১০ দিন অন্ধকারে ছিলেন আলাউদ্দিনের স্বজনরা
অনলাইন নিউজ ডেক্স
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে আলাউদ্দিন দেওয়ান (৫০) নামের একজন কেয়ারটেকারের মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মারা যাওয়ার আগে ১০ দিন তাকে কোথায় রাখা হয়েছিল সে বিষয়ে অন্ধকারে ছিলেন স্বজনরা। যে কারণে মৃত্যু সংবাদের ২৪ ঘণ্টা পরও তারা লাশ গ্রহণ করেননি। আলাউদ্দিন শুক্রবার রাতে মারা গেলেও শনিবার রাতে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয় পুলিশ।
আলাউদ্দিনের পরিবারের সদস্যরা বলেন, ‘আমরা লাশ চাই না। চাই সুস্থ জীবিত মানুষ। কেননা একজন সুস্থ-সবল মানুষ নিয়ে গেছে ডিবি। তাহলে এখন কেন মৃত মানুষ নেব? ওরা নির্যাতন চালিয়ে আলাউদ্দিনের হাত-পা ভেঙে ফেলেছে। নাক-মুখ চ্যাপটা করেছে। তারাই হাসপাতালে ভর্তি করেছে। আমাদের কিছুই জানানো হয়নি।’
শেরেবাংলা নগর থানার ওসি উৎপল বড়ুয়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এক আবেদনে উল্লেখ করেন, ডিবি উত্তরা বিভাগের পরিদর্শক সিদ্দিকুর রহমানের গ্রেফতার করা আসামি আলাউদ্দিন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ১৬ জুন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদিন সন্ধ্যা ৭টার পর ওই আসামি মৃত্যুবরণ করে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থানাকে অবহিত করে।
শনিবার দুপুরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, ইনস্টিটিউটের একটি কক্ষে মারা যাওয়া এক ব্যক্তির (আলাউদ্দিন) লাশ ঘিরে রেখেছে পুলিশ। থানা ও গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা আসা-যাওয়া করছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার খোন্দকার নুরুন্নবী বলেন, ‘তুরাগ থানা এলাকায় এক নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত বাড়ির কেয়ারটেকার আলাউদ্দিন। হত্যা করার সময় ওই নারীর সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে পায়ে আঘাত পান তিনি। তাকে গ্রেফতারের পর হত্যার দায় স্বীকারও করে। আদালতের নির্দেশে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার প্রেসার হঠাৎ বেড়ে গেলে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার মৃত্যু হয়।
আলাউদ্দিন দেওয়ান রাজধানীর তুরাগের বাউনিয়া পুকুরপাড়া এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। তার পিতার নাম নূরুউদ্দিন দেওয়ান। তিনি বাউনিয়া আদর্শপাড়া হায়দার আলীর বাড়িতে কেয়ারটেকার হিসাবে কাজ করতেন। স্ত্রীর নাম পারভীন আক্তার। তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। বাসার ভাড়াটিয়া গৃহবধূ ফাতেমা আক্তার মুক্তা (৩৫) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসাবে ডিবি তাকে ৬ জুন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে। এ সময় চাচাতো ভাই মান্নান ও শুভ দেওয়ানসহ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার ফারুক হোসেন , আগে থেকেই পা ভাঙা ছিল আলউদ্দিনের। তাই ডিবি হেফাজতে তাকে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বেশ কয়েকদিন ধরেই তাকে সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। শুক্রবার বুকে ব্যথা দেখা দিলে তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ডিবি উত্তরা বিভাগের পরিদর্শক ছিদ্দিকুর রহমানের অধীনে ছিলেন। গুরুতর অবস্থায় তাকে প্রথমে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একপর্যায়ে পরিস্থিতির অবনতি হলে তাকে হৃদরোগ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
আলাউদ্দিন দেওয়ানের চাচাতো ভাই মান্নান দেওয়ান বলেন, ‘আমার ভাই যে বাসায় কেয়ারটেকার হিসাবে কাজ করতেন সেই বাসার ২-সি নম্বর ফ্ল্যাটে ৬ জুন একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফাতেমা আক্তার মুক্তা নামের এক গৃহবধূ খুনের শিকার হন। এ ঘটনায় ৭ জুন তুরাগ থানায় একটি মামলা হয়। মামলায় একমাত্র নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয় মুক্তার স্বামী সাইফুল ইসলাম রানাকে। ঘটনার পর রানা পালিয়ে যায়। পরদিন রানাকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। রানা এখন কারাগারে।’
মান্নান দেওয়ান বলেন, লাশ উদ্ধারের কয়েক ঘণ্টা পর থানা পুলিশের উপস্থিতিতে ডিবি পুলিশের সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আলাউদ্দিন দেওয়ানকে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। থানা পুলিশকে জিজ্ঞেস করলে বলা হতো, আলাউদ্দিন ডিবি হেফাজতে ভালো আছে। ডিবির কাছে জানতে চাইলে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দেওয়া হতো না। একেক সময় একেক ধরনের কথা বলতেন ডিবি সদস্যরা। তারা কখনো ফোন ধরতেন, কখনো ধরতেন না। আলাউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বলা হতো এখন না পরে ফোন ধরিয়ে দেওয়া হবে।
