ডিজিটাল ক্র্যাকডাউন
ইতিহাসের ভয়াবহ ডিজিটাল ক্র্যাকডাউনে পড়ে বাংলাদেশ। জুলাইয়ের শেষ ১৫ দিন ডিজিটাল দুনিয়া থেকে দেশকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে একাধিকবার দেশব্যাপী মোবাইল ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট শাটডাউন করে তৎকালীন সরকার। এতে জনজীবনে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের পাশাপাশি সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি হয়েছে ক্ষুণ্ন।
সাইবার অধিকার ফিরে পাওয়ার বছরপ্রথমে ১৭ জুলাই রাতে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই রাত ৯টার পর সারা দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। টানা পাঁচ দিন সব ধরনের ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। ডিজিটাল বাংলাদেশ ফিরে গিয়েছিল অ্যানালগ যুগে। এরপর ব্রডব্যান্ড স্বল্প পরিসরে ফিরলেও মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ ছিল ১০ দিন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটক, মেসেঞ্জার সেবা বন্ধ ছিল সর্বমোট ১৩ দিন, ইন্টারনেট চালু করলেও এসব প্ল্যাটফরম ব্লক রাখা হয়েছিল আরো তিন দিন।
পরে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দেশব্যাপী মোবাইল ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট শাটডাউনের কারণ এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা খোঁজে। গঠন করা হয় সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ১৫-১৬ জুলাইয়ে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ থেকে ২৩ জুলাই ও ৫ আগস্টে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ ও চালু করার বিষয়টি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রশাসনিক অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের মৌখিক নির্দেশক্রমে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মহিউদ্দিন আহমেদের নির্দেশনায় এই কাজ করা হয়েছে। ১৭ থেকে ২৮ জুলাই এবং ৫ আগস্টে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ ও চালু করার বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) নির্দেশনায় করা হয়।
ই-ক্যাবের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তত এক হাজার ৭০০ কোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে ইন্টারনেট শাটডাউনের ফলে। ক্ষতির অংক বাস্তবে আরো বেশি হতে পারে। অনেক ফ্রিল্যান্সার ও রিমোট ওয়ার্কার এ সময় ইন্টারনেটের সন্ধানে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।
টেলিকম ও তথ্য-প্রযুক্তির দায়িত্বে উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম দায়িত্ব নেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। পূর্ববর্তী সরকারের ব্যর্থতা ও চরম দুর্নীতি উদঘাটন এবং বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তি খাতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে তিনি ও তার মন্ত্রণালয় জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।
টেলিকম ও তথ্য-প্রযুক্তির নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতি
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বেরিয়ে আসে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগে একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর, যা ব্যাপক আলোচিত হয়। দুর্নীতির ব্যাপকতা এতটাই চরমে পৌঁছেছিল যে তথ্য-প্রযুক্তি খাতের ২১টি প্রকল্পে এ বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষেও প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা সাশ্রয়ের সুযোগ রয়েছে। এখন উদ্যোগ নিলেও রাষ্ট্রের এই বিপুল অর্থ বাঁচানো সম্ভব—এমনটাই জানিয়েছে তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের অনিয়ম ও দুর্নীতি খুঁজতে গঠিত তদন্ত কমিটি।
বিভিন্ন প্রকল্পে অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, অসংগতি, দুর্বলতা, আর্থিক ক্ষতি, অসম চুক্তি, সুবিধাভোগী নির্বাচনে অস্বচ্ছতা, জনবল নিয়োগে অনিয়ম, অনৈতিকতা, একই কাজ বহুবার করে অর্থ অপচয়ের মতো বিভিন্ন অনিয়ম চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি। একই অবস্থা টেলিযোগাযোগ বিভাগেও। হাজার হাজার কোটি টাকা অনিয়মের নজিরও এ বিভাগে পাওয়া গেছে।
