সংখ্যার চেয়ে মান গুরুত্বপূর্ণ


কেবল বাংলাদেশ নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা উপমহাদেশে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, প্রথমে স্কুল হিসাবে যাত্রা শুরু করে পরবর্তীকালে কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নিয়েছে। কলেজ হিসাবে যাত্রা শুরু, পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়; এসবের উজ্জ্বল উদাহরণ হিসাবে রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা), আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় (উত্তরপ্রদেশ) ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় (পশ্চিমবঙ্গ), ভারত। ব্রিটিশ আমলে আমাদের দেশে প্রকৌশল শিক্ষার মহিরুহ হিসাবে পরিচিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েরও যাত্রা শুরু হয়েছিল স্কুল হিসাবে। স্কুল থেকে কলেজ এবং কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়; বুয়েট (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়)। আজকের রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) এবং ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) কথাই ধরা যাক। পাকিস্তান আমলে পাঁচ বছরের ব্যবধানে (১৯৬৪-১৯৬৮) রাজশাহী (১৯৬৪), খুলনা (১৯৬৭) ও চট্টগ্রামের (১৯৬৮) বিভাগীয় শহরে একটি করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৮০ কিংবা ১৯৮৩ সালে। যুগের চাহিদা অনুযায়ী, উল্লিখিত কলেজগুলোর প্রতিটি আশির দশকে (১৯৮৬) বিআইটি (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, রাজশাহী; বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, খুলনা; বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, ঢাকা) হিসাবে উন্নীত করা হয়। এভাবে চলার পর ২০০৩ সালে ৪টি প্রতিষ্ঠানকেই আইনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এভাবে আমরা পাই আজকের বিখ্যাত রুয়েট, কুয়েট, চুয়েট ও ডুয়েট। ঐতিহ্যবাহী বুয়েট (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়)-সহ দেশের পাঁচটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটিই একসময় কলেজ স্তরের প্রতিষ্ঠান ছিল। ২. ঢাকা কলেজ (স্থাপিত : ১৮৪১), ইডেন সরকারি মহিলা কলেজ (১৮৭৩), ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন সরকারি কলেজ (১৯০৮), চট্টগ্রাম কলেজ (১৮৬৯), রাজশাহী কলেজ (১৮৭৩), বরিশালের সরকারি ব্রজমোহন কলেজ (১৮৮৯), কুমিল্লার সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ (১৮৯৯), ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ (১৯১৮), রংপুরের সরকারি কারমাইকেল কলেজ (১৯১৬), পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ (১৮৯৮), বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ (১৯৩৯), যশোরের সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ (১৯৪১), সিলেটের সরকারি মুরারিচাঁদ কলেজ (১৮৯২)। প্রতিষ্ঠাকালসহ এখানে ১৩টি কলেজের নাম উল্লেখ করা হলো। নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স পড়ানো হয় দেশের এমন আরও বেশকটি বিখ্যাত কলেজকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে ঘোষণার দাবি জানায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা। ক্লাস ও দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড বন্ধ রেখে কলেজে কলেজে বিক্ষোভ মিছিল, সড়ক অবরোধ ও পথসভাসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। আন্দোলনকারীরা কোথাও কোথাও কলেজের সাইনবোর্ড নামিয়ে সেখানে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ লেখাবিশিষ্ট সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেয়। কলেজে কলেজে সে কী অস্থিরতা! উপর্যুপরি দাবি ও আন্দোলনের মুখে কোনো কোনো কলেজে আকস্মিক বন্ধ করে দেওয়া হয় একাদশ শ্রেণির ভর্তি কার্যক্রম। কলেজগুলোয় বছরের পর বছর উচ্চমাধ্যমিক কার্যক্রম বন্ধ রেখে কেবল ডিগ্রি (পাশ ও অনার্স) এবং মাস্টার্সের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া হয়। আকস্মিক উচ্চমাধ্যমিক বন্ধ করে দেওয়ার ফলে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। কারণ, ভালো মানের উচ্চমাধ্যমিক কলেজগুলোকেই মূলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘Feeder College’ হিসাবে গণ্য করা হয়। কিন্তু কলেজসংশ্লিষ্টরা এতে আশ্ব^স্ত হন ভেবে, এ বুঝি কলেজটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেল। কারণ দীর্ঘদিন ধরে চলমান উচ্চমাধ্যমিক কার্যক্রম বন্ধ হওয়া মানে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার পথে একধাপ এগিয়ে যাওয়া। এভাবেই গড়াতে থাকে মাস, বছর, এমনকি বছরের পর বছরও। কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার সরকার গঠনের (২০০৯-২০১৪) পর কলেজে কলেজে আবারও উচ্চমাধ্যমিক স্তর চালু করা হয়। টানা দুই বছর, পাঁচ বছর, এমনকি আট-দশ বছর কলেজগুলোতে উচ্চমাধ্যমিক কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছিল। ঢাকা কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, রাজশাহী কলেজ, আনন্দ মোহন কলেজ, কারমাইকেল কলেজ, ব্রজমোহন কলেজ, মাইকেল মধুসূদন কলেজ, আজিজুল হক কলেজ-এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানে। বলে রাখা দরকার, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি (১৯৯৫) থেকে শুরু করে ২০০৫ সাল পর্যন্ত উল্লিখিত নানা কর্মসূচি পালনসহ আন্দোলনের অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে অবশেষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তব রূপ পায়। জগন্নাথ কলেজের বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া (২০০৫) সে এক ভিন্নকথা এবং এর প্রেক্ষাপটও অনেকটা ভিন্ন। সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। ৬৪ জেলার দেশে ৫৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়; কম কথা নয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশসেরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে (আনন্দ মোহন, ব্রজমোহন, ভিক্টোরিয়া, মুরারিচাঁদ, আজিজুল হক কলেজ) বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দিলে লাভ কিংবা ক্ষতি কেমন হতো, তা হয়তো সঠিকভাবে কেবল ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। বিমল সরকার : কলাম লেখক; অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক