টানা ২০ মাস পর শেয়ারবাজারে বহুলপ্রত্যাশিত ফ্লোর প্রাইস (নিম্নসীমা) উঠে যাচ্ছে আজ। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বৃহস্পতিবার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে ৩৫টি কোম্পানি ছাড়া বাকি ৩২০টি কোম্পানি স্বাভাবিকভাবে লেনদেন করতে পারবে।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়টি ইতিবাচক। বাজারের জন্যও এটি একধরনের স্বস্তির নিশ্বাস। তাদের মতে, সাময়িকভাবে শেয়ারের দাম কিছুটা ওঠানামা করলেও দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক হবে বাজার। লাইফ সাপোর্ট থেকে বেড়িয়ে এসে বিনিয়োগকারীরা একটি স্বাভাবিক বাজার পাবে। তবে বিষয়টি নিয়ে কারও কারও মধ্যে আতঙ্কও রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট অংশীজনরা বাজার স্বাভাবিক রাখার নিশ্চয়তা দিলেও তাতে আস্থা রাখা কঠিন। কারণ, দীর্ঘদিন পর ফ্লোর প্রাইস উঠছে। এতে বড় ধরনের পতন হলে বাজারে আতঙ্ক ছড়াবে।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে নেওয়া ইতিবাচক। দুই-একদিন একটু সমস্যা হলেও আশা করি বাজার ঠিক হয়ে যাবে। তবে আমার মত হলো, ফ্লোর প্রাইস দেওয়াই ঠিক হয়নি। কারণ, বাজারকে নিজস্ব গতিতে চলতে না দিয়ে বন্দিশালায় রাখা কোনোভাবেই যৌক্তিক ছিল না। আমি শুরু থেকে এটি বলে আসছি।
তিনি বলেন, কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন সূচক আরও ৩শ পয়েন্ট বৃদ্ধির পর ফ্লোর তুললে ভালো হতো। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, সেই তিনশ পয়েন্ট তুলবে কে, সেটি আগে ঠিক করা উচিত। আবার কেউ বলছেন, নতুন সিদ্ধান্তে বাজার একেবারে পড়ে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো-আপনি কতদিন এভাবে ধরে রাখবেন। এভাবে একটি দেশের শেয়ারবাজার চলতে পারে না। ফলে আমার বক্তব্য হলো-বর্তমানে যে ৩৫টি কোম্পানিতে ফ্লোর দেওয়া আছে, সেটিও তুলে নেওয়া উচিত।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কমিশন আশা করছে, ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার ফলে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে বাজারেও গতি ফিরবে।
প্রসঙ্গত, ফ্লোর প্রাইস হলো শেয়ার দাম কমার নিম্নসীমা। করোনার সময় অস্থিরতা ঠেকাতে নতুন এ নিয়ম চালু করেছে বিএসইসি। এক্ষেত্রে কোনো কোম্পানির শেয়ারের দামের ভিত্তি হবে ‘আগের ৫ দিনের সর্বশেষ লেনদেনের (ক্লোজিং প্রাইস) গড় দর’। কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম ফ্লোর প্রাইসের নিচে নামতে পারবে না। কিন্তু স্বাভাবিক সার্কিট ব্রেকার (একদিনে দাম ওঠানামার সীমা) অনুসারে দাম ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারবে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রথমবার ২০২০ সালে মার্চে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করলেও ২০২১ সালের জুলাইয়ে তুলে নেওয়া হয়। তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দরপতন ঠেকাতে গত বছরের ২৮ জুলাই পুঁজিবাজারে দ্বিতীয়বার ফ্লোর প্রাইস দেয় বিএসইসি। এখনো সেটি বহাল আছে।
এ কারণে বিশালসংখ্যক বিনিয়োগকারী বিপদে রয়েছেন। যারা ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন, তারা সবচেয়ে বিপদে।
