৪ হাজার টাকার জিপসাম বিক্রি ৫৫০০ টাকায়


চট্টগ্রাম টিএসপি কমপ্লেক্সের জিপসাম সাইট হোল্ডার তথা লেবার-মাঝিরাই বনে গেছেন জিপসাম সারের বড় বিক্রেতা। সারা দেশের সারের ডিলার ও কৃষকদের জিম্মি করে তারা হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। ৪ হাজার টাকা মূল্যের জিপসাম সার ৫ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। এতে করে একদিকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। অন্যদিকে কৃষকদের বাড়তি দামে কৃষির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ উপাদান-জিপসাম কিনতে হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, টিএসপির ৪২টি সাইট নানা কৌশলে বছরের পর বছর দখলে রেখে এই অপকর্ম চালাচ্ছেন তারা। সার কেলেঙ্কারির দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিও একাধিক সাইট দখলে রেখেছেন। নানা অভিযোগের পরও টিএসপির এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা এই চক্রকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে টিকিয়ে রেখেছেন বলে অভিযোগ আছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) সার তৈরির সময় এক ধরনের গাদ বা ডাস্ট তৈরি হয়। যেগুলো টিএসপি কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরে থাকা ‘পন্ড’ বা পুকুরে জমা হয়। পানি সরে গেলে সেই গাদকেই জিপসাম হিসাবে তৈরি করা হয়। জিপসাম জমিতে গন্ধকের ঘাটতি পূরণ করে। কালো সারের সঙ্গে এই সার ছিটিয়ে জমিতে দেওয়া হলে উর্বরতা বাড়ে। উত্তরবঙ্গে জিপসামের বেশ চাহিদা রয়েছে। দেশে প্রতিবছর দেড় লাখ টন জিপসামের চাহিদা আছে। টিএসপি কমপ্লেক্সে ৬০-৭০ হাজার জিপসাম উৎপাদন হয়। বাকিটা আমদানি করে মেটানো হয় চাহিদা। সিমেন্ট, জিপসাম বোর্ডসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত জিপসাম আমদানি করা হয়। সূত্র জানায়, টিএসপি কমপ্লেক্সের আওতায় কারখানার অভ্যন্তরে ৪২টি সাইট বা পন্ড রয়েছে। এসব সাইট জিপসাম স্তূপীকরণ, ট্রাকে বা গাড়িতে তোলার জন্য ৪২টি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়েছে টিএসপি। প্রতি টন জিপসাম গাড়িতে ওঠানোর জন্য লেবার চার্জ হিসাবে তাদের ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। ইউরিয়াসহ অন্যান্য সার কারখানায় উৎপাদন হলেও তা বণ্টনের দায়িত্ব কৃষি মন্ত্রণালয়ের। তাদের তালিকাভুক্ত ডিলারদের মাধ্যমেই সার সরবরাহ করা হয়। কিন্তু জিপসাম সারের ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হচ্ছে না। দেখা গেছে, যেসব প্রতিষ্ঠান টিএসপি থেকে সাইট পেয়েছে তারাই জিপসাম বিক্রি করছে ডিলার বা ক্রেতাদের কাছে। এতে টিএসপির নিয়ন্ত্রণ না থাকায় লেবার মাঝিরা ডিলার ও কৃষকদের কাছ থেকে জিপসামের ইচ্ছামতো দাম নেয়। অফ-সিজনে দাম কম নিলেও পিক-সিজনে সরকারি মূল্যের দ্বিগুণ দাম নেওয়ারও নজির রয়েছে। বর্তমানে প্রতি টন জিপসাম সারের সরকারি মূল্য ৪ হাজার টাকা। কিন্তু লেবার মাঝি বা সাইট হোল্ডাররা এই সারের মূল্য নিচ্ছে ৫ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। তারা সরকারকে জমা দিচ্ছে চার হাজার টাকা। প্রতি টনে এক-দেড় হাজার টাকা বেশি নিচ্ছে তারা। জিপসাম বিক্রি করেই তারা প্রতি টনে ১ হাজার টাকা থেকে ১২শ টাকা পর্যন্ত ডিলার ও কৃষকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে। সূত্র অভিযোগ করেছে, জিপসাম বিক্রির ‘অনুমতি’র নামে কোটা প্রথাও চালু করেছে টিএসপি কমপ্লেক্স। এক্ষেত্রেও বৈষম্য হচ্ছে। কাউকে ১০০ টনের অনুমতি দিলে কাউকে দেওয়া হচ্ছে ২০০ টন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাড়তি দাম হাতিয়ে নিচ্ছে ক্রেতাদের কাছ থেকে। বাড়তি দামের এই খক্ষ পরোক্ষভাবে গিয়ে পড়ছে কৃষকের ওপর। জানা গেছে, ২০০১ সালে নতুন করে সাইট হোল্ডার তালিকাভুক্তির দরপত্র আহ্বান করে টিএসপি কমপ্লেক্স। কিন্তু সাইট হোল্ডারদের পক্ষে উচ্চ আদালতে একটি রিট করা হয়। আদালত দরপত্রের ওপর স্থগিতাদেশ প্রদানের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ওপর রুল জারি করেন। কিন্তু দেখা গেছে, ২২ বছর আগে করা এই রুলের শুনানির জন্য টিএসপি কর্তৃপক্ষ কোনো উদ্যোগই নেয়নি। উচ্চ আদালতের দোহাই দিয়ে নতুন করে তালিকাভুক্ত করা না হলেও গোপনে অন্তত ৫টি সাইট হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটির নাম পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো-জে. আবেদিন অ্যান্ড সন্স, জাফর অ্যান্ড কোম্পানি, আমজাদ অ্যান্ড কোম্পানি এবং নিউ মডেল কমার্শিয়াল করপোরেশন। সার কেলেঙ্কারির দায়ে দণ্ডিত আসামিকেও সাইট হোল্ডার হিসাবে বহাল রেখেছে টিএসপি। সাইট হোল্ডার ওসমান গণি রিপন ও ওমর ফারুক খোকনের বিরুদ্ধে ভেজাল সার উৎপাদন ও বাজারজাতের অভিযোগ আছে। ২০১৯ সালে র‌্যাব তাদের কারখানায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ভেজাল সার জব্দ করে। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের তাৎক্ষণিকভাবে তিন মাসের কারাদণ্ডের পাশাপাশি অর্থদণ্ডও প্রদান করেন। টিএসপির তদন্তেও এটি প্রমাণিত হয়। এরপরও তারা বহাল তবিয়তে রয়েছেন। টিএসপির কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেন সুখেন চন্দ্র বলেন, ‘বহু বছর ধরে তালিকাভুক্ত সাইট হোল্ডাররাই জিপসাম স্তূপীকরণ, শুকানো এবং বিক্রি করে আসছেন। যেহেতু এটি সরাসরি সার নয়; সারের বাইপ্রোডাক্ট তাই নিবন্ধিত ডিলারের মাধ্যমে জিপসাম বিক্রির বাধ্যবাধকতা নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘টিএসপিতে আমি নতুন এসেছি। কোনো ধরনের অনিয়ম থাকলে তা খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’