শিক্ষাক্রমের ধারাবাহিক ইতিহাস-


শিক্ষাক্রমের ধারাবাহিক ইতিহাস-

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড ও উন্নয়নের চাবিকাঠি। একটি জাতির আশা-আকাঙ্খা রূপায়নের ও ভবিষ্যত নির্মাণের হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। উন্নত জীবনযাপন ও সমাজের অগ্রগতি আনয়নে শিক্ষার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর শিক্ষাকে সঠিকভাবে রূপদানের জন্য প্রয়োজন শিক্ষাক্রম। আধুনিক অর্থে যে কোন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সুবিন্যাস্ত পরিকল্পনাকেই বলা হয় শিক্ষাক্রম। যে কোন শিক্ষা কার্যক্রম কী উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে, কী বিষয়বস্তুর মাধ্যমে উদ্দেশ্য অর্জিত হবে, কখন, কীভাবে, কার সহায়তায় এবং কী উপকরণের সাহায্যে তা বাস্তবায়িত হবে, শিক্ষার্থীর শিখন অগ্রগতি কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে ইত্যাদি সম্পর্কিত যাবতীয় পরিকল্পনার রূপরেখাই হলো শিক্ষাক্রম। তবে শিক্ষাক্রম ধারণার উৎপত্তির শুরুতে শিক্ষাক্রম সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হতো। ধীরে ধীরে সময়ের পরিক্রমায় তা শিক্ষা কর্মকান্ড পরিচালনার সামগ্রিক পরিকল্পনা হিসেবে রূপ পেয়েছে এবং শিক্ষাক্রম নিয়ে আরও নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে ও এ সম্পর্কিত আরও নতুন নতুন ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে।

শিক্ষাক্রমের ইংরেজি পরিভাষা Curriculum । এটি ল্যাটিন শব্দ currere থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘ course of study ’ অর্থাৎ ‘পাঠ্যবিষয়’। আবার কেউ কেউ মনে করেন এটি ল্যাটিন শব্দ ‘ currere ’ থেকে এসেছে। এর অর্থ হল ‘ঘোড় দৌড়ের মাঠ’। শাব্দিক অর্থে যাই হোক না কেন, আভিধানিক অর্থে শিক্ষাক্রম বলতে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য পরিচালিত কোর্সকে বুঝায়।

আমেরিকায় শিক্ষাক্রমের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায় ১৮২০ সাল থেকে। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাক্রম বলতে মূলত ‘course of study’ বা কতগুলো পাঠ্যবিষয়কে বুঝাত, যা অনুসরণ করে শিক্ষক শ্রেণিতে পাঠদান করতেন। সে সময় শিক্ষাক্রমের মূল ফোকাস ছিল শিশুর মানসিক এবং জ্ঞানের বিকাশ। এজন্য শিক্ষাক্রমে বংশানুক্রমিক সুসংবদ্ধ জ্ঞান ও মানসিক শৃঙ্খলা অর্জনের উপর গুরুত্ব দেওয়া হত। প্রাচীনপন্থী শিক্ষাবিদদের ধারণা ছিল যে, শিশুর সুষ্ঠু মানসিক বিকাশ ঘটাতে হলে বিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমে কতগুলো অপরিহার্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এগুলো হলো মাতৃভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন ও পশ্চিমা দেশের ভাবধারা। ফলে সে সময় শিক্ষাক্রমে এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হতো।

শিক্ষাক্রমের আধুনিক ধারণা-
শিক্ষাক্রম হচ্ছে শিক্ষার একটি সামগ্রিক রূপরেখা। এটি শিক্ষার লক্ষ্যে পৌছানোর একটি নীল নকশা বা Road Map যা অনুসরণ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। শিক্ষার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলবার কার্যকর পরিকল্পনা হলো শিক্ষাক্রম। এটি যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনার মূল চালিকাশক্তি। ১৯৩০ সালের পর থেকে শিক্ষাক্রমের প্রাচীন ও সংকীর্ণ ধারণার পরিবর্তন হয়ে শিক্ষাক্রমের ধারণার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। এসময় শিক্ষাক্রম