‘প্যাডসর্বস্ব’ রাজনৈতিক দলগুলোও তৎপর


‘প্যাডসর্বস্ব’ রাজনৈতিক দলগুলোও তৎপর
নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধন পেতে আবেদন করা রাজনৈতিক দলগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশই ‘প্যাডসর্বস্ব’। ওই সব দলের নেই ন্যূনতম একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয়, দলীয় গঠনতন্ত্র এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। কেউ দলীয় কার্যালয়ের ঠিকানা দিয়েছে ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস অফিস। কেউ বা সিকিউরিটি কোম্পানির অফিসকে দলীয় কার্যালয় হিসাবে দেখিয়েছেন। অস্তিত্বই নেই এমন ঠিকানাতেও দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় আছে বলে আবেদনে দাবি করা হয়েছে। এছাড়া কেউ আবার বসতবাড়িকে রাজনৈতিক দলের ঠিকানা হিসাবে ব্যবহার করেছেন। জাতীয় নির্বাচন এলেই তৎপরতা বাড়ে এসব দলের। নিবন্ধন পেতে করেন দৌড়ঝাঁপ। কখনো কখনো বড় দলের নেতা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে লবিং-গ্রুপিং করারও অভিযোগ রয়েছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইসিতে দুই ধাপে ১৪৪টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পাওয়ার জন্য আবেদন করেছে। ৩টি দল দুবার করে আবেদন করায় আবেদনের সংখ্যা ১৪৭টিতে দাঁড়িয়েছে। ওই তালিকায় এই ধরনের দল যেমন রয়েছে, তেমনি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসপি) মতো আলোচিত রাজনৈতিক দলও রয়েছে।ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রথম ধাপে যে ৬৫টি দল আবেদন করেছিল, তাদের মধ্যে ১৪টি দল শুধু দলীয় প্যাডে আবেদন করে। ওই সব দল আর কোনো তথ্য-উপাত্ত দেয়নি। বাকি ৫১টি দলের বেশির ভাগই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেয়নি। দ্বিতীয় ধাপে জমা দেওয়া ৭৮টি দলের কাগজপত্র যাচাই করা হচ্ছে। সেখানেও অনেক দল শুধু দলীয় প্যাডে আবেদন করেছে। ওই সব দলগুলো গঠনতন্ত্র, দলীয় লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে কিছুই জমা দেয়নি। ওই কর্মকর্তারা বলেন, প্রতিটি নির্বাচনের আগে নতুন নতুন দলের তৎপরতা শুরু হয়। নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর ওই সব দলের তৎপরতা দেখা যায় না। তারা আরও জানান, প্রত্যেকবার এভাবে অনেক দল আবেদন করে। বাস্তবে ২-৪টি দল নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য হয়। প্রসঙ্গত : বর্তমানে ইসিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫১টি।নিবন্ধন পেতে নতুন দলের আবেদন প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের বলেন, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আবেদন জমা ২২ জুন শেষ হয়েছে। আমরা ১৪৪টি দল থেকে ১৪৭টি আবেদন পেয়েছি। ৩টি দল একাধিক আবেদন দিয়েছে। আবেদনগুলোর প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করছেন ইসির ২০ কর্মকর্তা।নিয়ম অনুযায়ী, নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পেতে ১০টি তথ্য আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়। নিবন্ধন ফি হিসাবে দিতে হয় ৫ হাজার টাকা, যা অফেরতযোগ্য। নতুন দলের ক্ষেত্রে নিবন্ধনের শর্ত হলো, দলটির একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয় থাকতে হবে। কার্যকরী কমিটি থাকতে হবে কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায়। সদস্য হিসাবে অন্তত ১০০টি উপজেলা কিংবা মহানগরীর থানার কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থনের নথিও দেখাতে হবে। দলীয় প্যাডে দরখাস্তের সঙ্গে দলের গঠনতন্ত্র, নির্বাচনি ইশতেহার (যদি থাকে), দলের বিধিমালা (যদি থাকে), দলের লোগো ও দলীয় পতাকার ছবি, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সব সদস্যের নামের তালিকা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও সর্বশেষ স্থিতি জমা দিতে হয়। যেসব দল এসব শর্ত পূরণ করে তারাই নিবন্ধনের যোগ্য হয়ে থাকে।ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস অফিস দলীয় কার্যালয় : নিবন্ধন পেতে ইসিতে আবেদন করেছে ‘জাতীয় ন্যায় বিচার পার্টি’। আবেদনে কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখানো হয়েছে রাজধানীর নয়াপল্টনে ইসলাম টাওয়ারের সপ্তম তলা। সেখানে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় ওই নামে কোনো দলীয় কার্যালয় নেই। কখনো সেখানে রাজনৈতিক দলের কার্যালয় ও কার্যক্রম কেউ দেখেননি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আল আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস নামক একটি প্রতিষ্ঠানের অফিসকে কাগজে-কলমে দলীয় কার্যালয় হিসাবে দেখিয়েছেন আবেদনকারীরা। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক আল আমিন জাতীয় ন্যায় বিচার পার্টির সাধারণ সম্পাদক। এছাড়া দলের গঠনতন্ত্রসহ আর কিছুই নেই। তবুও নিবন্ধন পাওয়ার আশা দলটির নেতাদের।জানতে চাইলে জাতীয় ন্যায় বিচার পার্টির চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামান বলেন, হুট করে দল গঠন করে কাগজপত্র ইসিতে জমা দিয়েছি। এ কারণে প্রস্তুতি নিতে পারিনি। দলীয় কার্যালয়ের জন্য আমরা কাছাকাছি একটি অফিস খুঁজছি। আর গঠনতন্ত্র তৈরির কাজ শুরু করেছি।অস্তিত্ববিহীন ঠিকানায় কেন্দ্রীয় কার্যালয় : ‘জাস্টিস ফর হিউমিনিটি পার্টি’। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা-১০২/৪, শহীদ ফারুক রোড, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা। সরেজমিন ওই ঠিকানার কোনো অস্তিত্ব নেই। অথচ এই ঠিকানায় কেন্দ্রীয় কার্যালয় থাকার তথ্য দিয়ে ইসিতে নিবন্ধন চেয়েছেন ‘জাস্টিস ফর হিউমিনিটি পার্টি’র নেতারা। গতকাল খোঁজ নিতে গেলে দলটির নেতারা পার্শ্ববর্তী আরেকটি অফিসে নিয়ে যায়। উত্তর যাত্রাবাড়ীর ৩১/সি ঠিকানার ওই অফিসটি এক রুমের। সেখানে একাধিক প্রতিষ্ঠানের নাম। নেই দলীয় সাইনবোর্ড। দলটির চেয়ারম্যান মো. শাহজালাল চৌধুরী থাকেন কুমিল্লায়। ওষুধের দোকান রয়েছে তার। আর সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত হোসেন সাপ্তাহিক দেশের ডাক নামক একটি পত্রিকার নরসিংদী জেলা প্রতিনিধি হিসাবে দাবি করেছেন।সরেজমিন এ প্রতিবেদক গেলে মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমরা অফিসের ঠিকানা পরিবর্তন করব। আমাদের ২১ জেলা ও ১০০ উপজেলায় আহ্বায়ক কমিটি আছে। আমরা শর্ত পূরণ করায় নিবন্ধন পাব। কেন্দ্রীয় কার্যালয় না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, এই অফিসের সামনে সাইনবোর্ড সাঁটানো হবে। নতুন সাইনবোর্ড বানানো হয়েছে। কমিটিও গঠন করা হয়েছে।রাজনৈতিক দলের ঠিকানায় সিকিউরিটি কোম্পানির অফিস : নতুন বাংলাদেশ পার্টির (এনবিপি) দলীয় কার্যালয়ে সিকিউরিটি কোম্পানির অফিস পাওয়া গেছে। শনিবার দুপুরে সরেজমিন উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ১৯নং রোডের ৯নং বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায়, রাজনৈতিক দলের কার্যালয় হিসাবে কোনো দলীয় প্রচার-প্রচারণার ছিটেফোঁটাও নেই সেখানে। ষষ্ঠ তলা ভবনের সবার উপরে তাকিয়ে দেখা যায় একটিমাত্র ব্যানার ঝুলছে। বিশাল উঁচুতে থাকায় ব্যানারের লেখা-ছবি কিছুই স্পষ্ট নয়।বাড়ির নিচতলার গ্যারেজে ভবন দেখভালের দায়িত্বে থাকা মো. শফিকুল ইসলামের কাছে রাজনৈতিক দলের অফিসের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, লিফটের ৬ তলার অফিস এখন নেই। লোকজন নেই, আপাতত বন্ধ আছে। ওইখানে এখন সিকিউরিটি কোম্পানির অফিস।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই বাড়ির মালিক দয়াল কুমার বড়ুয়া। এ বিষয়ে মুঠোফোনে কল দিয়ে দলীয় কার্যালয় বন্ধ থাকার কারণ জানতে চাইলে নিজেকে নতুন বাংলাদেশ পার্টির মহাসচিব পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, উত্তরাতে এখন কোনো অফিস নেই। মূল অফিসটা এখন মিরপুর ডিওএইচএস আর মালিবাগে রয়েছে বলে জানান।স্থানীয়রা জানান, ভবনটির ২য় তলায় বায়িং হাউজ, ৩য় তলায় ভবন মালিকের ফ্ল্যাট, ৪র্থ তলায় আবাসিক বাসা, ৫ম তলায় চাইনিজদের অফিস ও ৬ষ্ঠ তলা সিকিউরিটি কোম্পানির অফিস। নতুন বাংলাদেশ পার্টির নামে ৬ষ্ঠ তলায় একটি নামকাওয়াস্তে ব্যানার ঝুললেও কার্যক্রম নেই বললেই চলে।দলীয় ব্যানার টানানো ঠিকানায় সিকিউরিটি কোম্পানির অফিসের ব্যাপারে জানতে চাইলে নতুন বাংলাদেশ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর (অব.) শিকদার আনিসুর রহমান বলেন, ওটা পার্টি অফিস না। এ বিষয়ে ইসিকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। তিনি বলেন, দল ঘোষণার সময় দয়াল কুমার বড়ুয়া আমার সঙ্গে ছিলেন। ওটা উনার নিজের বাড়ি। তখন পার্টি অফিস হিসাবে ওটা দেখানো হয়েছে। দলের বর্তমান কার্যক্রম মিরপুর ডিওএইচএসের নিজ অফিস থেকে পরিচালিত হয় এবং মালিবাগেও দলীয় অফিস রয়েছে বলে জানান তিনি।ঢাকায় কেন্দ্রীয় কার্যালয় নেই অনেক দলের : নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পেতে আবেদন করা অনেক রাজনৈতিক দলের ঢাকায় কোনো কেন্দ্রীয় কার্যালয় নেই। দেশের বিভিন্ন জেলায় ওইসব দলের কার্যালয় রয়েছে বলে আবেদনে উল্লেখ করেছে। এর একটি হচ্ছে-বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি। আবেদনে দলটির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য উল্লেখ করেনি। দলটির প্রধান কার্যালয় হিসাবে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার উত্তর শ্রীপুর উল্লেখ রয়েছে। জানতে চাইলে দলটির চেয়ারম্যান মো. জয়নাল আবেদিন জমিদার সাংবাদিকদের জানান, গাইবান্ধা ছাড়া কোথাও দলীয় কার্যালয় নেই। ইসিতে যে আবেদন করেছেন, সেখানে ভুল থাকায় আবারও আবেদন করার জন্য ১৫ দিন সময় চেয়েছি।এছাড়া কোয়ালিশন ন্যাশনাল পার্টির (সিএনপি) কার্যালয় বান্দরবান, বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির কার্যালয় খুলনায়, মানবিক বাংলাদেশ পার্টি ও বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টির কার্যালয় গাজীপুর, বাংলাদেশ গণবিপ্লবী পার্টির কার্যালয় সাতক্ষীরায় অবস্থিত।জনতার দলের অফিসে ছিল তালা : বনানীর ৮ নম্বর রোডের ১৮ নম্বর হাউজে যা হাইটস হাউজ নামে পরিচিত। এই হাউজের তৃতীয় তলায় জনতার দলের প্রধান কার্যালয়। ২৮ জুন শনিবার বিকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় অফিসে কেউ নেই। বাইরে ঝুলছে তালা। দারোয়ানের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, ২-৩ জন লোক মাঝেমধ্যে আসে তারা কে কোন দল করে অথবা কার কোন পোস্ট তিনি কিছুই জানেন না। বিল্ডিংয়ের দারোয়ান জনতার দলের অফিসে কর্মরত একজনের মুঠোফোন নম্বর দেন। সে মুঠোফোন নম্বরে দফায় দফায় যোগাযোগ করা হলেও তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যায়নি।