ডেটা সেন্টার কেলেঙ্কারি
বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ফাঁস হয়, দেশের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ডেটা-নথি এক ‘অদৃশ্য কারণে’ দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এটুআইয়ের ব্যবস্থাপনায় থাকা ৩৪ হাজার সরকারি দপ্তর, সরকারি তথ্য ব্যবস্থাপনাসহ সরকারি সব তথ্য গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত হাইটেক পার্কের বিডিসিসিএল ফোর টায়ার ডেটা সেন্টারে সংরক্ষিত থাকার কথা ছিল। অথচ বিডিসিসিএল সেসব গোপনীয় তথ্য পাঠিয়েছে ওরাকলের ওসিআই সিঙ্গাপুরের ডেটা সেন্টারে। সরকারের এক হাজার ৬০০ কোটি ঋণের টাকায় বানানো নিজস্ব ক্লাউড সিস্টেমকে সচল না করে ওরাকলের সঙ্গে এক কোটি ৮০ লাখ ডলারে করা তিন বছরের এই চুক্তি নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা এখনো চলছে। ডেটা সেন্টারটি তৈরিতে অনিয়মের মাত্রা এতটাই যে ২৩ জুন মূল বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে শুধু ব্যাক আপ সিস্টেম কাজ করেনি তা-ই নয়, ডেটা সেন্টার মেরামত ও চালু করায়ও চরম অবহেলা ছিল লক্ষণীয়।
তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক বাণিজ্যিক সংগঠনে পদত্যাগের হিড়িক
২০ আগস্ট বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) কার্যনির্বাহী কমিটির সব সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন। এরপর ২ সেপ্টেম্বর এক তলবি সভার মাধ্যমে স্মার্ট টেকনোলজিসের এমডি মোহাম্মদ জহিরুল ইসলামকে অন্তর্বর্তী আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়। সমিতির এই সিদ্ধান্ত ডিটিও অনুমোদন করেনি। পরে সেপ্টেম্বরে সংগঠনটিতে প্রশাসক দেয় সরকার। সফটওয়্যার খাতের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসেও (বেসিস) প্রশাসক দেওয়া হয় ডিসেম্বরে। সংগঠনটির নেতাদের পদত্যাগ নিয়ে জটিলতা, পক্ষ-বিপক্ষ রেষারেষিতে এক ধরনের অচলাবস্থায় সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়।
সেপ্টেম্বরে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশে (ই-ক্যাব) প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। সংগঠনটির সভাপতি শমী কায়সার পদত্যাগ করেন ১৩ আগস্ট। এরপর কার্যনির্বাহী পর্ষদের সব সদস্যই পদত্যাগ করেন। প্রতিটি পদত্যাগের পেছনে ছিল পূর্ববর্তী সরকারের সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে দুর্নীতির অভিযোগ।
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ অনুমোদন
নাগরিকদের সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট পাওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে ডিসেম্বরের শেষ দিকে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়ার অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অধ্যাদেশের ২(ভ) ধারা অনুযায়ী ‘নাগরিকদের সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকার সাইবার সুরক্ষার অন্তর্ভুক্ত হবে।’ বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এই অধ্যাদেশ অনুমোদন দেওয়া হয়, যেখানে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সাইবার বুলিংকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
এক লাইসেন্সে সব ব্যবসা
টেলিযোগাযোগ খাতে মোবাইল অপারেটরদের দীর্ঘদিনের একটি চাওয়া পূরণ হয়েছে এই বছর। একটি লাইসেন্সের আওতায় ফাইভজিসহ সব ধরনের ওয়্যারলেস মোবাইল সেবা দিতে পারবে তারা। আগের টুজি, থ্রিজি, ফোরজি প্রযুক্তি এবং তরঙ্গ ফির জন্য আলাদা লাইসেন্স ও নির্দেশিকা বহাল ছিল। একীভূত লাইসেন্সে ফাইভজির ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত অ্যাকসেস তরঙ্গের প্রাপ্যতা ও ব্যাকহল ফাইবারের পাশাপাশি পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যবহারের অনুমতি, অফশোর ক্লাউড সুবিধা, রোল আউট বাধ্যবাধকতা, নেটওয়ার্ক নিরাপত্তা প্রভৃতি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এ বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি এই গাইডলাইনের অনুমোদন দেয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।