বলতে স্কুল কর্তৃক পরিচালিত সকল শিখন অভিজ্ঞতার সমষ্টিকে বুঝানো হতো। এ প্রসঙ্গে ১৯৩৫ সালে ক্যাসওয়েল ও কম্পবেল (Caswell and Compbell) শিক্ষাক্রমের পুরাতন ধারণার অবসান ঘটিয়ে একটি নতুন সংজ্ঞা প্রস্তাব করেন। “শিক্ষাক্রম হল শিক্ষকের পরিচালনায় শিক্ষার্থীর অর্জিত সকল অভিজ্ঞতা”। সে সময়ের অন্যান্য শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞগণও (Smith et. al, 1957 Ges Korr, 1968) শিক্ষাক্রমের এ ধারণাকে সমর্থন করেন।

এ সকল দিক ব্যাখ্যা করে Daniel Tanner and Laurel N. Tanner 1980 সালে শিক্ষাক্রমের একটি কার্যকর সংজ্ঞা প্রদানের চেষ্টা করেন-“Curriculum is that reconstruction of knowledge and experience, systematically developed under the auspices of the school (or university) to enable the learner to increase his or her control of knowledge and experience”

শিক্ষাক্রম সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষীদের ধারণা-
নিচে কয়েকজন মনীষীর ধারণা উল্লেখ করা হলো যা শিক্ষাক্রমের ধারণা বুঝতে সহায়ক হবে।
* হিলডা তাবা (১৯৬২), যুগের চিন্তাভাবনার অবয়বহীন ফসলই হলো শিক্ষাক্রম।
* হুইলার (১৯৬৭), শিক্ষাক্রম বলতে শিক্ষার উদ্দেশ্য, শিখন অভিজ্ঞতা নির্বাচন, বিষয়বস্তু শনাক্তকরণ, বিষয়বস্তু সংগঠন, মূল্যায়ন ইত্যাদির একটি বৃত্তাকার গতিশীল কার্যক্রমকে বুঝিয়েছেন।
* কার (১৯৬৮), বিদ্যালয় কর্তৃক পরিকল্পিত ও পরিচালিত যাবতীয় শিখন যা বিদ্যালয় এবং বিদ্যালয়ের বাইরে দলগত বা ব্যক্তিগতভাবে সম্পন্ন করা হয় তাই শিক্ষাক্রম।
* পোফাম ও বেকার (১৯৭০), শিক্ষাক্রম স্কুলের সেই সকল পরিকল্পিত কার্যক্রম যা অর্জনের দায়দায়িত্ব স্কুলের ওপর বর্তায়।
* জনসন (১৯৭০), শিক্ষাক্রম হচ্ছে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা বা ফলাফল।
* ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ লটন (১৯৭৩) শিক্ষাক্রমের উপাদান অত্যাবশ্যকীয়ভাবে সামাজিক কৃষ্টি থেকে নির্বাচিত করতে হবে।
* মার্শ এবং স্ট্যাফোর্ড (১৯৮৮), শিক্ষাক্রম হলো ‘পরিকল্পনা’ ও ‘অভিজ্ঞতার’ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত একটি সেট যা শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কার্যক্রমের মাধ্যমে সম্পন্ন করে।

শিক্ষাক্রমের প্রকৃতি ও পরিসর-
* শিক্ষাক্রম হচ্ছে শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের বিশদ পরিকল্পনা। এটি কোন স্তরের বা বিষয়ের শিক্ষা সম্পর্কিত কর্মতৎপরতার সামগ্রিক নীলনকশা এবং কর্মসম্পাদনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
* শিক্ষাক্রমের পরিসর বহু বিস্তৃত। শিক্ষাক্রম কেবল একটি বিষয়ে একটি শ্রেণির জন্য প্রণীত হতে পারে। আবার একটি বিষয়ে একটি সম্পূর্ণ স্তরের জন্য শিক্ষাক্রম তৈরি হতে পারে। এছাড়া একটি শিক্ষাস্তর বা ধারার সকল বিষয় ও সকল স্তরের জন্যও এটি প্রণয়ন করা হয়।
* শিক্ষাক্রম প্রণয়নে যে দিকগুলো বিবেচনা করা হয় তা হলোÑ শিক্ষার্থীরা কী শিখবে? কখন, কীভাবে, কার সহায়তায় এবং কত সময় ধরে শিখবে? শিক্ষাদানে কী শিখন সামগ্রী ও উপকরণ ব্যবহৃত হবে? শিক্ষকের কী যোগ্যতা থাকতে হবে? শিক্ষার্থীর অর্জনকে কীভাবে পরিমাপ করা হবে? ইত্যাদি।
* শিক্ষার উদ্দেশ্য, শিখন অভিজ্ঞতা, বিষয়বস্তু, শিখন-সামগ্রী প্রণয়ন, উৎপাদন, সরবরাহ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ (বিস্তরণ), ভৌত সুবিধা, সহায়ক শিক্ষা উপকরণ, শিখন অগ্রগতি পরিমাপ ইত্যাদি সবই যেন একীভূত ও অভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয় শিক্ষাক্রম প্রণয়নে সেদিকে খেয়াল রাখা হয়।
* শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সাথে সম্পৃক্ত কাজসমূহও (পরিদর্শন, তত্ত্বাবধান, প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় যোগান ইত্যাদি) শিক্ষাক্রমের পরিসরের অন্তর্ভুক্ত।
* শিক্ষাক্রম যে কোন শিক্ষা ধারা (আনুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক) এবং প্রশিক্ষণের জন্য প্রণীত হতে পারে।

শিক্ষাক্রম প্রণয়নের নীতিমালা-
শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কিছু একাডেমিক নীতিমালা রয়েছে। নিচে এগুলো আলোচনা করা হলো-
১। শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: শিক্ষানীতি এবং বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় দলিলে একটি রাষ্ট্রের শিক্ষার লক্ষ্য কী হবে সে সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা উল্লেখ থাকে। শিক্ষাক্রমে এসব দিকগুলোর প্রতিফলন ঘটাতে হয়।
২। শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক: শিক্ষাক্রম, শিক্ষার্থীর চাহিদা, আগ্রহ, সামর্থ, ধারণ ক্ষমতা ইত্যাদি দিককে ভিত্তি করে প্রণয়ন করতে হয়। অর্থাৎ শিক্ষাক্রম হবে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক। বিভিন্ন ধরনের শিক্ষামূলক কর্মকান্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শেখার সুযোগ থাকতে হবে।
৩। ব্যক্তির সামাজিক চাহিদার প্রতিফলন: মানুষ সামাজিক জীব। শিক্ষার্থী সমাজেই জন্মগ্রহণ করে ও বেড়ে উঠে। আধুনিক শিক্ষা ব্যক্তির নিজস্ব সত্তা ও সামাজিক সত্ত্বা উভয় দিকের বিকাশকে গুরুত্ব দেয়। শিক্ষাক্রম প্রণয়নে এদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৪। সৃজনশীলতার বিকাশ: শিক্ষার কাজ কেবলমাত্র অতীত অভিজ্ঞতাকে সংরক্ষণ করা নয়। শিক্ষার্থী নিজস্ব সম্ভাবনা ও সৃজনশীলতার উন্নয়নও শিক্ষার কাজ। অতএব, শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতার বিকাশকে গুরুত্ব দিবে। তাদের চিন্তাাশক্তির বিকাশে জোর দিতে হবে।
৫। ভবিষ্যৎমূখী করা: শিক্ষা হবে জীবনভিত্তিক। তবে শিক্ষা শুধু বর্তমান জীবন পরিস্থিতিকেই গুরুত্ব দিবে না। শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যত জীবনের দায়িত্ব পালনেও প্রস্তুত করবে। সুতরাং শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও উন্নয়নে যুগপৎ সমাজের ভবিষ্যত চাহিদাকেও বিবেচনা করতে হবে।
৬। জীবন ধারনের প্রস্তুতি: শিক্ষার্থীর পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কর্মকান্ড এবং এগুলোর মাধ্যমে কীভাবে ব্যক্তির জীবনের চাহিদাসমূহের পরিপূরণ হচ্ছে সে সম্পর্কে জানার সুযোগ শিক্ষাক্রমে থাকবে।
৭। সংরক্ষণ করা: মানবজাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের ও তাকে ভবিষ্যতমুখী করার অন্যতম মাধ্যম শিক্ষা। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ তার অর্জিত অভিজ্ঞতা সংরক্ষণের মাধ্যমে আগামী দিনের পরিবর্তনশীল সমাজের সাথে খাপ খাওয়ার উপযোগী দক্ষতা অর্জন করতে পারে। এক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের ভূমিকা দ্বিমুখী- (১) অতীত অভিজ্ঞতার সংরক্ষণ এবং (২) ভবিষ্যত সমাজের মধ্যে তার সঞ্চালন। শিক্ষাক্রম প্রণয়নে এদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৮। বিষয়বস্তুর সমন্বয় ও সহসম্পর্ক রক্ষা: শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যাতে বিষয়বস্তুসমূহ যৌক্তিকভাবে ও মনোবিজ্ঞানের নীতিমালা অনুযায়ী বিন্যস্ত হয়। এর ফলে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে যথার্থ সমন্বয় ও সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব হবে।
