ভূ-রাজনীতির ফাঁদে বাংলাদেশ


বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্র দেশ আছে, যেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বা নির্বাচন বলতে কিছুই নেই। ওই দেশগুলোকে বাদ রেখে কেন দেশটি বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে এত কঠোর পথ বেছে নিল? প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বড় ধরনের বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং প্রবাসী আয়সহ অনেক ধরনের সম্পর্কের পাশাপাশি ‘নিরাপত্তা সহযোগিতা’ আছে, যা মার্কিন জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব মিত্র রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের নানা ধরনের সম্পর্ক রয়েছে। দ্বিতীয়ত, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে ঘিরে ভূ-রাজনীতি। প্রধানত এজন্যই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি জনগণসমর্থিত গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চায়। যুক্তরাষ্ট্র আসলে নানাভাবে বাংলাদেশকে চাপে রেখে চীনের বলয়ের বাইরে আনতে চায়। এটাই বাংলাদেশের ওপর চীনের অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব ঠেকানোর যুক্তরাষ্ট্রের মূল কৌশল। নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং আরও ভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসার আশঙ্কার অন্তর্নিহিত কারণ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, বাংলাদেশ পরাশক্তিগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যের ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতার ফাঁদে পড়েছে। এছাড়া ভারত চিরাচরিতই বাংলাদেশের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি ঘোষণা করে, সেখানে দেখানো হয়েছে-ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূমি বিশ্বের ২৫ শতাংশ ও সমুদ্র ৬৫ শতাংশ। এ অঞ্চলের দেশগুলোর জনসংখ্যা বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি, যার ৫৮ শতাংশই তরুণ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক অর্থনীতির দুই-তৃতীয়াংশ, জিডিপি ৬০ শতাংশ ও ভোক্তা ৬০ শতাংশ। এ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন, ভারত, পাকিস্তান, জাপান ও কোরিয়াসহ এক ডজনেরও বেশি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ আছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, সব মিলিয়ে এ অঞ্চল হয়ে উঠছে বৈশ্বিক রাজনীতির ভরকেন্দ্র এবং আগ্রহের কারণ। বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশসহ অন্তত ১৬টি দেশে নানা কারণে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যার মধ্যে আটটি দেশে ভিসানীতি এবং আটটি দেশের অনেক নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা। এখন পর্যন্ত যে আটটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা পেয়েছে, সেসব দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সুশাসন, মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতারও প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি। ভিসানীতি পাওয়া দেশগুলো হলো-কম্বোডিয়া, নাইজেরিয়া, হাইতি, আফগানিস্তান, বেলারুশ, উগান্ডা, লাইবেরিয়া ও বাংলাদেশ। এ দেশগুলোর মধ্যে নাইজেরিয়ায় নির্বাচনের ছয় মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেও ভোট কারচুপি ঠেকানো যায়নি। শুধু সোমালিয়ার জনগণ ভোটের অধিকার আংশিক ফিরে পেয়েছে। এছাড়া উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমার, ইরান, চীন, রাশিয়া, কঙ্গো, সুদান ও নিকারাগুয়ার অনেক প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকের ওপর যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব ধরনের নিষেধাজ্ঞা পাওয়া প্রায় সব দেশকে নানা ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো দেশে নির্বাচন হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে; কিন্তু দেশটি র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার অনেক পর বাংলাদেশের ওপর জাতীয় নির্বাচনের অন্তত তিন মাস আগে ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সতর্ক দৃষ্টির মধ্যে রেখেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘মার্কিন প্রশাসন এখন দেখবে বাংলাদেশে নির্বাচন ঘনিয়ে এলে সেখানে কী ঘটে।’ তিনি মনে করেন, জো বাইডেন প্রশাসনের গণতন্ত্র প্রসারের এজেন্ডার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একটা দৃষ্টান্ত হিসাবে নিয়েছে দেশটি। তার কথায়, বাইডেন প্রশাসন একটা মূল্যবোধভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি জোরালোভাবে প্রয়োগ করছে। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার জানান, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করতে পারে-এমন যে কোনো ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিকল্প হাতে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ দেশটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্প্রতি ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আরও স্যাংশন দিতে পারে, এটা তাদের ইচ্ছা’ নিষেধাজ্ঞা পাওয়া কোনো দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য সুখবর নয়। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিষেধাজ্ঞায় নিজের কৌশলগত ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ নিহিত থাকে। ফলে নিষেধাজ্ঞা পাওয়া কোনো দেশের জনগণ ও তাদের অর্থনীতি সত্যিকার অর্থেই ভালো থাকে না। তাই অভ্যন্তরীণ আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট সংকট নিরসন করা গেলে এমন নিষেধাজ্ঞা এড়ানো যেত। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হয়েছিল। ২০২১ সালের মে মাসে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘কোয়াড’ নামের ‘বেজিংবিরোধী ক্লাবে’ যোগ না দেয় এবং এটি করলে চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মারাত্মক ক্ষতি হবে। বাংলাদেশ অবশ্য ‘কোয়াড’ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গঠিত কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগের অংশ নয়। তবে এ দেশগুলো যে বাংলাদেশকে বাইডেন প্রশাসনের বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির অংশ করতে চায়, তা মার্চ মাসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার এক বক্তব্যে পরিষ্কার হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে পরের মাসেই অর্থাৎ এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য বাংলাদেশে একটি রূপরেখা ঘোষণা করে। তাতে বাংলাদেশ ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’-এ নীতির ভিত্তিতে ‘ভারসাম্যের’ পথ নেওয়ার কথা ঘোষণা করে। গত ২২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার জানান, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে যারা বাধাগ্রস্ত করবেন তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হবে। এ ভিসা নিষেধাজ্ঞা আওতায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন, ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দল ও বিচার বিভাগ থাকবে। যারা ভিসা নিষেধাজ্ঞা পাবেন, তাদের সন্তানরাও এর আওতায় আসবে। ভিসা নিষেধাজ্ঞা যে ব্যক্তির ওপর আরোপিত হবে, তিনি বা তার পরিবারের কোনো সদস্য যদি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য বা অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে থাকেন, তিনি তা-ও হারাতে পারেন। এমএ আজিজ : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক