মর্যাদার বাংলাদেশ গড়ে তোলা দরকার
মযহারুল ইসলাম বাবলা, নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
প্রায় ছয় মাস হতে চলল একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের অবসান ঘটেছে। অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে জনমনে বিপুল আশার সঞ্চার হয়েছিল, আশা ছিল সামাজিক সব বৈষম্যের অবসান ঘটবে। আমাদের সামগ্রিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হবে।প্রকৃত স্বাধীনতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছুই ঘটেনি। অতীতের ধারাবাহিকতায় শুধু ক্ষমতারই পরিবর্তন ঘটেছে, আর কিছু হয়েছে বলে অনুমান করা যাচ্ছে না।
দেশের আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনিত ঘটেছে।মব জাস্টিসের তৎপরতা চলছে আইন উপেক্ষা করে। দেশজুড়ে চরম অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পরিস্থিতির সুযোগে সর্বক্ষেত্রে দাবিদাওয়া আদায়ের ধারাবাহিক আন্দোলন চলছে। সড়ক অবরোধ করে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সভা-সমাবেশ, সরকারি চাকরির বয়সসীমা ৩৫ বছর পর্যন্ত বর্ধিত করার দাবিতে শিক্ষার্থীদের অবরোধ, সমাবেশ, ঘেরাও কর্মসূচি পালন, তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি নিয়ে পথ অবরোধ।মহাখালী এলাকায় চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুড়ে ট্রেন যাত্রীদের আহত করার মতো নৃশংস ঘটনাও ঘটেছে। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আইডিয়াল কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের হানাহানিতে জন ও যান চলাচল স্থবির হওয়ার ঘটনা যেন নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা মিলে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা পর্যন্ত চালিয়েছে। শিক্ষার্থীদের একের পর এক দাবিদাওয়ার মাসুল দিতে হয়েছে পথচারী, যানবাহন থেকে সাধারণ মানুষকে। নিরাপত্তার অজুহাতে সিটি করপোরেশনের রাস্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিকেল ৪টা থেকে জন ও যান চলাচল বন্ধ করায় অঞ্চলজুড়ে তীব্র যানজটে মানুষকে নাকাল হতে হচ্ছে।
সিটি করপোরেশনের রাস্তা বন্ধ করার এখতিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের থাকার নয় বলে অনেকে মন্তব্যও করেছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্তে অটল।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে গার্মেন্টস শ্রমিকদের অবদান অপরিসীম। কয়েক মাস যাবৎ শ্রমিকদের মজুরি প্রদান না করার ফলে পরিবারসহ তাদের জীবন-ধারণ চরম সংকটের মুখে। বাধ্য হয়ে তারা আশুলিয়ায় মজুরি প্রদানের দাবিতে পথে নামে।অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রচুর কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান ধ্বংসে অগণিত শ্রমিক কর্মহীন বেকার হয়েছে। পরিবার নিয়ে পথে বসেছে প্রচুর শ্রমজীবী মানুষ। দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর। নিজের জমানো অর্থ বেশ কয়টি ব্যাংক প্রদান করতে পারছে না, নগদ অর্থের অভাবে। ব্যাংক থেকে অর্থ লোপাট হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ পথে বসে পড়েছে। ওদিকে দেশের খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে দেশজুড়ে চলছে নীরব দুর্ভিক্ষ। দেশের সমষ্টিগত মানুষ খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির শিকার। অতীতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের কথা চাউর ছিল। বেক্সিমকোর কারখানা বন্ধের কারণে প্রায় অর্ধলক্ষ শ্রমিক বেকারে পরিণত হয়ে আশুলিয়া অঞ্চলে গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করে প্রতিবাদে নেমে বন্ধ করে দিয়েছে সব সড়ক। জীবিকা হারিয়ে অগণিত মানুষ মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। এখন তবে কোন সিন্ডিকেটের খপ্পরে আমরা পড়েছি? খাদ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে এসেছে।