পণ্য ছাড়াই চলছে ৮-১০ টনের ভ্যান লাগেজ ভ্যানও ‘ডেমু’ হওয়ার আশঙ্কা


রেলে ঢাকঢোল বাজিয়ে চীন থেকে আনা ২০ জোড়া ‘ডেমু’ ট্রেন এখন প্রায় মৃত। ৬০০ কোটি টাকায় কেনা এ ‘ডেমু’ কেনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে অদ্যাবধি নেওয়া হয়নি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। সরকারের এ পুরো অর্থই এক রকম জলে গেছে -এমন মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, আবার একই দেশ থেকে কেনা হয়েছে ৮ থেকে ৯ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ১২৫টি লাগেজ ভ্যান। এর মধ্যে ২৮টি ফ্রিজিং লাগেজ এবং ৯৭টি লাগেজ ভ্যান রয়েছে। ৩৫৮ কোটি টাকায় কেনা লাগেজ ভ্যানগুলোর মধ্যে ৫০টি বাংলাদেশে এসেছে। এর মধ্যে ১৬টি যুক্ত হয়েছে পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে আন্তঃনগর ট্রেনে। বাকিগুলো চলতি বছরের মধ্যেই আসার কথা। যে ভ্যানগুলো চলছে, সেখানে প্রত্যাশা অনুযায়ী পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ সড়কপথেই পণ্য আনা-নেওয়া রেলপথের তুলনায় অপেক্ষাকৃত সহজ। সড়কের যানবাহন ক্রেতা-বিক্রেতার দোরগড়ায় পৌঁছাতে পারে। অন্যদিকে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডিও যথাযথ হয়নি। এমনকি একেকটির ক্রয়মূল্যও অতিরিক্ত ধরা হয়েছে। যা অন্য দেশ থেকে আনলে অনেক সাশ্রয়ী হতো। এমন পরিস্থিতিতে লাগেজ ভ্যানগুলো ডেমু ট্রেনের মতো অবস্থা হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবহণ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, ১২৫টি লাগেজ ৩৫৮ কোটি টাকায় কেনা হয়েছে। এটা কী করে সম্ভব। লাগেজগুলো নিশ্চয়ই যাত্রীবাহী কোচের চেয়ে বেশি উন্নত নয়। ক্রয় অনুমোদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তাদের বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত। এত বেশি টাকায় কেনা লাগেজগুলোর দ্বারা আয় কেমন হচ্ছে। ভেতরে কী রয়েছে। আমি মনে করি, এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি যথাযথভাবে করা হয়নি। শুধু প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দিকেই তাদের বেশি নজর ছিল। এভাবে প্রকল্প গ্রহণে দুর্নীতির শঙ্কা থাকে। তিনি আরও বলেন, আন্তঃনগর ট্রেনে এসব লাগেজ যুক্ত করার বিষয়টিও অযৌক্তিক। আর খেয়াল রাখতে হবে এ প্রকল্প যেন কোনোভাবেই ডেমু ট্রেনের পুনরাবৃত্তি না হয়। অন্যথায় ফের অর্থের অপচয় হবে। রেলপথ সচিব ড. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমরা যাত্রীদের সেবা ও রেলের আয় বাড়াতে লাগেজ ভ্যান যুক্ত করছি। সমস্যাগুলো চিহ্নিত হচ্ছে। এগুলো সমাধান করা হবে। আন্তঃনগর ট্রেনের পেছনে লাগেজ থাকায় প্ল্যাটফর্মের বাইরে কোচ থাকে -নিশ্চয় সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া লাগেজগুলোতে কী করে মালামাল ভর্তি অবস্থায় পরিবহণ করা যায় -সে বিষয়ে কাজ করছি। আমরা চাচ্ছি বিভিন্ন স্টেশনে পণ্য পৌঁছে দিতে। পণ্য সংগ্রহ ও মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি বেসরকারি ব্যক্তি-সংস্থার মাধ্যমে করতে পারলে, আমাদের লক্ষ্য নিশ্চয় পূরণ হবে। বর্তমানে ১৬টি লাগেজ ভ্যান চলছে। রেলসংশ্লিষ্টরা জানান, লাগেজ ভ্যান সাধারণত মেইল-লোকাল ট্রেনে লাগানো হয়। অথবা পুরো একটি ট্রেনের সমন্বয়ে ‘লাগেজ ভ্যান ট্রেন’ প্রস্তুত করা