জানা যায়, ফ্লোর প্রাইস আরোপের পর বাজারের স্বাভাবিক লেনদেন কমে যায়। দুই শতাধিক কোম্পানি ফ্লোরে আটকে থাকে। আয় কমে যায় স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্রোকারেজ হাউজ এবং ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী কোম্পানি সিডিবিএলের। সরকারেরও শেয়ারবাজার থেকে কর আদায় কমে। এতে ব্যাপক সমালোচনায় পড়ে বিএসইসি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এ বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তবে বিভিন্ন অংশীজনের কাছ থেকে চাপ এলেও জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের পরামর্শে ফ্লোর প্রাইস বহাল রাখে বিএসইসি। এরপর নির্বাচন শেষ হলে বৃহস্পতিবার নতুন সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। অর্থাৎ আজ থেকে কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্যে আর ফ্লোর প্রাইস থাকছে না। তবে বড় ধরনের পতনের আশঙ্কা বিবেচনা করে বড় মূলধনের ৩৫ কোম্পানির ওপর ফ্লোর প্রাইস বহাল রাখা হয়।
এর মানে হলো, বর্তমানে নিয়মিত বাজারে তালিকাভুক্ত ৩৫৫টি কোম্পানির মধ্যে ৩২০টিই স্বাভাবিক লেনদেন করতে পারবে। এসব প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক সার্কিট ব্রেকার কার্যকর হবে। অর্থাৎ একদিনে ওইসব কোম্পানির শেয়ারের দাম ১০ শতাংশ বাড়তে কিংবা কমতে পারবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. ছায়েদুর রহমান বলেন, বর্তমানে বাজার যে অবস্থায় আছে, সেখান থেকে দরপতন যৌক্তিক নয়। আমরা আশা করি, বাজার ইতিবাচক হবে। কারণ, সার্বিক পরিস্থিতি ইতিবাচক। তিনি বলেন, বিষয়টি আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ফোরামে আলোচনা হয়েছে।
বাজার শুরুর আগে আমাদের সিইও (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) ফোরামের আবারও বৈঠক হবে। সেখানেও কথা বলব। সবকিছু মিলে আমরা একটি ইতিবাচক বার্তা দিতে চাচ্ছি। সবাই যার যার জায়গা থেকে সহায়তা করলে দীর্ঘমেয়াদে বাজার ইতিবাচক হবে। ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০ মাস পর ফ্লোর প্রাইস উঠে যাচ্ছে। ফলে স্বল্পমেয়াদে বা ২/৩ দিনের মধ্যে তেমন কিছু প্রত্যাশা করছি না। কারণ, বিনিয়োগকারীরা বিভিন্নভাবে আটকে ছিলেন। এখন হঠাৎ তাদের আচরণ কেমন হয়, সেটি বোঝা মুশকিল। তিনি বলেন, বাজার স্থিতিশীল হওয়ার জন্য আমাদের ২ থেকে ৩ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।
এদিকে এখনো ৩৫ কোম্পানিতে ফ্লোর প্রাইস থাকছে। এসব কোম্পানির ফ্রি ফ্লোড বা লেনদেনযোগ্য শেয়ারের মধ্যে সূচকে অবদান অনেক বেশি। যে কোম্পানিটি সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে, ওই কোম্পানির সূচকে অবদান ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
সবকিছু মিলে এ ৩৫ কোম্পানি সূচকে ৩০ শতাংশের মতো অবদান রাখছে। কোম্পানিগুলো হলো আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, বারাকা পাওয়ার, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, বেক্সিমকো লিমিটেড, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল, বিএসআরএম লিমিটেড, বিএসআরএম স্টিল, কনফিডেন্স সিমেন্ট, ডিবিএইচ, ডোরিন পাওয়ার, এনভয় টেক্সটাইল, গ্রামীণফোন, এইচআর টেক্সটাইল, আইডিএলসি, ইনডেক্স অ্যাগ্রো, ইসলামী ব্যাংক, কেডিএস লিমিটেড, খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (কেপিসিএল), কাট্টলী টেক্সটাইল, মালেক স্পিনিং, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল পলিমার, ওরিয়ন ফার্মা, পদ্মা অয়েল, রেনাটা, রবি, সাইহাম কটন, শাশা ডেনিমস, সোনালী পেপার, সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স, শাইনপুকুর সিরামিকস, শাহজিবাজার পাওয়ার, সামিট পাওয়ার ও ইউনাইটেড পাওয়ার।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।