৯। ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যকে গুরুত্ব দেওয়া: শিক্ষাক্রম এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যাতে করে প্রতিটি শিশুর/শিক্ষার্থী আত্ম-প্রকাশ ও উন্নয়নের সুযোগ থাকে। এ লক্ষ্যে শিক্ষাক্রমকে ব্যক্তিক পার্থক্যের মনোবৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হবে যা আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় জটিলতা উপলব্ধি করতে ও তার সমাধানে সহায়ক হবে।
১০। শিখন সক্ষমতা: শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি বিষয়/বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীর শেখার উপযোগী হতে হবে। সেই সাথে বিষয়বস্তুসমূহের প্রয়োজনীয়তাও থাকতে হবে।
১১। সামাজিক সংশ্লিষ্টতা ও উপযোগিতা: শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহ এমনভাবে চয়ন করতে হবে যাতে করে শিখন ক্ষেত্র (ফরংপরঢ়ষরহব) হিসেবে তার গুরুত্ব থাকে। সেই সাথে তার নিজস্ব গুরুত্ব, সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা ও উপযোগিতা থাকে।
১২। অবকাশ সময়ের সদ্ব্যবহার: খেলাধুলা, শিল্পচর্চা, নান্দনিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সহায়ক বিষয়বস্তু শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর অবসর সময়টাকে কার্যকর ও আনন্দঘন ব্যবহারের সুযোগ থাকবে শিক্ষাক্রমে।
১৩। বিভিন্নতার স্বীকৃতি ও নমনীয়তা: শিক্ষাক্রমের সাধারণ উদ্দেশ্য হবে সকলের স্বাভাবিক বিকাশ ও উন্নয়ন। তা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্নতাকে (ছেলেমেয়ে, জাতি, গোষ্ঠী, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি) মূল্যায়ন করবে ও প্রত্যেকের বিশেষ চাহিদার প্রতি গুরুত্ব আরোপ।

শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সাম্প্রতিক গতিধারা
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল দেশে দ্রুত সামাজিক বিবর্তন ঘটছে। এ বিবর্তনের সাথে শিক্ষার্থীদের খাপ খাইয়ে চলার জন্য কী ধরনের শিক্ষার দরকার তা নিয়ে ক্রমাগত চিন্তাভাবনা ও গবেষণা হচ্ছে। সামাজিক বিবর্তনের সূচকগুলো শিক্ষাকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। ফলে শিক্ষাক্রম প্রণয়নে এদিকগুলো বর্তমানে গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে।
১। জ্ঞান জগতের বিচরন: জ্ঞান জগৎ অতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন সৃষ্ট প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পরিবর্তিত ও জটিল পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ার যোগ্যতা অর্জনে শিক্ষাক্রম সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
২। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি: বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপ্লব ও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে এবং হচ্ছে যা আমাদের প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তি উপহার দিচ্ছে। এগুলো ব্যবহার করে দ্রুত ও অধিকতর সক্ষমতার সাথে শিক্ষামূলক কর্মকান্ড সহ অন্যান্য কর্মকান্ড পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে এসব নবতর জ্ঞান ও প্রযুক্তি সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। প্রতিযোগিতাশীল