মানবাধিকার ইস্যুতে কি বদলে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র


মানবাধিকার ইস্যুতে কি বদলে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে এগিয়ে নিতে প্রায় সব প্রশাসনই বিশ্বের বিতর্কিত নেতাদের সঙ্গে সখ্য বজায় রেখেছে। এর পরও মানবাধিকার ইস্যুতে সব মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে কিছু নীতি মেনে চলতেন। তবে সেই মানদণ্ড থেকে বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন অনেকখানি সরে এসেছে বলে মন্তব্য করছেন বিশ্লেষকরা। সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যায় তার সর্বশেষ মন্তব্য এ বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সফরের দ্বিতীয় দিন বুধবার ক্যাপিটল হিলে কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস)। এ সফরের উদ্দেশ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাবিষয়ক সম্পর্ক আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় শক্তিশালী করে তোলা। এ সময় তার বিরুদ্ধে থাকা মানবাধিকার-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সমালোচনা পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে মোহাম্মদ বিন সালমানকে জাঁকজমকপূর্ণ অভ্যর্থনা জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৮ সালে ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যুবরাজের পক্ষে তিনি প্রকাশ্যে সাফাইও গান। যদিও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলেছিল, যুবরাজের অনুমোদনেই তাকে হত্যার অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। গত মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে নৈশভোজের আয়োজন করেন ট্রাম্প। এতে উপস্থিত ছিলেন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসন, সিনেটে বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান জিম রিশ এবং প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্র কমিটির চেয়ারম্যান ব্রায়ান মাস্টসহ কয়েকজন রিপাবলিকান সদস্য। জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর সৌদি যুবরাজকে যুক্তরাষ্ট্রে কূটনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে দেখা হতো। এ হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগের কারণে কংগ্রেসের অনেকেই তার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন এবং বিভিন্ন সময় জবাবদিহির দাবি তুলেছিলেন। তবে চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র সফরের মধ্য দিয়ে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে তার ভাবমূর্তি ফিরে পেয়েছেন। এমবিএসের সফরকালে ট্রাম্প বলেন, ২০১৮ সালে খাশোগি হত্যার বিষয়ে এমবিএস আগে থেকে অবগত ছিলেন বলে তার বিশ্বাস হয় না। অথচ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার মূল্যায়ন ছিল এ হত্যাকাণ্ডে সৌদি যুবরাজের সম্মতি ছিল। ট্রাম্পের অধীনে মার্কিন মানবাধিকার নীতি কতটা পরিবর্তিত হয়েছে, তা মঙ্গলবারের ওই ঘটনায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ট্রাম্প শুধু সৌদি আরব নয়, হাঙ্গেরি, চীন, এল সালভাদর ও রাশিয়ার নেতা, যাদের সাধারণত মার্কিন প্রশাসন স্বৈরাচার আখ্যা দিয়ে থাকে, সবার প্রতিই অনেকটা নমনীয়তা প্রদর্শন করে আসছেন। তাদের নিন্দা করার বদলে সম্পর্কগুলোয় দেনা-পাওনার দিকেই মনোযোগ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ওবামা প্রশাসনের সাবেক পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা এবং বর্তমান গ্লোবাল সিচুয়েশন রুম কনসালটেন্সির প্রধান ব্রেট ব্রুয়েন বলেছেন, বিশ্বের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের প্রথাগত কিছু মূলনীতি উপেক্ষা করছেন ট্রাম্প। তার কারণে স্বৈরশাসকরা যা ইচ্ছা তাই করার সবুজ সংকেত পাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে এমবিএসের সফরে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা-সংক্রান্ত অংশীদারত্বে গুরুত্ব এবং শীর্ষস্থানীয় মার্কিন নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করেছেন ট্রাম্প। লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়ে মূলত তিনি সৌদি