চুরি, ডাকাতি, হত্যাসহ রাহাজানির নানা খবর পাওয়া যাচ্ছে। খোদ ঢাকা শহরের মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় চুরি-ডাকাতি রোধে স্থানীয়রা রাত জেগে পাহারা দেওয়ার সংবাদও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বাস্তবে আমরা একটি ক্রান্তিকাল যে অতিক্রম করছি, এতে তো দ্বিমতের অবকাশ নেই। জনমনে ক্রমাগত ক্ষোভ ও হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে সরকার নানাবিধ সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত। এখতিয়ারবহির্ভূত একের পর এক কর্মসূচি নিয়ে হাজির হচ্ছেন সমন্বয়করা। সরকারও তাদের সঙ্গে সহমত পোষণ করছে। দেশবাসীর বিদ্যমান সংকট থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে চালিত করার কৌশল কি! অথচ দেশবাসীর দুরবস্থা লাঘবে সরকারের ভূমিকা শূন্য। আইএফএমের নির্দেশনায় নতুন ভ্যাট আরোপ করেছে সরকার।বেকারত্বের কারণে শহরজুড়ে চলছে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও চীনের তৈরি ইজি বাইক। এসব বাহনের চালকদের নেই প্রশিক্ষণ। এসব রিকশা, ইজি বাইকের নেই অনুমোদন। বেপরোয়া এই ব্যাটারিচালিত যানে অহরহ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে যাত্রী ও পথচারী। এসব যান চলাচলের ফলে শহরের মূল সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। আদালত সম্প্রতি ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাদের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থার কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় ব্যাটারিচালিত রিকশা শ্রমিকরা পথে নেমে অবরোধ, সভা-সমাবেশ শুরু করায় সরকার বাধ্য হয়ে চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী ছাত্রীর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার পর আদালত ওই যান বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিল। ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজি বাইকে এরই মধ্যে অজস্র মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। টনক নড়ে জাবির ছাত্রীর প্রাণ হারানোর পর। আমরা নিশ্চয় এই বেপরোয়া অবৈধ যানমুক্ত চাই। তবে পাশাপাশি চাইব ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজি বাইক চালকদের বিকল্প কর্মসংস্থান। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। যানজটের কারণে নগরবাসীর কর্মঘণ্টা কী পরিমাণে নষ্ট হচ্ছে, সেটা শুধু ভুক্তভোগীরাই প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করছে। আমরা যানজটমুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রত্যাশা করতেই পারি।অভ্যুত্থান-পরবর্তী আমরা প্রবল আশাবাদী হয়েছিলাম। কিন্তু দুরবস্থা যেন পিছু ছাড়ছে না।বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ায় সাধারণ মানুষ আশাবাদী হয়েছিল। মানুষ যেমন স্বাধীনতা চায়, তেমনি চায় মুক্তিও। বিগত ৫৩ বছর দেশে গণতন্ত্র অধরাই ছিল। মানুষের জীবন ছিল রাজতান্ত্রিক শাসনামলের প্রজাদের মতো। আমাদের দেশের প্রাতিষ্ঠানিক নামেই তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মুক্ত হব কিভাবে! সংবিধানে লেখা আছে, এই রাষ্ট্রের মালিক রাষ্ট্রের জনগণ। আবার এটাও লেখা রয়েছে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার অধিকারী সরকারের প্রধান নির্বাহী। এসব স্ববিরোধী বিষয়ের অবসান চাই। চাইব সংবিধানকে অখণ্ড রেখে গণতন্ত্রায়ন।আমরা শক্তিশালী রাষ্ট্রের বিপরীতে শক্তিশালী সমাজ চাই। যাতে রাষ্ট্র সাবেকি আমলের ধারাবাহিকতায় জনগণের ওপর কর্তৃত্ব, নিপীড়ন করা থেকে বিরত থাকতে পারে। সমাজে ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সব ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে, সব মানুষের সম-অধিকার, সম-মর্যাদার বাংলাদেশ গড়ে তোলা দরকার। অর্থাৎ একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেমন চাই, তেমনি চাই গণতান্ত্রিক নির্বাচিত সরকারও। তেমন আলামত কিন্তু দেখা যাচ্ছে না।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।