বিশ্বে টিকে থাকার জন্য এ সকল প্রযুক্তিগত জ্ঞান আহরণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এছাড়া বর্তমান যুগ আইসিটি-র যুগ, যা মানুষের জীবনের সকল দিককে স্পর্শ করেছে। প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অনেক কাজকে সহজ, সুবিধাজনক এবং মানসম্পন্ন করেছে। ফলে প্রযুক্তি নির্ভরতার এ যুগে সকলের এ বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে শিক্ষার অন্যতম কাজ ব্যক্তির জীবন দক্ষতাও বাড়ানো। ফলে শিক্ষাক্রমের ফলপ্রসূ বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীদের আই.সি.টি-এর জ্ঞান ও দক্ষতা অপরিহার্য। শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায়ও এর ফলপ্রসূ ব্যবহার জরুরি। শিক্ষাক্রম প্রণেতাগণ শিক্ষাক্রম প্রণয়নে অবশ্যই এ দিকটির উপর গুরুত্ব দিবেন। ৩। চাহিদাভিত্তিক শিক্ষাক্রম: আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা চাহিদাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়নের উপর অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক চাহিদার কথা মাথায় রেখে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে হবে।
৪। একবিংশ শতাব্দীর দক্ষতায় গুরুত্বারোপ: বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে সহযোগিতা, সূক্ষ চিন্তা (পৎরঃরপধষ ঃযরহশরহম), ফলপ্রসূ যোগাযোগ দক্ষতা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং সহমর্মিতার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। সকল বিষয়ের শিক্ষাক্রম প্রণয়নে একবিংশ শতাব্দীর এসব দক্ষতা অর্জনের উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
৫। আন্তর্জাতিকতার ধারণা: বর্তমানে বিশ্বায়নের ধারণা পুরো পৃথিবীকে একটি বিশ্ব গ্রামে (মষড়নধষ ারষষধমব) পরিণত করেছে। সুতরাং পুরো বিশ্বটাকে একটি পরিবার হিসেবে ধরে নিয়ে শিক্ষাক্রমের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আন্তর্জাতিকতার মনোভাবের বিকাশ ও প্রসার ঘটাতে হবে। শিক্ষাক্রমের কাজ হবে শিক্ষার্থীদের জন্য এ ধরনের পরিবেশ তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করা।
৬। গঠনবাদ (ঈড়হংঃৎঁপঃরারংস): বর্তমানে গঠনবাদকে শিক্ষার একটি মৌলিক নীতিমালা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গঠনবাদে বিশ্বাস করা হয় যে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কোন বিষয় সম্পর্কে তার নিজস্ব ধারণা গঠনের স্বাধীনতা দিতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীকে জোর করে কিছু শেখানো বা মুখস্থ করে শেখানোর উপায় পরিহার করতে হবে। শিক্ষার্থীকে শিখন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করানোর মাধ্যমে শেখাতে হবে। যদি শিক্ষার্থী জ্ঞান/ধারণা গঠনে পুরোপরি সক্রিয় থাকে তাহলে শিখন প্রক্রিয়া ফলপ্রসূ হবে। অতএব, সকল শিক্ষাক্রমে গঠনবাদের ভিত্তিতে শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতে হবে।
৭। বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সমন্বয়সাধন: বর্তমানে বহু দেশ শিক্ষার বিষয়বস্তুর কয়েকটি ক্ষেত্রকে সংগঠিত করে একটি সমন্বিত শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করার উপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোন বিষয়ে সামগ্রিক জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশের সুযোগ ঘটে, যা বাস্তব সমস্যা সমাধানে অধিকতর কার্যকরী হয়। শিক্ষাক্রম প্রণয়নে এদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
