বহিস্কার হলেও প্রশাসনের ‘আশীর্বাদ’ পায় ওরা


চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা ঘটনায় বারবার শিরোনামে আসছে ছাত্রলীগ। শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি, সাংবাদিক হেনস্তা, আবাসিক হল ভাঙচুর, ছিনতাই, মারামারিসহ বিভিন্ন ঘটনায় ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীকে বহিস্কারও করেছে প্রশাসন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে গত এক বছরে অর্ধশত শিক্ষার্থীকে বহিস্কার করা হয়েছে। তবে চাপে পড়ে ছাত্রলীগের ব্যাপারে নমনীয় থাকে প্রশাসন। চবিতে বহিস্কারের পরও ছাত্রলীগ নেতাদের পরীক্ষা দেওয়ার নজির আছে। চট্টগ্রাম মেডিকেলে শাস্তি ঘোষণার পরও ক্যাম্পাসে \'রাজত্ব\' করছে বহিস্কৃৃতরা। জানতে চাইলে চবি উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতার বলেন, \'অপরাধীর কোনো দল নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দিয়েছে। সাংগঠনিকভাবেও উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখনও যেসব ঘটনার তদন্ত হচ্ছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে অপরাধীরা পার পাবে না।\' সাংবাদিক হেনস্তার ঘটনা তদন্তের দায়িত্বে থাকা চবির সোহরাওয়ার্দী হলের প্রভোস্ট ড. শিপক কৃষ্ণ দেবনাথ বলেন, \'তদন্ত কমিটি চাইলেও হুটহাট সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তথ্যপ্রমাণ নিয়ে অপরাধী শনাক্ত করতে হয়। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যা যা করা দরকার, আমরা তা করছি।\' মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. শাহেনা আক্তার বলেন, \'মেডিকেলে নানা ঘটনায় আমরা বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিস্কার করেছি। তাদের সংশোধন হওয়ার জন্যও সুযোগ দিয়েছি। এটির অপব্যবহার করছে কেউ কেউ। আমরা এবার আরও কঠোর হব।\' চবিতে বহিস্কার ১৮ জন: চবিতে গত ১১ আগস্ট বেগম খালেদা জিয়া হলে ছাত্রলীগের চার নেত্রীর মধ্যে মারামারি হয়। এ ঘটনায় উপতথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক তাসফিয়া জান্নাত নোলককে দেড় বছরের জন্য বহিস্কার করেছে কর্তৃপক্ষ। তাসফিয়া ইংরেজি বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। কিন্তু বহিস্কারের পরও তিনি প্রভাব বিস্তার করছেন ছাত্রী হলে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে না যাওয়া সাংবাদিককে মারধরের ঘটনায় দুই ছাত্রলীগ কর্মীকে এক বছরের জন্য বহিস্কার করেছে কর্তৃপক্ষ। বহিস্কার দু\'জন হলেন- লোকপ্রশাসন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের আরশিল আজিম এবং নৃবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শোয়েব মোহাম্মদ আতিক। গত ৮ অক্টোবর আলাওল হলের কক্ষ ভাঙচুর ও প্রাধ্যক্ষকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ দুই কর্মীকে এক বছরের জন্য বহিস্কার করেছে কর্তৃপক্ষ। তাঁরা হলেন- সমাজতত্ত্ব বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী হাছান মাহমুদ আর শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শহিদুল ইসলাম। গত ২ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের দু\'পক্ষের সংঘর্ষ ও রাম দা উঁচিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দেওয়ার ঘটনায় ছয় ছাত্রলীগ কর্মীকে বহিস্কার করেছে কর্তৃপক্ষ। তাঁরা হলেন- সংস্কৃত বিভাগের চতুর্থ বর্ষের অনিক দাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তনয় কান্তি শিকদার, অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের লাবিব সাঈদ, ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের সিফাতুল ইসলাম, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের নাহিদুল ইসলাম, একই বর্ষের ইতিহাস বিভাগের মো. মোবারক হোসেন। এ ছাড়া ২৪ আগস্ট শাটল ট্রেনে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে কর্তৃপক্ষের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় আটক ছাত্র