হজের ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাতসমূহ


‘হজ’ এর আভিধানিক অর্থ- ইচ্ছা করা, দৃঢ় সংকল্প করা। আর ইসলামী পরিভাষায় মহান আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের লক্ষ্যে যিলহজ মাসের ৮ তারিখ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান ও বাইতুল্লাহ শরীফ যিয়ারতসহ নির্দিষ্ট কার্যাবলী সম্পাদন করাকে হজ বলে। ইসলামী শরীয়তের পঞ্চম স্তম্ভের মধ্যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। প্রত্যেক সামর্থবান প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের উপর জীবনে একবার হজ ফরয। হজ অস্বীকারকারী কাফির। এই হজের মাধ্যমেই মানুষের দৈহিক, আত্মিক ও আর্থিক ইবাদাতের সমাবেশ ঘটে। এজন্যে শরীয়তে এর গুরুত্বও অপরিসীম। প্রত্যেক সামর্থবান ব্যক্তির উপর হজ ফরয হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন: “আর সামর্থবান ব্যক্তির উপর আল্ল¬াহর জন্য বাইতুল্ল¬াহর হজ করা ফরয।” (আলে ইমরান-৯৭) অপর এক আয়াতে তিনি আরো ইশরাদ করেন: “আর তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হজ ও উমরাহ পালন করো।” (সূরা বাকারা-১৯৬) হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে খুতবাহ দিলেন: “হে মানবজাতি! নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর হজ ফরয করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা হজ করো। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! প্রতি বছর কি হজ করতে হবে? তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। সে তিনবার এরূপ প্রশ্ন করলো। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি যদি ‘হ্যাঁ’ বলতাম, তাহলে প্রতি বছর তোমাদের উপর ফরয হয়ে যেতো; যা তোমাদের পক্ষে পালন করা সম্ভব হতো না।” (মুসলিম-৩৩২১, ৩১৪৮, ইফা.-৩১২৩, তিরমিযী-২৬৭৯, নাসাঈ-২৬১৯, ইবনে মাজাহ-১, ২, আহমাদ-৭৩২০, ৭৪৪৯, ৮৪৫০, ৯২৩৯, ৯৪৮৮, ৯৮৯০, ১০২২৯, ১০৩২৭, হাদীসটি মুসলিমের) হজের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি কোনরূপ অশ্লীল কথা বা গুনাহের কাজে লিপ্ত না হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ সম্পন্ন করলো, সে সদ্য ভূমিষ্ট শিশুর ন্যায় নিস্পাপ হয়ে ফিরে আসলো। (বুখারী-১৫২১, ১৮১৯, ১৮২০, ইফা.-১৪৩১, মুসলিম-১৩৫০, তিরমিযী-৮১১, নাসাঈ-২৬২৭, ইবনে মাজাহ-২৮৮৯, আহমাদ-৭০৯৬, ৭৩৩৪, ৯০৫৬, ৯৯০৪, ১০০৩৭, ১০২৭৮, হাদীসটি বুখারীর) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেছেন: “হাজ্জুল মাবরূর লাইসা লাহু জাযাউন ইল্লাল জান্নাহ” অর্থাৎ, মাবরূব হজের পুরস্কার জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়। (বুখারী-১৭৭৩, ইফা.-১৬৫৮, মুসলিম-১৩৪৯, তিরমিযী-৯৩৩, নাসাঈ-২৬২২, ২৬২৩, ২৬২৯, ইবনে মাজাহ-২৮৮৭, ২৮৮৮, আহমাদ-৭৩০৩, ৯৬২৫, ৯৬৩২, ৯৯৫৫, মালিক-৭৭৬, দারিমী-১৭৯৫, হাদীসটি বুখারীর) মুহাদ্দিসগণ বলেন, যে হজের মধ্যে কোনো প্রকার গুনাহের কাজ হয় না এবং রিয়া ও অহঙ্কার থাকে না; বরং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিই উদ্দেশ্য থাকে, শরীয়তের পরিভাষায় তাকেই ‘হজে মাবরূর’ বলে। হজ মোট তিন প্রকার ১. হজে ইফরাদ : ‘ইফরাদ’ শব্দের অর্থ- একক, অদ্বিতীয়, আলাদা করণ। আর