ইউরোপীয় স্থাপত্যশিল্পে মুসলিম প্রভাব


ইউরোপীয় স্থাপত্যশিল্পে মুসলিম প্রভাব
খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতক। ইংল্যান্ডের ওয়েলসের একজন নাইট ক্রুসেড থেকে দেশে ফিরেছেন। তিনি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন একজন ফিলিস্তিনি রাজমিস্ত্রি। স্থানীয়রা তাঁকে লেলিস নামে ডাকে, যা মূলত আরবি আল আজিজের ভুল উচ্চারণ।রাজমিস্ত্রি আজিজ বেশ কয়েকটি আশ্রম, দুর্গ ও গির্জা নির্মাণ করেন। যার মধ্যে দক্ষিণ ওয়েলসের নেথ অ্যাবে অন্যতম, যা বর্তমান ইংল্যান্ডের সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রাচীন ধ্বংসপ্রাপ্ত আশ্রম। একাদশ খ্রিস্টাব্দে অপর একজন ফিলিস্তিনি রাজমিস্ত্রি আল ওমর দক্ষিণ ইংল্যান্ডের নরফোকে দৃষ্টিনন্দন ক্যাসেল একর প্রাইরি নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন। গবেষক ডায়ানা ডার্ক মনে করেন, ব্রিটিশ স্থাপত্যের ঐতিহ্য হয়ে ওঠা স্থাপনাগুলো নির্মাণে লেভ্যান্ট (শাম ও লেবানন) অঞ্চলের স্থপতি ও নির্মাণ প্রকৌশলীদের এই সহযোগিতা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়।মধ্য যুগে ইউরোপের নির্মাণ ও আলংকারিক কারুশিল্পের জগৎ মুসলিমদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তিনি তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত বই ‘ইসলামিস্কো’তে এমনটিই দাবি করেছেন। তিনি তাঁর আগের বই ‘স্টিলিং ফ্রম দ্য সারাসেনস’-এ দাবি করেছিলেন ইউরোপের বহু সেরা স্থাপনা ইসলামী স্থাপত্যরীতি দ্বারা প্রভাবিত। ডার্ক তাঁর বইয়ে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের প্রমাণ করেছেন যে মধ্য যুগে গড়ে ওঠা ‘রোমানেস্কো’ নামক স্থাপত্যরীতি ইসলামী রীতি দ্বারা উজ্জীবিত ছিল।এখানেই শেষ নয়, বরং ইউরোপজুড়ে রোমানেস্কো রীতিতে নির্মিত সেরা স্থাপত্যকর্মের অনেকগুলোই আরব ও মুসলিমরা নির্মাণ করেছে। স্থাপত্যশিল্পের এসব নথিপত্র মধ্য যুগে সমগ্র ইউরোপে মুসলমানদের অস্তিত্বের জানান দেয়। আর এটাও প্রমাণিত হয় যে তখন ইউরোপে মুসলিমরা বসবাস করত একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে। যারা ছিল সুদক্ষ, উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন, উচ্চ বেতনভোগী এবং সমাজের সম্মানিত সদস্য। কোনো সন্দেহ নেই ইউরোপীয় সভ্যতা (মুসলিম) অভিবাসীদের উচ্চতর দক্ষতার ওপর নির্মিত হয়েছিল। ডার্ক যুক্তির সঙ্গে বলেছেন, রোমানেস্কো খ্রিস্টীয় দশম থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যরীতি। রোমানেস্কোই গোথিক স্থাপত্যরীতির পথ প্রশস্ত করেছিল। রোমানেস্কো যার অর্থ রোমানদের রীতিতে তাকে ইসলামিস্কো (ইসলামী রীতিতে) বললেই সহজে সত্য উপলব্ধি করা যাবে।লেখকের মতে, খ্রিস্টান ইউরোপ যখন সম্পদশালী হয়ে উঠেছিল এবং চার্চ ও সমাজপতিরা নির্মাণ খাতে তাদের বরাদ্দ বাড়াচ্ছিল তখন ইউরোপে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন আরব কারিগর, শিল্পী, স্থপতি ও নির্মাণ প্রকৌশলীদের আগমন বৃদ্ধি পেয়েছিল। এসব নির্মাণশিল্পী ও কারিগররা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে থেকে কাজ করতে পছন্দ করত। তাদের ইউরোপে আগমনের পথ ছিল মুসলিম শাসিত সিসিলি। সিসিলিতেও এমন বহুসংখ্যক মুসলিম স্থাপত্য আছে, যা নিয়ে গর্ব করা যায়। আগ বাড়িয়ে এটাও বলা চলে, ইতালির সর্বত্র ইসলামী স্থাপত্যরীতির বহু নিদর্শন আছে। ইতালির বিখ্যাত পিসার হেলানো টাওয়ারের কথাই ধরা যাক। যার অভ্যন্তরীণ জ্যামিতিক নকশা, কলাম ও অলংকরণ সব কিছুই ইসলামী স্থাপত্যরীতি ও নান্দনিকতার বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে। এটাকে আরব প্রভাবের উজ্জ্বল নিদর্শনও বলা যায়। ইতালির মতো স্পেনও মুসলিম স্থাপত্যরীতি দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত ছিল। স্পেনে বিদ্যমান মুসলিম স্থাপত্যগুলোর সঙ্গে মুসলিম শাসন অবসানের পরবর্তী স্থাপত্যগুলোর তুলনা করলেই বৈশিষ্ট্যগত মিল চোখে পড়বে এবং মুসলিম প্রভাবও স্পষ্ট হবে।পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো যেমন—জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ, যেখানে মূলত কখনো ইসলামী শাসন ছিল না, সেখানেও ইসলামী স্থাপত্যরীতির প্রভাব দৃশ্যমান। যেমন—ইউরোপে টিকে থাকা মধ্য যুগের চারটি অলংকৃত কাঠের সিলিংয়ের একটি সেন্ট মাইকেল গির্জায় বিদ্যমান। গির্জাটি উত্তর জার্মানির হিল্ডেসেইমে অবস্থিত। একাধিক বৈশিষ্ট্য থেকে বোঝা যায় সিলিংটি ইসলামী স্থাপত্যরীতি দ্বারা প্রভাবিত। ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট ফ্রান্সের সাইন নদীর তীরে লেজ আন্দেলেইজ শহর নির্মাণে মুসলিম নির্মাতাদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। যেখানে এখনো ইসলামী স্থাপত্যরীতির প্রতিধ্বনি শোনা যায়। যার মধ্যে আছে একাধিক খিলানযুক্ত ঘর, ছায়াযুক্ত পথ এবং গোপনীয়তার রক্ষার উপায়।ফ্রান্সে ইসলামী স্থাপত্যরীতি দ্বারা প্রভাবিত আরেকটি স্থাপত্য নিদর্শন হলো লে পুই ক্যাথেড্রাল। ফরাসিরাও স্বীকার করে এটা দারুণভাবে ইসলামী রীতি দ্বারা প্রভাবিত, বিশেষ করে এর সাদা-কালো খিলান, সম্মুখ ভাগের গঠন এবং দরজায় লেখা ‘আল মুলকু লিল্লাহ’ (সার্বভৌমত্ব কেবল আল্লাহর) বাক্য অস্বীকারের সব পথ বন্ধ করে দেয়।ইউরোপে মুসলিম স্থাপত্যরীতির প্রভাব বিস্তারে নরম্যানরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা সিসিলি, ইতালি ও স্পেন থেকে ইসলামী রীতি রপ্ত করেছিল। তারা ব্যাপক হারে মুসলিম স্থপতিদের মতো ছেদকারী খিলান, তোরণ, জ্যামিতিক প্যাটার্ন ও জিগজাগ ব্যবহার করেছিল, যা পূর্বে ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতিতে অজানায় ছিল। ডায়ানা ডার্কের দাবি, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের প্রতিটি নরম্যান গির্জা ও ক্যাথেড্রাল এবং অন্যান্য ভবন ও স্থাপত্য ইসলামী প্রভাবের প্রমাণ। একইভাবে নরফোকের ক্যাসল রাইজিং ইসলামী বিশ্বের অবকাশ ও শিকার কেন্দ্রের আদলে নির্মিত, উইলিয়াম দ্য কনকারর কর্তৃক নির্মিত লন্ডন টাওয়ারের খিলানগুলো ইসলামী রীতি দ্বারা প্রভাবিত, অ্যাংলো-স্যাক্সন বণিক দ্বারা নির্মিত ব্রিস্টল ক্যাথেড্রালের অভ্যন্তর ভাগে ইসলামী রীতির জিগজাগ ব্যবহার করা হয়েছে।ডায়ান ডার্কের গবেষণা কর্মটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ, যা মধ্য যুগে ইউরোপের মুসলমানদের ভুলে যাওয়া ইতিহাস, তাদের অর্জন ও অবদানকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে; যা উগ্র ডানপন্থী ইউরোপীয় নেতাদের মুখে একটি দারুণ চপেটাঘাতও বটে। কেননা তারা ইউরোপে মুসলমানের যেকোনো উপস্থিতিকে নিন্দার দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করে এবং মুসলিম ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অবদানকে বরাবর অস্বীকার করে। ডার্ক মনে করেন, কয়েক দশক আগেও ইউরোপে মুসলিম স্থপতি, কারিগর ও প্রকৌশলীদের পরিচয় আড়াল করার প্রচেষ্টাটা এত প্রবল ছিল না, যেমনটি বর্তমানে দেখা যায়। বর্তমানে ইউরোপকে মুসলিম ঐতিহ্য থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার একটি প্রচারণা চলছে, যা ইতিহাস বিকৃতিরই অংশবিশেষ।