সংঘাতে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র


জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অপরাধীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার পাশাপাশি সবাইকে সহিংসতা, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সোমবার ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ আহ্বান জানান। এদিকে অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিরোধী মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার ক্লেমো ভউল। ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, অক্টোবরে প্রাক নির্বাচনি মিশন ঢাকায় আসবে। তবে বিদেশিদের এই তৎপরতাকে খুব বেশি আমলে নিচ্ছে না সরকার। বিদেশিদের তৎপরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘বাংলাদেশ বিশ্বের কোনো পাঞ্চিং ব্যাগ (মুষ্টিযোদ্ধারা যে ব্যাগের ওপর ঘুসি দেয়) নয়। বাংলাদেশ হলো উন্নয়নের মিরাক্যাল। শেখ হাসিনার বাংলাদেশ কোনো সহজ জায়গা নয়। আমরা আইনের শাসন জোরদারে কাজ করছি। নির্বাচন হবে নির্ধারিত প্রক্রিয়ায়।’ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘গণমাধ্যমে ওপেন মন্তব্য নিয়ে আমরা কোনো প্রতিক্রিয়া দেব না। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের অফিশিয়ালি কিছু জানালে প্রতিক্রিয়া দেব। যুক্তরাষ্ট্র যদি আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করতে চায় তবে আমরা দেখব।’ জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন মঙ্গলবার বলেন, ‘ভেতরে ভেতরে কী কথাবার্তা হচ্ছে পুরোপুরি জানি না। তবে বিরাজমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে পশ্চিমের মতামতকে একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। সরকার হয়তো চাইছে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না। তবে রাজনীতিবিদদের প্রাথমিক লক্ষ্য থাকে ক্ষমতায় যাওয়া। সেক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনরা হয়তো চাইতে পারে যে, ইলেকশনটা পার করি। এ ধরনের চেষ্টা হলে যুক্তরাষ্ট্রের এমন উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি আসতেই থাকবে। তিনি আরও বলেন, আজকাল কোনো কিছুই আড়াল করা যায় না। গয়েশ্বর রায়কে যে পুলিশ পিটিয়েছে সেই ভিডিও মুহূর্তের মধ্যে চলে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রও সেই সুযোগ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। সহিংসতা না হলে বিবৃতি দেওয়ার সুযোগ পেত না। তৌহিদ হোসেন মনে করেন, নির্বাচন পর্যন্ত যে কোনো লঙ্ঘনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ জানানো অব্যাহত রাখবে বলে আপাতত মনে হচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে রাজধানী ঢাকায় লাখ লাখ মানুষ বিক্ষোভ মিছিল করেছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে, শনিবার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের সময় বিক্ষোভকারী এবং বিরোধী নেতাদের ওপর পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা নৃশংসভাবে হামলা চালিয়েছে। এতে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতা গয়েশ্বর রায়সহ শতাধিক আহত হন। ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি, বিরোধী দলের প্রতি সরকারের আপাত কট্টরপন্থি অবস্থান ও পুলিশের বর্বরতাকে আপনি কীভাবে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করছেন? বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে স্টেট ডিপার্টমেন্ট কী পদক্ষেপ নেবে? জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, সপ্তাহান্তের প্রতিবাদ কর্মসূচিকে ঘিরে বাংলাদেশে ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং রাজনৈতিক সহিংসতার খবরে আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে সহিংসতার খবরগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে এবং সহিংসতার ঘটনায় দোষীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে উৎসাহিত করি। মানুষ যাতে শান্তিপূর্ণভাবে একত্রিত হতে পারে এবং তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে, এমন একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করার জন্য আমরা বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানাই। সেই সঙ্গে আমরা সব পক্ষকে মৌলিক স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনকে সম্মান করার আহ্বান জানাই। এছাড়া সবাইকে সহিংসতা, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই। তিনি বলেন, পরিশেষে আমি বলব, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ভোটার, রাজনৈতিক দল, যুব শাখা ও পুলিশ-সবার প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করে। যা রাজনৈতিক সহিংসতার পরিবেশে অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। ব্রিফিংয়ে আরেক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, জনগণ-আমরা, সবাই জানি বাংলাদেশ জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য ভিসানীতিও ঘোষণা করেছে। এছাড়াও ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে নিশ্চিত করেছেন। তবে, বিরোধীরা গত সপ্তাহে দেশের রাজধানীতে অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাস ও ভাঙচুর চালিয়েছে। তারা জনগণের সম্পদের ওপর হামলা চালানোর পাশাপাশি পুলিশের সম্পত্তিতে হামলা চালিয়েছে। সেখানে তারা সবকিছু পুড়িয়ে দিয়েছে। তারা রাজধানীতে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তারা নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে এসব করছে, যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী? জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, এ প্রসঙ্গে আমার মন্তব্যটি আগের প্রশ্নের উত্তরে করা মন্তব্যের মতোই। ওই সাংবাদিক বলেন, আরেকটি বিষয়ে আমি আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই। ১৫ জুন একটি বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা আবেদন নিয়ে কানাডার ফেডারেল আদালত বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য বিএনপিকর্মীর আবেদন প্রত্যাখ্যানের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার ওই আবেদন করা হয়েছিল। এ নিয়ে পঞ্চমবারের মতো ওই দলকে তারা সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে আখ্যা দিলেন। ওই বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো পর্যবেক্ষণ নেই।’ এদিকে সভা-সমাবেশের অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার ক্লেমো ভউল বাংলাদেশ সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, ‘সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য বিরোধী মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি।’ সোমবার রাতে এক টুইটার (এক্স) পোস্টে তিনি এ মন্তব্য করেন। টুইটে হ্যাশট্যাগ বাংলাদেশ লিখে ক্লেমো ভউল লিখেছেন, ‘চলমান বিক্ষোভ সমাবেশে সংঘাত ও গ্রেফতারের মাত্রা বাড়ছে, এ অবস্থায় সব পক্ষকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’ টুইটে তিনি আরও বলেন, ‘দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোকে বলব, তারা যেন সভা-সমাবেশের অধিকার নিশ্চিতে কাজ করে এবং বাড়তি বাহিনী মোতায়েন না করে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য বিরোধী মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা জরুরি।’ বাংলাদেশের পতাকার একটি চিত্র জুড়ে দিয়ে টুইট করেন জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার। গত বছরের ডিসেম্বরে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দমন-পীড়ন এবং ২০২১ সালের মে মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরকালে বিক্ষোভকারীদের দমন নিয়ে পৃথক বিবৃতি দিয়েছিলেন জাতিসংঘের এই বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার। মঙ্গলবার টুইট শেয়ার করে তিনি ওই দুটি বিবৃতিও যুক্ত করে দিয়েছেন। বিশ্বাসযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন চায় জাতিসংঘ : জাতিসংঘ বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ, বিশ্বাসযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন চায় বলে জানিয়েছেন মহাসচিবের উপমুখপাত্র ফারহান হক। সোমবার জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্রের কার্যালয়ে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা জানান। ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিক বলেন, আপনার কাছে আমার দুটি প্রশ্ন। ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তা সত্ত্বেও তথাকথিত সুশীল সমাজের কিছু লোক, মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা কিছু সংগঠন, এমনকি মার্কিন কংগ্রেসের কিছু নির্বাচিত সদস্য জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন থেকে বাংলাদেশকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছেন। আপনি কি এই ধরনের দাবির বিষয়ে অবহিত? এখানে আমি আরও উল্লেখ করতে চাই, সেই তথাকথিত সুশীল সমাজ ও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত কিছু ব্যক্তি বাংলাদেশের আসন্ন সংসদ নির্বাচন জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে করার পরামর্শ দিয়েছেন। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সে লক্ষ্যে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো অবাধে সভা-সমাবেশ শুরু করেছে। বাংলাদেশে তাদের সংগঠন কি সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের সঙ্গে হস্তক্ষেপ করবে? এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের অবস্থান কী?’ জবাবে ফারহান হক বলেন, প্রশ্ন দুটির ক্ষেত্রে প্রথমত নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ, বিশ্বাসযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনকে উৎসাহিত করে। জাতিসংঘ সত্যিকার অর্থেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের উদারতার প্রশংসা করে। আমরা আশা করি, এটি অব্যাহত থাকবে। মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য পদ নিয়ে মন্তব্য করা আমার দায়িত্বে পড়ে না। এ বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলো সিদ্ধান্ত নেবে।