পরিভাষায় উমরাহ ব্যতীত শুধু হজের নিয়ত করে ইহরাম বেঁধে হজের কার্যাবলী সম্পন্ন করাকে ‘হজে ইফরাদ’ বলে। ২. হজে কিরান : ‘কিরান’ শব্দের অর্থ- সংযুক্ত করা, একত্রিত করা, মিলিয়ে নেয়া। আর পরিভাষায় একই সাথে উমরাহ ও হজের নিয়ত করে ইহরাম বেঁধে প্রথমে উমরাহ এরপর (ইহরাম না খুলে) একই এহরামে হজের কার্যাবলী সম্পন্ন করাকে ‘হজে কিরান’ বলে। ৩. হজে তামাত্তু : ‘তামাত্তু’ শব্দের অর্থ- উপভোগ করা, শান্তি পাওয়া, উপকৃত হওয়া। আর পরিভাষায় হজের মৌসুমে প্রথমে শুধু উমরাহ’র নিয়তে ইহরাম বেঁধে উমরাহ পালন করা। তারপর ইহরাম খুলে বিরতি নেয়া। হজের নিয়তে নতুনভাবে ইহরাম বেঁধে হজের কার্যাবলী সম্পন্ন করাকে ‘হজে তামাত্তু’ বলে। এই তিন প্রকার হজের মধ্যে ‘তামাত্তু’ উত্তম। কারণ এতে উমরাহ পালনের পর ইহরাম খুলে কিছুটা স্বস্তি ও প্রশান্তি লাভের সুযোগ রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটাই পালন করেছেন। হজের ফরয ৩টি (১). মীক্বাত থেকে ইহরাম বাঁধা। (উল্লেখ্য, বাংলাদেশীদের মীক্বাত তথা ইহরাম বাঁধার স্থান হচ্ছে ‘ইয়ালামলাম; যা জিদ্দা এয়ারপোর্টের পূর্বে অবস্থিত। সুতরাং বাংলাদেশ থেকে হজ পালনকারীদের জন্য বাড়ী অথবা হাজীক্যাম্প থেকে ইহরামের কাপড় পরিধান করে দু’রাকাআত নামাজ পড়ে ইহরামের নিয়ত করে নিতে হবে)। (২). ৯ই যিলহজ যোহরের পর থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা। (৩). ১০ই যিলহজ সুবহে সাদিকের পর থেকে নিয়ে ১২ই যিলহজ সূর্যাস্তের পূর্বে বাইতুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করা (একে তাওয়াফে যিয়ারাহ বলা হয়)। হজের ওয়াজিব ৬টি (১). ৯ই যিলহজ সূর্যাস্তের পর আরাফা হতে এসে পরবর্তী সূর্যোদয় পর্যন্ত মুযদালিফায় অবস্থান করা। (২). মিনায় শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ করা (একে ‘রমী’ বলে)। (৩). কুরবানী করা (শুধুমাত্র হজে তামাত্তু ও কিরান আদায়কারীদের জন্য ওয়াজিব)। (৪). ইহরাম খোলার জন্য মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছাটা। (৫). বিদায়ী তাওয়াফ করা। (মীক্বাতের বাইরের লোকদের জন্য)। (৬). সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয় সায়ী করা। হজের সুন্নাত ও মুস্তাহাব ৯টি (১). হজে ইফরাদ ও কিরান আদায়কারীদের জন্য তাওয়াফে কুদূম তথা মক্কায় প্রবেশের পর প্রথমেই তাওয়াফ করা। (২). ৮ই যিলহজ মক্কা থেকে মিনায় গিয়ে যোহর, আসর, মাগরিব, ইশা ও ফজর এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা এবং রাতে মিনায় অবস্থান করা। (৩). ৯ই যিলহজ সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে আরাফার ময়দানের দিকে রওয়ানা হওয়া। (৪). ৯ই যিলহজ সূর্যাস্তের পর আরাফার ময়দান থেকে মুযদালিফার দিকে রওয়ানা হওয়া। (৫). উকূফে আরাফার জন্য সেদিন যোহরের পূর্বে গোসল করা। (৬). ১০, ১১, ও ১২ই যিলহজ দিবাগত রাতগুলোতে মিনায় অবস্থান করা। (৭). মীনা হতে বিদায় হয়ে মক্কায় আসার পথে মুহাস্সাব নামক স্থানে কিছু সময় অবস্থান করা উত্তম। (৮). ইমামের জন্য তিন স্থানে খুৎবা দেয়া। ৭ই যিলহজ মক্কায়, ৯ই যিলহজ আরাফায় এবং ১১ই যিলহ্জ্জ মিনায়। (৯). তাওয়াফে কুদূমের প্রথম তিন চক্করে রমল করা। তাওয়াফে কুদূমে রমল না করে থাকলে তাওয়াফে যিয়ারতে রমল