হয়। যার কোনোটাই করা হচ্ছে না। আন্তঃনগর ট্রেনের দৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি থাকে। মাত্র ৩-৪টি স্টেশন ছাড়া কোনো স্টেশন প্ল্যাটফর্মেই এসব ট্রেনের জায়গা হয়নি। ট্রেনগুলোর প্রায় অর্ধেকই থাকে স্টেশন প্ল্যাটফর্মের বাইরে। নতুন লাগেজগুলো আন্তঃনগর ট্রেনের পেছনে যুক্ত করা হচ্ছে। ফলে ওইসব লাগেজ প্ল্যাটফর্মের অনেক বাইরে থাকছে। আন্তঃনগর ট্রেনের বিরতি হয় মাত্র ৩ থেকে ৪ মিনিট। কিন্তু লাগেজে মালামাল ওঠানামায় ৩০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে। রেলওয়ে অপারেশন ও পরিবহণ দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রেনের ইঞ্জিন কিংবা কোচ-লাগেজ ক্রয়ের সঙ্গে এ দপ্তর দুটির সম্পর্ক নেই। অন্য দপ্তরগুলো এসব ক্রয় করে তাদের দেওয়া হয় পরিচালনা করতে। ডেমু ট্রেনের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে। ডেমু চালাতে গিয়ে দুর্নামের সিংহভাগই তাদের ওপরে এসেছে। ডেমুর পর্ব শেষ - সবকটির প্রায় মৃত্যু হয়েছে। নতুন করে চীন থেকে আসা লাগেজ ভ্যানের ক্ষেত্রেও এমন শঙ্কা রয়েছে। এসব লাগেজ আন্তঃনগর ট্রেনের পেছনে যুক্ত করা মানেই -ট্রেনকে শিডিউল বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া। করোনার সময় রাজধানীতে খাদ্যপণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন ট্রেনের সঙ্গে পার্সেল ও কৃষি ট্রেন চালু করা হয়েছিল -যা কৃষকদের কাছে সাড়া ফেলেনি। যার কারণে রেলের ওই প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে। প্রসঙ্গত, রোববার কমলাপুর থেকে লাগেজ ভ্যানের শুভ উদ্বোধন করেন রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেছিলেন, লাগেজ ভ্যান রেলে আয় বাড়াবে। সাধারণ মানুষ স্বল্প খরচে এ ভ্যান ব্যবহার করবে। রোববার কমলাপুর থেকে পূর্বাঞ্চল রেলে চলা জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনের পেছনেও আনুষ্ঠানিকভাবে একটি লাগেজ ভ্যান যুক্ত করা হয়। দুপুরে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনটি সন্ধ্যার পর সিলেট স্টেশনে পৌঁছে। ওই সময় লাগেজ ভ্যানটি স্টেশন প্ল্যাটফর্মের বাইরে থাকায় মাল নামাতে চরম ঝুঁকিতে পড়ে সংশ্লিষ্টরা। ওইদিন সিলেট থেকে রাতে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের পেছনেও একটি লাগেজ ভ্যান যুক্ত করা হয়। যুক্ত ভ্যানটি শূন্য অবস্থায় ঢাকা আসে। সিলেট রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার নূরুল ইসলাম জানান, রোববার ঢাকা থেকে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনের সঙ্গে আসা লাগেজ ভ্যানটি সন্ধ্যায় সিলেট এসে পৌঁছে। ওইদিন রাত সোয়া ১১টায় উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত লাগেজ ভ্যান সম্পূর্ণ খালি অবস্থায় ঢাকা গেছে। সিলেট থেকে সোমবার সকাল সোয়া ১১টায় জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। এ ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত লাগেজ ভ্যানটিতে মাত্র ৩৮ কেজি মাল বুকিং হয়েছে। একইদিন চট্টগ্রামগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেনের লাগেজ ভ্যানে ৭০০ কেজি মাল বুকিং হয়। অথচ এক একটি লাগেজ ভ্যানে প্রায় ১০ টন মালামাল পরিবহণ করা যায়। ট্রেনে যুক্ত প্রতিটি লাগেজ ভ্যানে বুকিং মালামালের তথ্যগুলো ঠিক একইরকম। রেলের পরিবহণ দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্তকর্তা বলেন, এসব লাগেজ মূলত মেইল-লোকাল ট্রেনে লাগানো হয়। কিন্তু এখানে এর উলটো হয়েছে। সারা দেশে ৫-৬টি লাগেজ ভ্যান যথাযথ মালামাল নিয়ে চালানো সম্ভব হবে না। অথচ ১২৫টি লাগেজ ভ্যান কেনা হয়েছে। এছাড়া নতুন করে যে এককভাবে লাগেজ ভ্যান ট্রেন পরিচালনা হবে -এমন সক্ষমতাও রেলে নেই। তিনি আরও বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে সবকটি (১২৫টি) লাগেজ রেলে যুক্ত হবে। এত লাগেজ ভ্যান দিয়ে কী করা হবে। এক্সট্রা ইঞ্জিন, চালক, গার্ড, লোকবল তো নেই। এ ব্যাপারে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি যথাযথভাবে করা হয়নি। কমলাপুর স্টেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘নিজের নাম বলব না -শুধু বলতে চাই চলমান যেসব লাগেজ ভ্যান রয়েছে, তার কোনোটাই পরিপূর্ণ মালামাল নিয়ে চলে না। এখন সড়কপথে খুব সহজেই মালামাল পরিবহণ করছে বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিস। মালামাল বিভিন্ন বাড়ি, পাড়া-মহ ল্লায় সহজে পৌঁছে দিচ্ছে। মানুষ এখন রেলপথে মালামাল পরিবহণ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তাছাড়া এসব লাগেজে মাংস, দুধ, ডিম কখনোই পরিবহণ হবে না। কারণ এসব পণ্য ক্রেতা কিংবা আড়তদারের কাছ পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছে সড়ক যানগুলো। যা রেলের পক্ষে সম্ভব নয়। কাওরান বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, লাগেজ ভ্যানে যেসব মালামাল পরিবহণের কথা বলা হচ্ছে -তা সড়কপথেই আনা বেশি সুবিধা। যখন ট্রাকে মাল আনা হয় তখন ট্রাকগুলো কৃষকের খামার-খেতের কাছ থেকে নিয়ে আসে। কৃষক খেত-খামার থেকে সরাসরি ট্রাকে মাল লোড করে ঢাকায় পাঠায়। এতে তার প্রায় ৩টি খরচ কম হয়। ট্রেনে খরচ কম হবে -এমনটা বলা হলেও মালামাল বিক্রয় কেন্দ্রে আনতে খরচ বেড়ে যাবে, ঝামেলাও থাকবে। ট্রেনে মালামাল উঠাতেও লেবার খরচ লাগবে। আর ট্রাকে কৃষকরা নিজেরাই মালামাল তুলে দেয়। তাছাড়া রেলওয়ে হিমায়িত পণ্য ডোর টু ডোর সার্ভিস দিতে পারবে না। মালামালগুলো স্টেশনে পড়ে থাকবে। প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘কিছু লাগেজ ট্রেনে যুক্ত করা হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে সবকটি (১২৫টি) রেলে যুক্ত হবে। ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি নিশ্চয় করা হয়েছে। ৮-১০ জন কর্মকর্তা চীনে গিয়েছেনও। মিটারগেজ লাগেজগুলোর প্রতিটি ১ কোটি ৬০ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে। এছাড়া ব্রডগেজ লাগেজগুলোর প্রতিটি ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে।’ পার্শ্ববর্তী ভারতে এমন (চীন থেকে কেনা লাগেজ) লাগেজের মূল্য ৩০ থেকে ৫০ লাখ রুপি। চীন থেকে কেনা লাগেজগুলো মূল্য এত বেশি কেন? -এমন প্রশ্নের জবাবে বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘সেটা আমি বলতে পারি না। তবে নিশ্চয় সংশ্লিষ্টরা জেনেশুনেই ত ক্রয় করেছেন। এগুলো ভালো ও উন্নত। রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী বলেন, ‘লাগেজ ভ্যান মূলত লোকাল ও মেইল ট্রেনে লাগানো হয়। আমরা আয় বাড়াতে এবার আন্তঃনগর ট্রেনে যুক্ত করেছি। আমরা নিরাশ হচ্ছি না। প্রচার প্রচারণায় নিশ্চয় এর সুফল পাবে সাধারণ মানুষ-ব্যবসায়ীরা।’