সাগরের ছোট মাছে বড় বাণিজ্যের আশা


সাগরের ছোট মাছে বড় বাণিজ্যের আশা
সমুদ্রের সুনীল জলরাশির নিচ থেকে জেলের জালে উঠে আসে ছোট বহু মাছের ঝাঁক। তাদের মধ্যে সাদা মাংসের ছোট মাছ ঘিরে তৈরি হয়েছে নতুন সম্ভাবনা। ছোট সামুদ্রিক পোয়া মাছ বা জিউ ফিশ দিয়ে বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন করা হচ্ছে সুরিমি নামে একটি খাবার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জনপ্রিয় খাদ্যপণ্য সুরিমির উৎপাদনের মধ্য দিয়ে বদলে যেতে পারে দেশের মাছ প্রক্রিয়াজাত শিল্পের দৃশ্যপট।সুরিমি হলো মাছ দিয়ে তৈরি এক ধরনের প্রক্রিয়াজাতকৃত পেস্ট। এটি ফিশ বল, ক্র্যাব স্টিক, সিঙাড়া, সমুচা, সসেজ, কেকসহ বিভিন্ন ধরনের সি-ফুড স্ন্যাকস তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। জাপান, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে সুরিমি বহু বছর ধরেই জনপ্রিয়। তবে বাংলাদেশে এ খাদ্যপণ্যটি এখনো অনেকের অচেনা। পরীক্ষামূলকভাবে সুরুমি উৎপাদন শুরুর পর এ প্রকল্পে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলে যেসব ছোট মাছ ধরা পড়ে; বিশেষ করে পোয়া মাছ, তা দিয়ে আন্তর্জাতিক মানের সুরিমি তৈরি করা সম্ভব। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু) এবং ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পে’র যৌথ উদ্যোগে এক বছরের বেশি সময় ধরে গবেষণার পর এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেছে।গবেষণায় সাফল্য পাওয়ার পর গবেষকরা উন্নত প্রক্রিয়াজাত প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিল্প সংশ্লিষ্টদের সুরুমি উৎপাদনের প্রশিক্ষণও দিয়েছেন। তারা বলছেন, এ উদ্যোগের মাধ্যমে চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রক্রিয়াজাত শিল্প এখন সুরিমিভিত্তিক পণ্য উৎপাদনে প্রবেশ করতে পারে। সিভাসুর প্রযুক্তি, ছোট মাছের নিরবচ্ছিন্ন জোগান এবং বিদ্যমান বরফ ও কোল্ড চেইন ব্যবস্থার সমন্বয়ে সুরিমি উৎপাদন ঘিরে ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।গবেষকরা আরও জানান, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে ছোট সাদা মাছ ধরা পড়ে—বিশেষ করে জিউ ফিশ। এগুলোর বেশিরভাগই রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। এতে মাছের গুণগত মান নষ্ট হয়। পোকামাকড়ের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বাজারে ন্যায্য দাম মেলে না। অথচ একই মাছ যদি আধুনিক পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত করে সুরিমি হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে পণ্যের গুণমান যেমন বজায় থাকে, তেমনি আয়ুষ্কালও বাড়ে। সবচেয়ে বড় কথা, এর আর্থিক মূল্যও কয়েকগুণ বেড়ে যায়।গবেষকরা আরও জানান, বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ মৎস্য প্রক্রিয়াজাত কারখানা কেবল চিংড়ি বা কাঁচা মাছ হিমায়নে সীমাবদ্ধ। সুরিমি উৎপাদনের মাধ্যমে কারখানাগুলো উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনতে পারবে। অব্যবহৃত অবকাঠামোর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হবে এবং তৈরি হবে নতুন আয়ের পথ।প্রকল্পের প্রধান গবেষক ও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মো. কামাল বলেন, এ উদ্যোগ কেবল বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্যই নয়, ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্যও নতুন সুযোগ তৈরি করছে। আধা-প্রক্রিয়াজাত সুরিমি ব্যবহার করে স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের রেডি-টু-কুক বা রেডি-টু-ইট পণ্য উৎপাদন করা যাবে। এর মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকার নারী ও তরুণদের কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে।তিনি আরও বলেন, পরিবেশগত দিক থেকেও এ উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ। জিউ ফিশের মতো অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহৃত মাছকে কাজে লাগানো হলে রূপচাঁদা বা ইলিশের ওপর আহরণ চাপ কমবে। পাশাপাশি টেকসই মাছ ধরার প্রবণতা বাড়বে এবং জেলেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে। অংশীদারত্বভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠবে একটি দীর্ঘমেয়াদি মৎস্য-ইকোসিস্টেম, যার সুফল পাবেন জেলে, কারখানা শিল্প, বিক্রেতা, ভোক্তাসহ সবাই।