৮। কৃতিত্ব মূল্যায়নে গুরুত্বারোপ: বর্তমানে শিক্ষার্থীর শিখন অগ্রগতি পরিমাপে প্রথাগত ২/৩টি আনুষ্ঠানিক সাময়িক পরীক্ষা গ্রহণের পরিবর্তে ধারাবাহিক মূল্যায়ন, সমস্যা সমাধান, বাস্তবভিত্তিক ব্যবহারিক কাজ, মৌখিক পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি সামষ্টিক মূল্যায়নের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এগুলো পুরাতন শিক্ষাক্রমের ধারণা।
এখন দেখা যাক নতুন শিক্ষাক্রমে কী আছে-
নতুন শিক্ষাক্রমের শিক্ষা উপকরণ-
নতুন শিক্ষাক্রমের শিক্ষা উপকরণ বলতে মূলত নতুন শিখন কৌশলকে বোঝানো হয়ছে। পুরাতন শিক্ষাক্রমের শিক্ষা উপকরণ ছিলো শুধুমাত্র পাঠ্যবই। নি:সন্দেহে বই একটি গুরুত্বর্পূণ শিক্ষা উপকরণ । তবে নতুন কারিকুলামে নতুন শিক্ষা উপকরণ হিসেবে পাঠ্যবইয়রে সাথে আরও যুক্ত হবে শিক্ষার্থীদের স্বতঃর্স্ফূত অংশগ্রহণের ছবি, পাঠ, র্বণধাঁধা, ভূমিকা অভিনয়, বিতর্ক, গল্প বলা ও শোনার খলো, প্রেজেন্টেশন, প্রজেক্ট, শিক্ষা ভ্রমণ কিংবা বক্তৃতা ইত্যাদি।

এক নজরে নতুন কারকিুলামরে উল্লখেযোগ্য পরর্বিতন সমূহ
* শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে দুইদিন (শুক্রবার ও শনিবার)।
* বাতিল হচ্ছে সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি।
* ৩য় শ্রণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকছে না।
* প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা থাকছে না।
* প্রাথমিক শ্রেণিতে সবার জন্য ৮ টি বই এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ১০টি বই পড়তে হবে।
* শুধু এসএসসি তে গিয়ে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা হবে।
* এসএসসি পর্যায়ে কোনো বিভাগ থাকবে না।
* একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির দুইটি পাবলিক পরীক্ষার সমন্বয়ে ফলাফল হবার কথা রয়ছে।
১৯৬৭ সালে ডযববষবৎ, ঞুষড়ৎ এর শিক্ষাক্রমের মডেলে পরিবর্তন করে
শিখন-শেখানোকে একটি বৃত্তাকার প্রক্রিয়ায় প্রকাশ করেন।
তার প্রক্রিয়ার উপদানগুলো হলো-

তথ্যসূত্র: অনলাইন
ছবি- ইফফাত নাওমী ম্যাম, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয।
জাতীয় শিক্ষাক্রম এমন একটি পাঠ্যক্রম যা বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং মান নিশ্চিত করার জন্য প্রণয়ন করা হয়। র্বতমানে আমাদের দেশে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরখো ২০২১-এর আলোকে জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২ প্রণয়ন করা হয়েছে যেখানে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে পরকিল্পনা বিন্যস্ত। পরকিল্পনা অনুযায়ী ২০২২ সালে ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (মাদ্রাসা, কারিগরি ও জেনারেলে) এই কারিকুলামের পাইলটিং শুরু হয়। ২০২৩ সালে নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক বিন্যস্ত করে শ্রেণি পাঠদান শুরু হয় এবং ২০২৪ সাল থেকে অষ্টম ও নবম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে পাঠদান র্কমসূচি পরিচালিত হচ্ছে। নতুন কারকিুলামের বিশেষত্ব হলো, প্রচলতি পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করে শিখনকালীন মূল্যায়ন, ষাণ্মাষকি ও বাৎসরিক সামষ্টিক মূল্যায়ন ব্যবস্থার প্রর্বতন। এতে শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে জিপিএ-৫ পাওয়ার ইঁদুর-দৌড়ের প্রতিযোগিতা বন্ধ করে তাদের মধ্যে গণতান্ত্রকি মূল্যবোধ, পরমত