অধিকার পরিষদের কর্মী জোবায়ের হোসেনকে দুই বছরের জন্য বহিস্কার করে কর্তৃপক্ষ। গত ৫ ও ৬ জানুয়ারি পরপর দু\'দিন রাতে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল ছাত্রলীগের দুটি পক্ষ। এতে উভয় পক্ষের ১১ নেতা আহত হন। এ ছাড়া আহত হয়েছিলেন সহকারী প্রক্টর শহিদুল ইসলাম। দু\'দিনের ঘটনায় ছাত্রলীগের ছয় নেতাকর্মীকে বহিস্কার করে কর্তৃপক্ষ। তাঁরা হলেন- ফাইন্যান্স বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী আমিরুল হক চৌধুরী, ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী ইকরামুল হক ও দর্শন বিভাগের একই বর্ষের নয়ন দেবনাথ, বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের সাখাওয়াত হোসেন, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মাহমুদুল হাসান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মোহাম্মদ ফাহিম। তবে ক্যাম্পাস ছাড়েননি তাঁদের বেশিরভাগই। পরীক্ষা দিলেন বহিস্কৃত শিক্ষার্থীরা: চবি ছাত্রলীগের দু\'পক্ষের সংঘর্ষের পর বহিস্কৃত এক শিক্ষার্থী গত জানুয়ারিতে পরীক্ষা দিয়েছেন। তিনি হলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের উপপক্ষ সিক্সটি নাইনের কর্মী মাহমুদুল হাসান (ইলিয়াস)। ৫ ও ৬ জানুয়ারি দুই রাতে সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রলীগের ১১ নেতাকর্মী আহত হয়েছিলেন। সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে ইটের আঘাতে আহত হন সহকারী প্রক্টর শহিদুল ইসলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসিপ্লিনারি কমিটির ভার্চুয়াল সভায় এ ঘটনায় মাহমুদুল হাসানসহ ছয় শিক্ষার্থীকে এক বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত হয়। লিখিত আদেশ তৈরি করে কর্তৃপক্ষ এ তথ্য জানালেও ঘটনার পর মাহমুদুল হাসান কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ৪২০ নম্বর কক্ষে পরীক্ষা দিয়েছেন। বহিস্কার হয়েও পরীক্ষা দেওয়ার ঘটনা এটি প্রথম নয়। গত ৩ আগস্ট ছাত্রী হেনস্তার দায়ে বহিস্কৃত হয়েও পরীক্ষা দিয়েছিলেন ছাত্রলীগের দুই কর্মী ইমন আহম্মেদ ও রাকিব হাসান। তাঁরা ২০২১ সালে ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে হেনস্তা করার দায়ে এক বছরের জন্য বহিস্কৃত হয়েছিলেন। পরে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় তাঁদের পরীক্ষার উত্তরপত্র বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর সংঘর্ষে জড়ান শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেনের অনুসারীরা। এর চার দিন পর ১২ শিক্ষার্থীকে ছয় মাসের জন্য সাময়িক বহিস্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপর বহিস্কৃত হয়েও দুই মাসের মাথায় ডিসেম্বরে স্নাতকের প্রথম বর্ষের তিন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় বসেন। তখনও তিন বিভাগের প্রধান দাবি করেন, তাঁরা চিঠি পাননি। এই তিন ছাত্রলীগ কর্মী হলেন- আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের বর্তমান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. নাঈম, একই বর্ষের বাংলা বিভাগের সাইফুল ইসলাম ও আরবি বিভাগের তৌহিদ ইসলাম। মেডিকেল কলেজেও অপরাধীরা পায় আশীর্বাদ: চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আকিব নামে এক শিক্ষার্থীকে গুরুতর আহত করায় পাঁচ শিক্ষার্থী অভিজিত দাশ, সৌরভ ব্যাপারী, সাজেদুল ইসলাম, জাহেদুল ইসলাম ও ইমতিয়াজ আলমকে দুই বছরের জন্য বহিস্কার করা হয়। কিন্তু মাস কয়েক নীরব থেকে আবারও ক্যাম্পাসে দাপিয়ে বেড়াতে থাকেন তাঁরা। একই ঘটনায় এক থেকে দেড় বছরের জন্য বহিস্কার হওয়া অন্য ছয়জনও বহাল তবিয়তে আছেন ক্যাম্পাসে। তাঁরা হচ্ছেন- সাজু দাস, রিয়াজুল ইসলাম, জাকির হোসেন, মাহিন আহমেদ, জুলকাফল মুহাম্মদ শোয়েব ও চমন দাশ। বহিস্কারাদেশ দিলেও তাঁদের সংশোধন হওয়ার জন্য সুযোগ দিয়েছে প্রশাসন। এটিকেই কাজে লাগিয়ে ক্যাম্পাসে সম্প্রতি চার শিক্ষার্থীকে বেধড়ক পিটিয়েছেন তাঁদের কয়েকজন মিলে।