্রাণবন্ত রাখতেন। এমনকি মনে হয়, বিরোধী দলের সদস্যদেরও তিনি সমর্থন পেয়েছেন। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে তিনি চলে যাচ্ছেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবেও তিনি (আবদুল হামিদ) অত্যন্ত সফল ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।