ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে দায় সেরেছে রাজউক
অনলাইন নিউজ ডেক্স
২০২৩ সালে রাজধানীর সিদ্দিকবাজার ও সায়েন্স ল্যাব এলাকায় দুটি ভবন ধসে পড়ে। ওই বছর নগর উন্নয়ন কমিটির এক সভায় ২২৯টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে আলোচনা হয়। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ‘আরবান রেজিলিয়েন্স’ প্রকল্পের আওতায় এসব ঝুঁকিপূর্ণ ও অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করে।
তালিকায় থাকা ৪২টি ভবন ভেঙে ফেলার এবং ১৮৭টি ভবন রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে সংস্কার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাজউকের জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় সরকারিভাবে নির্মিত ৩৭ শতাংশ নতুন ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। অতিঝুঁকিপূর্ণ ৪২টি ভবন সাত দিনের মধ্যে খালি করার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু আড়াই বছর পার হলেও এসব ভবন এখনো ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় রয়ে গেছে।
রাজউক-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বহুবার চিঠি পাঠানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রাজউকের তালিকায় বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুটি ভবন রয়েছে—একটি ২০২২ সালে এবং অন্যটি ২০০৮ সালে নির্মিত। হাজারীবাগের সালেহা উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০১৮ সালে নির্মিত আটতলা ভবন এবং আশুলিয়ার দোসাইদ এ কে স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২০১৭ সালের ভবনও ঝুঁকিপূর্ণ।
সরকারি সংস্থাগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, এসব ঝুঁকির পেছনে রয়েছে নির্মাণের ত্রুটি ও বিল্ডিং কোড না মানা। অথচ এসব ভবন নির্মিত হয়েছে সরকারি উদ্যোগেই।
রাজউকের নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার মো. ওয়াহিদ সাদিক বলেন, মধুপুর ফাটলরেখায় ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার ৮ লাখ ৬৪ হাজার ৬১৯টি ভবন ধসে পড়তে পারে—যা মোট ভবনের ৪০ শতাংশের কিছু বেশি। এতে আর্থিক ক্ষতি হতে পারে প্রায় আড়াই হাজার কোটি ডলার (তিন লাখ কোটি টাকা) এবং ভবন মেরামত বা পুনর্নির্মাণে ব্যয় হবে ৪ হাজার ৩৭০ কোটি ডলার (৫ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা)।
রাজউক সূত্র জানায়, ‘আরবান রেজিলিয়েন্স’ প্রকল্পের আওতায় মোট ব্যয় ৫৬৮ কোটি টাকা। এর আওতায় ২ হাজার ৭০৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ২০৭টি হাসপাতাল, ৩৬টি থানা ও ৩০৪টি অন্যান্য ভবন জরিপ করা হয়। জরিপে ১৮৭টি ভবনের রেট্রোফিটিং এবং ৪২টি ভবন ভেঙে ফেলার সুপারিশ করা হয়।
ভাঙার তালিকায় রয়েছে পিজি হাসপাতালের তিনটি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি, মাদ্রাসা বোর্ডের তিনটি, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একটি এবং শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্মিত ৩০টি ভবন।
রেট্রোফিটিংয়ের তালিকায় আছে ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির তিনটি, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের চারটি, মাদ্রাসা বোর্ডের ছয়টি, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ১০টি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০টি এবং শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ১৫৪টি ভবন।
ঝুঁকিপূর্ণ ২২৯টি ভবনের মধ্যে ৮৫টি ভবন নির্মিত হয়েছে ২০০০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে, যা মোট সংখ্যার ৩৭ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে ২০১৭ সালে নির্মিত ভবনের সংখ্যা আটটি, আর ২০১০ সালের পর নির্মিত ভবনের সংখ্যা ৪৯টি।
ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির পরিচালক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমি এক বছর আগে দায়িত্ব নিয়েছি। কোন ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ, তা আমার জানা নেই।’
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. তারেক মনোয়ার জাহেদী বলেন, ‘বছর দুয়েক আগে রাজউক একটি তালিকা করেছিল। তবে এসব ভবনের অধিকাংশই বেসরকারি স্কুলের, তাই রেট্রোফিটিংয়ের দায়িত্ব আমাদের নয়।’
বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক এনামুল হক বলেন, ‘রাজউক দুটি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ বলেছে, তবে কোন দুটি তা নির্দিষ্ট করে জানায়নি। পরে বুয়েটের প্রকৌশলীদের দিয়ে পরীক্ষা করালে তারাও ভবন দুটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনে দেখা গেছে—ফাটল, ছাদের পলেস্তারা খসে রড বেরিয়ে থাকা এবং অন্যান্য ত্রুটি। ২৯ এপ্রিল অবকাশ ভবনের দোতলার কার্নিশ ভেঙে পড়ে একজন কর্মকর্তা আহত হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিফাত হোসেন বলেন, ‘আমরা কয়েকজন বসেছিলাম। হঠাৎ ভবনটি দুলতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে বারান্দায় চলে যাই। অনেকেই ভবন থেকে দৌড়ে ফাঁকা জায়গায় চলে যায়।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, ‘বুয়েটকে ভবনের অবস্থা জানতে বলেছিলাম, তারা রাজউকের প্রতিবেদন চায়। রাজউককে একাধিক চিঠি দিয়েও প্রতিবেদন পাইনি। নিজেরা পরীক্ষা করতে চাইলে বুয়েট জানায়, চারটি ভবন পরীক্ষায় খরচ হবে ৪৫ লাখ টাকা। ইউজিসিকে চিঠি দিয়েও বরাদ্দ মেলেনি।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, রাজউকের তিনটি প্রধান কাজ—পরিকল্পনা, উন্নয়ন এবং উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ। তারা উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। ভবন মালিক ও প্রকৌশলীরাও দায় এড়াতে পারেন না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘রাজউকের আইনি ক্ষমতা রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙার। সিটি করপোরেশন আইনেও একই ক্ষমতা দেওয়া আছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তালিকা তৈরি করলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেয় না। দুর্ঘটনা ঘটলে দায় রাষ্ট্রের ওপরই পড়ে।’
রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ হেলালী বলেন, ‘ঢাকায় ভবনগুলোয় ন্যূনতম মান বজায় রাখা হচ্ছে না। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ২ থেকে ৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে এবং ক্ষতি হতে পারে ২৫ মিলিয়ন ডলার। যেসব ভবন রেট্রোফিটিং করা সম্ভব, সেগুলোর জন্য খরচ হবে ৬২ মিলিয়ন ডলার।’
ভূমিকম্প আতঙ্কে ঢাকাবাসীর মধ্যে অনেকে শহর ছাড়ার পরিকল্পনা করছেন। মিরপুর-১ এলাকার বাসিন্দা সাদেকুর রহমান কামাল বলেন, ‘ভূমিকম্পের পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। ঘুমের মধ্যেও আতঙ্কে জেগে উঠি। এখন ঢাকায় থাকা না থাকার প্রশ্নটি নতুনভাবে ভাবছি।’
মিটফোর্ড এলাকার বাসিন্দা ফয়েজ আহমেদ খান বলেন, ‘এখানকার ভবনগুলো পুরোনো এবং একটির সঙ্গে আরেকটি লাগোয়া। দুর্ঘটনার সময় নিরাপদ জায়গায় দাঁড়ানোরও সুযোগ নেই। বড় ভূমিকম্প হলে কী হবে, একমাত্র আল্লাহ জানেন। ভাবছি দ্রুত গ্রামের বাড়ি চলে যাব।’
