প্রচণ্ড গরমে বিপর্যস্ত জনজীবন
অনলাইন নিউজ ডেক্স
ঘড়ির কাঁটায় বিকেল সোয়া ৪টা। ইফতারের আর খুব বেশি সময় বাকি না থাকায় এ সময়ে ঢাকার রাস্তাঘাট ঘরমুখো মানুষে ঠাসা থাকার কথা। এ ছাড়া সামনে ঈদ হওয়ায় মার্কেটগুলোতেও হওয়ার কথা ভিড়। কিন্তু চামড়া পোড়ানো তীব্র রোদ, গরম আর আগুনের হল্কার মতো বাতাস যেন সবকিছু পাল্টে দিয়েছে।
গতকাল বিকেলে রাজধানীর অধিকাংশ সড়ক ছিল কিছুটা ফাঁকা, মানুষের চলাচল ছিল কম। যাঁরা বাধ্য হয়ে বের হয়েছেন, তাঁরা টের পেয়েছেন গরমে নাভিশ্বাস ওঠা কাকে বলে। ঘরের ভেতরও গুমোট অবস্থা। এর মধ্যে বিদ্যুৎ গেলে তো কথাই নেই, একেবারে সেদ্ধ হওয়ার দশা।
দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে নেই মেঘ-বৃষ্টি। ফলে রাজধানীতে গত ৫৮ বছরের মধ্যে গতকালের মতো গরম কখনও অনুভূত হয়নি। বাতাসে আর্দ্রতা অস্বাভাবিক কম থাকায় গরম প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে বেশি পোড়াচ্ছে মানুষকে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আক্কু ওয়েদারের তথ্য বলছে, গতকাল বিকেল ৩টায় ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে গরমের তীব্রতা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো অনুভূত হয়েছে। সঙ্গে আর্দ্রতার পরিমাণও ছিল কম, মাত্র ১৮ শতাংশ। ফলে তীব্র গরম ও শুষ্ক বাতাস মিলেমিশে মানুষের কষ্ট আরও বেড়েছে।
শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেই এখন অগ্নিগর্ব। দেশের তাপমাত্রাও ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে উঠেছে গতকাল। তাপদাহে যশোরে গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন। তীব্র গরমে রেললাইন বেঁকে গিয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কায় সতর্কতার সঙ্গে চলছে ট্রেন। ঝলসে যাচ্ছে ক্ষেতের ফসল। রোদে শুকিয়ে ঝরে যাচ্ছে আম-লিচু। তপ্ত রোদে দিনমজুর, রিকশাচালকরা রোজগারের তাগিদে পথে নামলেও ভয়ংকর রোদে কাহিল হয়ে পড়ছেন। হাসপাতালে বেড়েছে রোগী। হাঁসফাঁস করছে অন্য প্রাণিকুলও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরমের এই তীব্রতা আগামী কয়েক দিন অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে দ্রুত এ সময়কে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ঘোষণা করে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে সরকারকে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তাঁরা।
গরম বাড়বে আরও
এপ্রিল ও মে মাস এমনিতেই বছরের উষ্ণতম। এ সময় বাংলাদেশে সূর্য তাপ দেয় খাড়াভাবে। ফলে গরম থাকে বেশি। তবে এ সময়ে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে, তা দেখা যায় না সচরাচর। এর আগে ঢাকায় এপ্রিলে ৪০ ডিগ্রির বেশি উত্তাপ গত ছয় দশকের বেশি সময়ে দেখা গেছে কেবল দুবার। ১৯৬০ সালের এই মাসে ঢাকায় ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার রেকর্ড আছে। ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠছিল ৪০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, ঢাকায় এপ্রিলে সাধারণত গড় তাপমাত্রা থাকে ৩৩.৭ ডিগ্রি আর সারাদেশে গড় তাপমাত্রা ৩৩.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু এবার স্বাভাবিক বা গড়ের চেয়ে ৭ থেকে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ বেশি পাওয়া যাচ্ছে। ৪ এপ্রিলের পর থেকে গোটা দেশে বৃষ্টিপাত অনেক কম, শূন্য বললেই চলে। ফলে হিট ওয়েবের পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
টানা ১৪ দিন ধরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়। বৈশাখের প্রথম দিনে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল চুয়াডাঙ্গায় ৪১.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল দ্বিতীয় দিনেও একই জেলায় পারদ উঠেছে ৪২.২ ডিগ্রিতে। সব শেষ ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল। আর ২০১০ সালে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড রয়েছে। অর্থাৎ দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে উঠেছে গতকাল। যশোর, ঝিনাইদহসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর বেশিরভাগ এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেছে।
কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোস্তফা কামাল দেশের আবহাওয়া পূর্বাভাস নিয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ দিয়ে থাকেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, আজ রোববারের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা, ঢাকা, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, শরীয়তপুরের তাপমাত্রা ৪১ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠতে পারে।
পুড়ছে ফসল
তীব্র তাপদাহে দিশেহারা দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার চাষিরা। গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে গরমে ঝলসে যাচ্ছে বোরো ধান। গভীর নলকূপ ও পাম্প থেকে সেচ দিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। জমিতে পানি দিলেও নিমেষে তা মাটির গভীরে চলে যাচ্ছে। তীব্র রোদে ঝরে যাচ্ছে গাছের আম, লিচু, লেবু ও কাঁঠাল। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি অফিসার মিতা সরকার জানান, এবার ৪০ ভাগ লিচু গাছে মুকুল আসেনি। এখন গরম ও খরায় লিচুর গুটি ঝরে পড়ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে আবহাওয়ার এমন পরিবর্তন ভাবাই যাচ্ছে না। বোরো ধানের সঙ্গে সবজি চাষের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। রোজই বিভিন্ন এলাকা থেকে চাষিরা টেলিফোন করছেন।
ভ্যাপসা গরম ও অতিরিক্ত আর্দ্রতাযুক্ত আবহাওয়ায় শ্রম ও উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে বিশ্বের অনেক দেশ। সেই তালিকায় শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম আছে বলে গত বছর এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয় এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ লেটার্স জার্নালে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আবহাওয়ার এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে প্রতিবছর ৩ হাজার ২০০ কোটি কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে বাংলাদেশ। মূলত খোলা স্থানে কায়িক শ্রম দেওয়া মানুষের কর্মঘণ্টা কমার বিষয়টি উঠে আসে এতে। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, ২০০১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এই ভ্যাপসা গরমের জন্য মানুষের বাইরে কাজ করা ক্রমেই কঠিন এবং বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা জানান, এই গরম সরাসরি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। একজন কর্মক্ষম মানুষের স্বাস্থ্যের সঙ্গে অর্থনীতির বড় সংযোগ রয়েছে। ফলে প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে এবং কিছুটা স্বস্তি পেতে মানুষ নানাভাবে চেষ্টা করেন। এসব কারণে আপনার ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। গরমের মধ্যে মানুষ ফ্যান বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিণ যন্ত্র আগের চেয়ে বেশি ব্যবহার করছেন। ফলে বিদ্যুতের খরচ বাড়ছে। শরীরকে শীতল রাখে, এমন খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণও বেড়েছে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, গরমের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়টি আমাদের জন্য নতুন উপলব্ধি হয়ে আসছে। দেখা যাচ্ছে, শিল্প অবকাঠামোর যে পরিমাণ উন্নতি হচ্ছে, তার একটি অংশ উল্টো অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ অবস্থায় ক্ষতি কমিয়ে আনতে পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নের ওপর জোর দেওয়ার কথা বলেন তিনি।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এ গরমকে বৈজ্ঞানিকভাবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বলা হয়। অনেক দেশে এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে সতর্কতা জারি করা হয়। প্রয়োজন ছাড়া কেউ যেন ঘর থেকে বের না হন, সে ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে তা নেই। শীত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা বন্যায় সরকার মানুষকে সহায়তা করে। এমন গরমেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য সরকারের অনুদান জরুরি।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।