সহিষ্ণুতা, আত্মনির্ভরতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি অন্যান্য সস্তা শিক্ষা উপকরণ (পরিত্যক্ত জিনিস) ব্যবহার করে শ্রেণিকার্যক্রমকে কীভাবে আরো বেশি আনন্দদায়ক ও শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক করা যায়, জোর দেওয়া হয়েছে তার ওপর। মুখস্থনির্ভর লেখাপড়া থেকে বের করে আনার পাশাপাশি মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা ও বিজ্ঞান বিভাগ বিলুপ্ত করে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন করা হয়েছে।
চর্তুথ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে জীবন ও জীবিকার আমূল পরির্বতন ঘটেছে। পেশা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে র্কমসংস্থান। র্কমক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে র্কমক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে নতুন সম্ভাবনা। এছাড়া কোভিড ১৯-এর পর মানুষ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরির্বতন, অভিবাসন সংকট, জাতিগত সহিংসতা, র্দীঘমেয়াদি যুদ্ধ, ভূ-রাজনীতরি মেরুকরণ প্রকট আকার ধারণ করছে। এছাড়া রয়েছে ক্ষুধা, দারদ্র্যি ও অশিক্ষার মতো বিষয়গুলো। এসব চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার টেকসই ও র্কাযকর সমাধান করা এখন সময়রে দাবি। যার জন্য প্রয়োজন জ্ঞান, দক্ষতা ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা।
নতুন কারকিুলাম বহুমাত্রকি অভিজ্ঞতাভিত্তিক সক্রিয় শিখনের আলোকেই প্রণীত হয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রেক্ষাপটনির্ভর অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ধারণা লাভ করে সক্রিয় পরীক্ষণে পৌঁছাতে পারবে। প্রকল্পভিত্তিক, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জভিত্তিক, অনুসন্ধানমূলক, সহযোগিতামূলক, সংযোগমূলক ও প্রেক্ষাপটনির্ভর শিখন কৌশলরে মাধ্যমে অভিজ্ঞতা, পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া, পর্যবেক্ষণ, হাতে-কলমে কাজ, দলীয় কাজ, পঠন ও স্মৃতিতে ধারণ করে জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ অর্জনের মাধ্যমে সুনাগরিক গড়ে তোলাই বর্তমান কারিকুলামের লক্ষ্য। নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের যেসব দক্ষতা অর্জনের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা হলো সূক্ষ্ম চিন্তন দক্ষতা, সৃজনশীল চিন্তন দক্ষতা, সমস্যা সমাধান দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, স্ব-ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, সহযোগিতামূলক দক্ষতা, বিশ্বনাগরকিত্ব দক্ষতা, জীবিকায়ন দক্ষতা, মৌলকি দক্ষতা, ডিজিটাল দক্ষতা র্অজনের মাধ্যমে আমাদের পরর্বতী প্রজন্ম র্স্মাট বাংলাদেশের র্স্মাট নাগরকি হিসেবে গড়ে উঠবে।
নতুন শক্ষিাক্রমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের বড় অংশ হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহকিভাবে (শিখনকালীন)। অর্থাৎ প্রতিটি অভিজ্ঞতা শেষে শিক্ষক মূল্যায়ন করে রেকর্ড সংরক্ষণ করবেন এবং বছররে মাঝামাঝি ষাণ্মাষিক সামষ্টিক মূল্যায়ণ করবনে একই ভাবে বছর শেষে বাৎসরিক সামষ্টিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে । নেই কোন রোল নম্বর। নতুন বছর শুরুর আগে শিক্ষার্থীরা হাতে পাবে পূর্ববর্তী বছরের রেজাল্ট কার্ড। যেখানে শিক্ষার্থীর অগ্রগতি কয়েকটি নির্দিষ্ট চিহ্ন দ্বারা বোঝানো হয়। আর এই বিশেষ চিহ্ন দেখে অভিভাবক জানতে পারবে তার সন্তানের অবস্থান।