৬ শান্তিরক্ষীর অশ্রুসজল বিদায়


৬ শান্তিরক্ষীর অশ্রুসজল বিদায়
সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছয় শান্তিরক্ষীর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। আজ রোববার সকালে ঢাকা সেনানিবাসের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাদের জানাজা হয়। এর পর ছয় সেনাসদস্যের মরদেহ নিজ নিজ জেলার উদ্দেশে রওনা দেয়। সেখানে তাদের দাফন সম্পন্ন হয়। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। নিহত ছয় শান্তিরক্ষী হলেন– নাটোরের বাসিন্দা করপোরাল মাসুদ রানা, কুড়িগ্রামের বাসিন্দা সৈনিক মমিনুল ইসলাম, সৈনিক শান্ত মণ্ডল, রাজবাড়ীর বাসিন্দা সৈনিক শামীম রেজা, কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এবং গাইবান্ধার বাসিন্দা লন্ড্রি কর্মচারী সবুজ মিয়া। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, জানাজায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খানসহ সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন পদবির কর্মকর্তা ও সদস্য অংশ নেন। জানাজার আগে শহীদদের জীবনবৃত্তান্ত পড়ে শোনানো হয়। এ সময় তাদের স্বজনরা বক্তব্য দেন। এরপর বক্তব্য দেন জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষে ইউনিসফার চিফ কমিউনিটি লিয়াজোঁ অফিসার বরিস-এফ্রেম চৌমাভি। জানাজা শেষে তাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানানো হয়। এরপর রাষ্ট্রপতির পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব, প্রধান উপদেষ্টার পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব, সেনাবাহিনী প্রধান, নৌবাহিনী প্রধান ও বিমানবাহিনী প্রধান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পরে ইউনিসফার চিফ কমিউনিটি লিয়াজোঁ অফিসার স্বজনদের কাছে জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের পতাকা হস্তান্তর করেন। গত ১৩ ডিসেম্বর সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের কাদুগলি লজিস্টিকস বেইসে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী ড্রোন হামলা চালায়। এতে ছয় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত ও ৯ জন আহত হন। শনিবার ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ছয়জনের মরদেহবাহী বিমান অবতরণ করে। নিজ গ্রামে শায়িত হলেন মাসুদ রানা আজ ঢাকায় জানাজার পর করপোরাল মাসুদ রানার মরদেহবাহী হেলিকপ্টার নাটোরের লালপুর উপজেলার করিমপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পৌঁছায়। সেখানে থেকে সেনাবাহিনীর মরদেহবাহী গাড়িতে তাঁর মরদেহ বোয়ালিয়াপাড়া গ্রামে নিজ বাড়িতে নেওয়া হয়। মরদেহ দেখতে ছুটে আসেন গ্রামবাসী। বিকেল সাড়ে ৩টায় লালপুর উপজেলার বোয়ালিয়াপাড়া হাইস্কুল মাঠে সামরিক মর্যাদা শেষে সামাজিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। মাসুদ রানা বোয়ালিয়াপাড়া গ্রামের প্রয়াত সাহার মালিথার বড় ছেলে। তারা তিন ভাই ও দুই বোন। মাসুদ ২০০৬ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তাঁর অন্য দুই ভাইও সেনাবাহিনীতে কর্মরত। মাসুদ এক মাস আগে শান্তিরক্ষা মিশনে সুদানে যান। তিনি মা, স্ত্রী ও আট বছরের মেয়ে রেখে গেছেন। ‘আমার স্বামী বীর’ ‘আমার স্বামী জেলার গর্ব, দেশের গর্ব। সে বীর। কারণ সে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন সৈনিক শান্ত মণ্ডলের স্ত্রী দিলরুবা খন্দকার বৃষ্টি। আজ ঢাকায় জানাজার পর শান্ত ও আরেক সৈনিক মমিনুল ইসলামের মরদেহ কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলায় পৌঁছায়। শান্তর বাড়ি রাজারহাট উপজেলার ছাট মাধাই গ্রামের মণ্ডলপাড়ায়। মমিনুলের বাড়ি উলিপুর থেকে অ্যাম্বুলেন্সে তাঁর মরদেহ গ্রামে নেওয়া হয়। শান্ত ও মমিনুলকে নিজ নিজ গ্রামে নিয়ে দাফন করা হয়েছে। ২০১৮ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া শান্তর মরদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন সন্তানসম্ভবা স্ত্রী বৃষ্টি এবং মা সাহেরা বেগম। তারা শান্তর জন্য সবার কাছে দোয়া চান। এদিকে সৈনিক মমিনুল ইসলামের বাড়ি উলিপুরের উত্তর পান্ডুল গ্রামে। তিনি ২০০৮ সালে সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগ দেন। পরিবারে মা, স্ত্রী ও দুই মেয়ে রয়েছে মমিনুলের। শামীমের জন্য কাঁদছে সবাই রোববার দুপুর ২টার দিকে রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মৃগী ইউনিয়নের হোগলাডাঙ্গি গ্রামে পৌঁছায় সৈনিক শামীম রেজার মরদেহ। এ সময় গ্রামবাসী তাঁর মরদেহ দেখতে ছুটে আসেন। অনেকের চোখে পানি দেখা যায়। বিকেল ৩টার দিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। হোগলাডাঙ্গি গ্রামের আলমগীর ফকিরের ছেলে শামীম। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ২০১৮ সালে সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগ দেন। দেড় বছর আগে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন শামীম। গত ৭ নভেম্বর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিতে সুদানে যান। কান্না থামছে না জাহাঙ্গীরের স্বজনের ২০১৪ সালের ১ অক্টোবর সেনাবাহিনীতে মেস ওয়েটার পদে যোগ দেন জাহাঙ্গীর আলম। শান্তিরক্ষা মিশনে গত ৭ নভেম্বর রংপুর সেনানিবাস থেকে তিনি সুদানে যান। তাঁর মৃত্যুতে কান্না থামছে না স্বজনের। জাহাঙ্গীর কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের তারাকান্দি গ্রামের হযরত আলীর ছেলে। আজ বিকেলে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলায় মরদেহ পৌঁছায়। সেখান থেকে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে অ্যাম্বুলেন্সে গ্রামের বাড়িতে মরদেহ নিয়ে দাফন করা হয়। প্রায় ছয় বছর আগে বিয়ে করেন জাহাঙ্গীর। জানাজার আগে তাঁর বড় ভাই মো. মোস্তফা ও স্ত্রী রুবাইয়া আক্তারের বড় ভাই মো. অলিউল্লাহ এলাকাবাসীসহ সবার উদ্দেশে বক্তব্য দেন। তারা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জাহাঙ্গীর, তাঁর স্ত্রী ও তিন বছরের ছেলের জন্য দোয়া চান। ‘মোর সোনাটাক আনি দেও’ ‘মোর সোনাটাক তোমরা যেটি থাকি পারেন আনি দেও’– সুদানে নিহত সেনাবাহিনীর লন্ড্রি কর্মচারী সবুজ মিয়ার মায়ের মুখে শুধু একই কথা। সন্তানের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে তিনি যাকে পাচ্ছেন, কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই কথা বলছেন। আজ সবুজের মরদেহ পৌঁছানোর পর তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। সবুজ গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার মহদীপুর ইউনিয়নের ভগমানপুর গ্রামের প্রয়াত হাবিদুল মিয়ার ছেলে। সেখানে তাঁকে বিকেলে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। সবুজের চাচাতো ভাই ফরিদ মিয়া বলেন, ‘অভাবের সংসারে সবুজই ছিল একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দুই বছর বয়সে সে বাবাকে হারায়। খুব অল্প বয়সে সেনাবাহিনীর বেসামরিক পদ লন্ড্রি মিস্ত্রি হিসেবে কাজ শুরু করে। ১৭ মাস আগে তার বিয়ে হয়েছে। সবুজকে হারিয়ে পরিবারটি খুব বিপদে পড়ে গেল।’