মান্নান দেওয়ান আরও বলেন, শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে হাসপাতাল থেকে ফোন দিয়ে বলা হয়, আপনাদের একটি লাশ আছে। লাশটি নিয়ে যান। এর আগে আমরা জানতামই না যে, আলাউদ্দিন হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
তিনি বলেন, হাসপাতাল থেকে লাশ নেওয়ার খবর দেওয়া হলেও আমরা লাশ গ্রহণ করিনি। আমাদের লাশ দেওয়ার জন্য শেরেবাংলা নগর থানা থেকেও চাপ দেওয়া হচ্ছে। এসআই আনোয়ার হোসেন বারবার ফোন করছেন। কিন্তু আমরা লাশ নিচ্ছি না। কারণ আমাদের সামনে থেকে জীবিত মানুষ নেওয়া হয়েছে। তাই আমরা লাশ চাই না। জীবিত মানুষ চাই।
এ বিষয়ে শেরেবাংলা নগর থানার এসআই আনোয়ার হোসেন বলেন, লাশ সুরতহাল করেছেন ম্যাজিস্ট্রেট। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।
এদিকে তুরাগ থানায় করা বোন মুক্তা মামলার বাদী মুরাদ মিয়া বলেন, তাদের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার পশ্চিম হাসেমদিয়া গ্রামে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভাড়াটিয়া হিসাবে ঢাকায় বসবাস করতাম। প্রেমের সম্পর্কের ভিত্তিতে দুই বছর আগে বোন ফাতেমা আক্তার মুক্তা বিয়ে করেন সাইফুল ইসলাম রানা (৫২) নামের এক ব্যক্তিকে।
রানার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব থানার বালুচর। তিনি ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেল প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। রানার সঙ্গে মুক্তার বিয়ের সম্পর্ক আমরা মেনে নিইনি। ওই বিয়ের পর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আমি গ্রামের বাড়ি চলে যাই। এরপর থেকে মুক্তা ও রানার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, রানা ও মুক্তা তুরাগের বাউনিয়া আদর্শপাড়া হায়দার আলীর বাড়ির দ্বিতীয় তলার ২-সি নম্বর ফ্ল্যাটে থাকতেন। ৬ জুন দুপুর ১২টার দিকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে খবর পাই, মুক্তা মারা গেছেন। পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে মুক্তাকে রক্তাক্ত ও বিবস্ত্র অবস্থায় দেখতে পাই।
মুক্তার বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, রানা আমার বোনের খোরপোষের খরচ দিতে চাইত না। এ নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াঝাঁটি হতো। মুক্তাকে মারধর করত রানা। ঘটনার দিন সকাল ৯টার দিকে আমার বোনের পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া মো. সুজন অফিসে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করেন ২-সি নম্বর ফ্ল্যাটটির দরজা হালকা ফাঁকা। ফাঁকা দিয়ে মেঝেতে রক্ত দেখা যাচ্ছে। পরে বাড়ির কেয়ারটেকার আলাউদ্দিন দেওয়ানকে তিনি ঘটনাটি জানান। এরপর পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।
মুরাদ বলেন, আমরা ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর রানার হদিস পাইনি। তার মোবাইল ফেন বন্ধ ছিল। ঘটনার সঙ্গে কেয়ারটেকারের কোনো যোগসাজশ ছিল কিনা আমরা জানি না। দু-তিন দিন আগে থানা পুলিশ আমাদের জানায়, মামলাটি ডিবিতে চলে গেছে। সেখানে একজন আসামি অ্যারেস্ট হয়েছে। কিন্তু আসামির কোনো নাম-ঠিকানা আমাদের জানানো হয়নি। এমনকি ডিবি থেকে আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগও করা হয়নি। আমরা বিস্তারিত জানার জন্য রোববার (আজ) ডিবিতে যাওয়ার চিন্তা করছিলাম। কেয়ারটেকার গ্রেফতার এবং মারা যাওয়ার খবর এই প্রথম শুনছি।
মামলার প্রাথমিক তদন্ত কর্মকর্তা তুরাগ থানার এসআই টিএম আল আমিন জানান, মামলাটি ১০ জুন ডিবিতে চলে গেছে। আমরা শুনেছি ডিবি হেফাজতে সন্দেহভাজন আসামি একজন মারা গেছেন। এর বেশি কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ঘটনার দিনই আমরা বাড়ির কেয়ারটেকার আলাউদ্দিন দেওয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম। কিন্তু সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে ওইদিন আমরা তাকে ছেড়ে দিই। এরপর তার বিষয়ে আর কোনো তথ্য আমাদের জানা ছিল না।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার বেলাল হোসেন বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে বুকে ব্যথা নিয়ে পঙ্গু হাসপাতাল আলাউদ্দিন এখানে ভর্তি হন। রাত ৮টার আগেই মারা যান। পুলিশ পরিদর্শক সিদ্দিকুর রহমান তাকে ভর্তি করান। এ সময় তার সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন সদস্য ছিলেন। রোগী মারা যাওয়ার পর বিষয়টি স্বজনসহ স্থানীয় থানা পুলিশকেও জানানো হয়। স্বজনরা লাশ গ্রহণ না করায় স্থানীয় থানা পুলিশের (শেরেবাংলা নগর) কাছে লাশ হস্তান্তর করেছি।
আলাউদ্দিনের ডেথ নোটে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের চিকিৎসক উম্মে হাবিবা উল্লেখ করেন, শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিট থেকে ১০ মিনিট তিনি আলাউদ্দিনকে দেখেন। এ সময় তার পালস ও বিপি (ব্লাড প্রেসার) ছিল না।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।