যুবরাজের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি পুনর্গঠনে সহায়তা করছেন। বিশ্লেষকদের অভিযোগ, ট্রাম্প স্বার্থের কথা মাথায় রেখে কাউকে নরম সুরে আবার কাউকে শক্ত হাতে সামলাচ্ছেন। কারণ, তিনি যেমন একদিকে তুরস্কের রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান ও হাঙ্গেরির ভিক্টর ওরবানের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উপেক্ষা করছেন, অন্যদিকে তিনি ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি চাপ প্রয়োগ করছেন। অবশ্য এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র অ্যানা কেলি বলেছেন, মানবাধিকার নিয়ে কেউই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চেয়ে বেশি আন্তরিক নন। তিনি মার্কিন স্বার্থের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতিতে (আমেরিকার ফার্স্ট পলিসি) নির্বাচিত হয়েছেন। প্রেসিডেন্টের সব পররাষ্ট্রনীতি ওই অঙ্গীকারের আলোকেই গৃহীত হচ্ছে। অবশ্য ট্রাম্পের আগের অনেক প্রেসিডেন্টও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে হাত গুটিয়ে থাকার জন্য সমালোচনার শিকার হয়েছেন। যেমন, সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিরুদ্ধে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নেতানিয়াহু সরকারকে পর্যাপ্ত চাপ প্রয়োগ না করার জন্য দায়ী করেন মানবাধিকার কর্মীরা। আর একাধিক সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা এবং বিশ্লেষক অভিযোগ করেছেন, দ্বিতীয় মেয়াদে বছর না ঘুরতেই সে প্রবণতাকে নতুন স্তরে নিয়ে গেছেন ট্রাম্প। তবে ট্রাম্পের উপদেষ্টাদের পালটা দাবি, আলোচ্য নেতাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সম্পর্ক মার্কিন স্বার্থেই সহায়ক। এই প্রশাসন মানবাধিকার ইস্যু উপেক্ষা করছে না। বরং তারা মাগা (মেই আমেরিকা গ্রেইট অ্যাগেইন) সমর্থকদের কাছে ট্রাম্পের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা এবং অর্থনৈতিক চুক্তিকে বিবেচনায় নিয়ে সব ঢেলে সাজানো হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার ও এলজিবিটিকিউদের নিপীড়নে যুক্তরাষ্ট্রের মৌনতার সাফাই গেয়ে ট্রাম্পের উপদেষ্টারা বলছেন, অন্য দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ এড়াতে তারা এ পন্থা অবলম্বন করেছে। অথচ এই একই প্রশাসন রোমানিয়া, জার্মানি, ফ্রান্সসহ একাধিক দেশের বিরুদ্ধে ডানপন্থি নেতাদের ওপর ‘দমনমূলক’ নীতি চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘সেন্সরশিপ’ নিয়ে সরব হয়েছে এবং ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর বিচারকে কেন্দ্র করে বামপন্থি সরকারের ওপরও প্রকাশ্যে চাপ বৃদ্ধি করছে। বিভিন্ন দেশের ডানপন্থি সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ, যেমন এল সালভাদরের কারাগারের নির্যাতন নিয়ে ট্রাম্প নীরব থাকলেও ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর বিরুদ্ধে মাদক পাচার এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের অভিযোগ তুলে কঠোর অবস্থান নিচ্ছেন। অবশ্য, ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক মানবাধিকার রক্ষায় দ্বৈত নীতির অভিযোগ মানতে নারাজ মার্কিন আইনপ্রণেতা ব্রায়ান মাস্ট। তিনি বলেন, ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি সংঘাত বন্ধে ভূমিকা রেখেছে। মানবাধিকার রক্ষায় এটাই সর্বোচ্চ অর্জন। তবে ক্রাউন প্রিন্সের প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফরে ট্রাম্পের প্রশংসার ফুলঝুরি ভিন্ন ইঙ্গিত দিচ্ছে। সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ভিন্নমত কঠোর হাতে দমনের অভিযোগ থাকলেও তাকে বারবার বন্ধু হিসেবে সম্বোধন করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আর খাসোগি হত্যার বিষয়ে তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তো খারিজ করেছেনই। মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এ বিষয়ে বলেছেন, ট্রাম্প স্বৈরশাসক এবং অলিগার্কদের কাতারে যুক্তরাষ্ট্রকে দাঁড় করাচ্ছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জন সিফটন বলেন, মানবাধিকার ইস্যুতে দেশের ভেতরে বাইরে কোথাও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা এখন আর নেই।