করবে। (শামী, আলমগীরী, রাহমানিয়া-১ম খণ্ড) বাইতুল্লাহ শরীফ তাওয়াফের সুন্নাত তরীকা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে বিশুদ্ধ নিয়তে কা’বা ঘরের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলে। হজ পালনকারীদের জন্য যিলহজ মাসের ১০ তারিখ সুবহে সাদিকের পর থেকে নিয়ে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে বাইতুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করা ফরয। নিম্নে চিত্রের সাহায্যে তাওয়াফ করার নিয়ম উল্লেখ করা হলো : ১. পবিত্র কা’বা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে তাওয়াফ করবে। ২. হাজরে আসওয়াদের পূর্ব পাশ থেকে তাওয়াফ আরম্ভ করবে। ৩. সম্ভব হলে প্রত্যেক চক্করের শুরুতে এবং শেষে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করবে। অন্যথায় হাজরে আসওয়াদের বরাবর এসে হাতের ইশারায় চুম্বন করবে। (বুখারী-১৬০৩) ৪. অধিক ভীড়ের সময় ধাক্কাধাক্কি করে কাউকে কষ্ট দিয়ে চুম্বন করবে না। কেননা, চুম্বন করা সুন্নাত, পক্ষান্তরে অন্যকে কষ্ট দেয়া হারাম। ৫. তাওয়াফের সময় তালবিয়া পাঠ বন্ধ রাখবে; বরং বিভিন্ন মাসনূন দুআ পাঠ করবে। ৬. পুরুষগণ তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে ‘রমল’ (দ্রুত) করবে। ৭. কা’বা ঘরকে বাম পার্শে রেখে তাওয়াফে করবে। ৮. পুরুষগণ তাওয়াফের সময় ‘ইজতিবা’ করবে (অর্থাৎ চাদরের মধ্যভাগ ডান বগলের নিচে দিয়ে দু’পাশকে বাম কাঁধের উপর রাখবে এবং ডান কাঁধ খোলা থাকবে। কেননা, রাসূল সা. তাওয়াফের সময় ইজতিবা করতেন। (আবু দাউদ-১৮৮৫) ৯. তাওয়াফ ছাড়া অন্য কোনো সময় ইজতিবা করবে না এবং নফল তাওয়াফের সময়ও ইজতিবা করবে না। ১০. সম্ভব হলে রুকনে ইয়ামেনীর কাছে পৌঁছার পর ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে তা (রুকনে ইয়ামানী) স্পর্শ করবে। তবে চুম্বন করবে না। ১১. রুকনে ইয়ামান ও হাজরে আসওয়াদের মাঝে এই দুআ পাঠ করবে- (রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানা...) অর্থাৎ, হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান করুন এবং পরকালেও কল্যাণ দান করুন। আর আমাদেরকে রক্ষা করুন জাহান্নামের আযাব থেকে। (সূরা বাকারা-২০১, আবু দাউদ-১৮৯৪, মুসনাদে আহমাদ-১৫৩৯৮) ১২. মাকামে ইবরাহীমে গিয়ে এই দুআ পাঠ করবে- (অত্তাখিজু মিন মাকামি ইবরাহীমা মুসল্লা...) (সহীহ মুসলিম-৩০০৯) ১৩. তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহীমের পিছনে অথবা হারামের যেকোনো স্থানে দাঁড়িয়ে দু’রাকাআত নামাজ আদায় করবে। (সহীহ বুখারী-১৬০০) এমর্মে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি কা’বা ঘর তাওয়াফ করবে। অতঃপর দুই রাকাআত নামাজ আদায় করবে, সে একটি গোলাম আযাদ করার সওয়াব লাভ করবে। (ইবনে মাজাহ-২৯৫৬, তিরমিযী-৯৫৯, হাদীসের শব্দাবলী ইবনে মাজার) ১৪. নামাজ পড়ার পর যমযমের কূপ থেকে পানি পান করবে এবং প্রাণ ভরে দুআ করবে। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে হজ পালন করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমীন লেখক : মুফতী মুহাম্মাদ আবদুর রহমান আজাদ খলিফা : শাইখুল হাদীস মুফতী জাফর আহমাদ (ঢালকানগর) ও শায়েখ সাঈদুর রহমান আল-মাদানি (মদিনা মুনাওয়ারা)