হাসপাতালেই ঈদ কাটবে জুলাই বিপ্লবে আহতদের


হাসপাতালেই ঈদ কাটবে জুলাই বিপ্লবে আহতদের
মঙ্গলবার, ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ২টা। জাতীয় অর্থোপেডিকস ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান নিটোর তথা পঙ্গু হাসপাতালের চতুর্থ তলায় ‘এ’ ওয়ার্ডের ৪৮ নম্বর শয্যায় বসে ফল খাচ্ছিল জুলাই বিপ্লবে আহত ১০ বছরের শিশু নাবিল। পাশেই ৪৭ নম্বর শয্যায় ভর্তি আরেকজন মনির হোসেন (৩০)। তার ৪ বছর বয়সি শিশু ইসমাইল জুতা হাতে নিয়ে মেঝেতে খেলছে। বাবার চিকিৎসার কারণে টানা ৮ মাস ধরে এভাবেই হাসপাতালে দিন কাটছে তার। শুধু নাবিল কিংবা বাবার সঙ্গে থাকা ইসমাইলই নয়, জুলাই বিপ্লবে আহত হয়ে বর্তমানে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৯৭ জনের কারও মনেই নেই ঈদের আমেজ। কারণ তারা এবারের ঈদে বাড়ি ফিরতে পারছে না। পরিবার-পরিজন ছাড়া হাসপাতালেই কাটবে ঈদ। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।জুলাই আন্দোলনে আহত শিশু নাবিলের মা নাজমা বেগম বলেন, তাদের বাড়ি সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর। ছেলে ৪ আগস্ট বিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে ছাত্র-জনতা ও পুলিশের মাঝে পড়ে যায়। ওই সময় দুই পায়ের ঊরু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত পুলিশের ছোড়া শতাধিক ছররা গুলি এসে লাগে। তারপর থেকে চিকিৎসা চলছে। মাঝে রিলিজ দিলে বাড়ি নিয়ে যাই। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় ১১ ডিসেম্বর ফের ভর্তি করেছি।অশ্রুসিক্ত চোখে নাজমা বেগম ছেলের এক্সরে ফিল্ম দেখিয়ে বলেন, এখনো ডানে পায়ে ৪৮ এবং বাম পায়ে ১৩টার মতো ছররা গুলি রয়ে গেছে। সারাক্ষণ ব্যথা করে। এমন পরিস্থিতিতেও ঈদে বাড়ি যাওয়া ও কেনাকাটার জন্য বায়না ধরছে। কিন্তু ছেলে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে, বসে বা হাঁটতে পারে না। তাই বাড়ি যাওয়া সম্ভব হবে না।শিশু নাবিল বলে, বাবার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নেই। মা সাভারে গার্মেন্টেসে কাজ করে। গত ৮ মাস আমার সঙ্গে হাসপাতালে। ছোট দুই ভাইবোন নানা-নানির কাছে থাকে। ঈদ উপলক্ষ্যে নানা আমার জন্য একজোড়া জুতা কিনেছে। মাকে নতুন পাঞ্জাবির কথা বলেছি। কাল কিনে দেবে।পাশের শয্যায় চিকিৎসাধীন মনির হোসেনের স্ত্রী ফাতেমা বেগম বলেন, তার স্বামী ২০ জুলাই গাজীপুর এলাকায় আন্দোলনে গিয়ে দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। এখন পর্যন্ত ১৩ বার অস্ত্রোপচার হয়েছে। আরও কয়েকবার হবে। দিনকয়েক হলো ডান পায়ের ইলিজার্ভ (লোহার রিং) খুলে দিয়েছে। এখনো ঠিকমতো বসা ও হাঁটতে পারে না। বিছানাতেই পায়খানা-প্রস্রাব করে।ঈদ কোথায় করবেন জানতে চাইলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফাতেমা বেগম বলেন, ২০ জুলাই স্বামী আহত হওয়ার পর থেকে আমি, বাবা ও বড় ভাই হাসপাতালে সেবা-শ্রশ্রূষা করছি। সঙ্গে ৪ বছরের ছেলে রয়েছে। চিকিৎসা বাবদ কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ৮ মাসের বাড়ি ভাড়া বকেয়া পড়ছে। লাখ টাকার মতো দেনা। স্বামী পোশাক কারখানায় ৩০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন। গত ঈদেও আমাকে থ্রি-পিস, ছেলের প্যান্ট, গেঞ্জি, জুতা, চশমা ও খেলনা কিনে দিয়েছিলেন। পরিবারের সবার নতুন পোশাক দিয়েছিলেন। এবার কিছুই পারবে না। ঈদের চিন্তা দূরের কথা বাড়িও যেতে পারব না।নাদিম হোসেন নামে আরেক আহত যুবক অভিযোগ করেন, ‘জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়ে পায়ে গুলিবিদ্ধ হই। বাম পায়ে ৬ ইঞ্চি হাড় নেই। ৬ মাস ধরে চিকিৎসা নিচ্ছি। পায়ে ইলিজার্ভ পরানো। তবে ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করতে পারি। পরিচালক স্যারকে বলছি লিখিত নিয়ে ঈদের ছুটি দেন। পরিচালক জানিয়েছেন বাড়ি যেতে চাইলে রিলিজ (ছাড়পত্র) নিয়ে যেতে হবে। ঈদের পর এলে নতুন করে ভর্তি হতে হবে। কিন্তু বাড়ি থেকে এসে শয্যা ফাঁকা নাও পেতে পারি। তাই হাসপাতালে থেকে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না।’৪ আগস্ট থেকে চিকিৎসাধীন আছেন মঞ্জুরুল হক (২৪)। তাকে দেখাশোনা করছেন ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সানজিদা। তিনি বলেন, দিন যত যাচ্ছে আমার সন্তান প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু হাসপাতালে স্বামীকে দেখার মতো কেউ নেই। ইচ্ছে থাকলেও ঈদে বাড়ি যেতে পারছি না। হাতে টাকা-পয়সাও নেই।মডেল-বি ওয়ার্ডের ৯ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন মো. আবুল কালাম আজাদ (৪৮) বলেন, আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় ১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জ সদরে পুলিশের বেধড়ক পিটুনিতে কুনুইয়ের হাড় ভেঙে যায়। সেখান থেকে নার্ভ ইনজুরি হয়। ডান হাতে খাবার খেতে পারি না। কোনো কিছু ধরতে পারি না। ৫ মাস ধরে এখানে ভর্তি আছি। প্রতিদিন ফিজিওথেরাপি, অক্স থেরাপি, ভেইন থেরাপি নিচ্ছি। হাতে সাপোর্টিং ডিভাইস পরিয়ে রাখছি। ভাবছিলাম ঈদে বাড়ি যেতে পারব। তবে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন নিয়মিত থেরাপি না নিলে হাত ঠিক হবে না। তাই বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না।তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বাড়িতে অসুস্থ মা, স্ত্রী, ছেলে মেয়েরা পথ চেয়ে আছে। ছেলে জুতা, জামা চেয়েছে। নাতিদের আবদার আছে। আমার কোনো ইনকাম নেই। বাড়িতে ঈদ বাজার পর্যন্ত করা হয়নি। একদিনের জন্য ছুটি পেলেও বাড়ি যাব।হাসপাতালের তৃতীয় তলায় পি-২৪ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন ১৫ বছরের কিশোর আলিফ শেখ। সে বলে, ২০ জুলাই সাভার অন্ধ মার্কেটের ফুটওভার ব্রিজের পাশে পুলিশের ছোড়া ২৫টার মতো স্পি­ন্টার ডান হাত ও পায়ে লাগে। পাঁচটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে কিছু স্পি­ন্টার বের করা হয়। ৫ আগস্ট দুপুরে হাসিনার পলায়নের খবর পেয়ে আমি, আব্বু, আম্মু ছোট বোন, চাচ্চু সবাই বেরিয়ে আসি। হঠাৎ এনাম মেডিকেলের বিপরীত পাশে পুলিশ আমাকে ঘিরে ফেলে। একজন পুলিশ সদস্য আমার পায়ে পাড়া দিয়ে ধরে। আরেকজন মাথায় বন্দুক তাক করে। আরেকজন মারতে থাকে। একজন ডান পায়ের তিন আঙুল ওপরে রাইফেল দিয়ে গুলি করলে পা ভেদ করে বের হয়ে গুলি মাটিতে ঢুকে যায়। এরপর পাঁচটি হাসপাতালে চারবার অস্ত্রোপচার হয়েছে।ঈদের পর আরও একটা হবে। সবশেষ ২৮ জানুয়ারি থেকে এখানে ভর্তি। পায়ে ইলিজার্ভ পরানো, হাঁটতে পারি না। আলিফ বলে, আগে ঈদে আব্বু-আম্মুর সঙ্গে ফুপিদের বাড়ি যেতাম। মজা করতাম। এবার হাসপাতালে ঈদ করতে হবে। ঈদে কিছু কেনার আগ্রহ নেই। তবে আব্বু বলেছে চাঁদরাতে বোনাস পেলে পাঞ্জাবি কিনে দেবে। এছাড়া ঈদে মামা একটা গিটার কিনে দিয়েছে।চিকিৎসক-কর্মকর্তাদের কৃতজ্ঞতা স্মারক দিলেন জুলাই যোদ্ধারা : দীর্ঘদিন চিকিৎসাসেবা দেওয়ায় রাজধানীর চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মকর্তাদের কৃতজ্ঞতা স্মারক দিয়েছেন জুলাই যোদ্ধারা। মঙ্গলবার হাসপাতালের কনফারেন্স রুমে কৃতজ্ঞতা স্মারক তুলে দেওয়া হয়। এ সময় হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক খায়ের আহমেদ চৌধুরী, সহকারী পরিচালক ডা. রেজওয়ানুর রহমান সোহেল, সহকারী অধ্যাপক ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা, সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেজবাহুল আলম, অধ্যাপক ডা. আবদুল কাদের, জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. সঞ্জয় কুমার সরকার ও ডা. আবিদ মজিদসহ কর্মকর্তাদের হাতে কৃতজ্ঞতা স্মারক তুলে দেওয়া হয়।জুলাইযোদ্ধা আলাল আহমেদ বলেন, ৬ মাস তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাদের সেবা দিয়েছেন। আমরা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাদের এই ক্রেস্ট দিলাম। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন জুলাই আহত সেলিম আহমেদ, সালমান ও মতিন।