রাজধানীতে নামে-বেনামে অর্ধশতাধিক ‘সিসা বার’
মোঃ রাছেল রানা, প্রধান সম্পাদক
ক্যাফেটেরিয়ার মতো নানা ছদ্মবেশে রাজধানীজুড়ে চলছে অবৈধ সিসা বারের কার্যক্রম। এসব বার বা লাউঞ্জে উচ্চমাত্রার নিকোটিনযুক্ত সিসা ছাড়াও মিলছে মদ, ইয়াবা ও আইসের মতো ভয়ংকর সব মাদক। সব ধরনের মাদক সেবনের ওয়ান স্টপ সার্ভিস বনে যাওয়া এসব বারে মিলছে তরুণ-তরুণীদের অনৈতিক কার্যকলাপের সুযোগ। সন্ধ্যা নামতেই কিশোর গ্যাংসহ বিভিন্ন অপরাধীর অভয়াশ্রম হয়ে ওঠে সিসা বারগুলো। সম্প্রতি রাজধানীর বনানীর ৩৬০ ডিগ্রি নামক সিসা বারে হত্যাকাণ্ডের পর নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, রাজধানীর বনানী, উত্তরা ও মিরপুরসহ বেশ কিছু আবাসিক এলাকায় নামে বেনামে চলছে অর্ধশতাধিক সিসা বার। এর বাইরে চট্টগ্রামেও সিসা বারের কার্যক্রমের তথ্য রয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে রাজধানীর ১৭টি সিসা বারে নজরদারি চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শিগগিরই এসব বারে অভিযান পরিচালনা করা হবে। যেসব বারের কার্যক্রম বন্ধের প্রক্রিয়া চলছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-বনানীর সেলসিয়াস, এক্সোটিক, কিউডিএস, সিগনেচার, অরা, ৩৬০ ডিগ্রি, আরগেলা, ৩২ ডিগ্রি, সিলভার, গ্রিসিনো, মারবেলা, হাবিবি, এক্সাইল, হেইগ, হবনব এবং গুলশান এলাকার মন্টানা ও কর্টিয়র বাজার।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এসব বারে থাকা সিসা তৈরি নিকোটিন এবং এসেন্স ক্যারামেল মিশ্রিত স্লাইস দিয়ে। ফ্লেভারগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘লেডি কিলার’, ‘লাভ সিক্সটি সিক্স’, ‘হ্যাভানা লাইট’, ‘অরেঞ্জ মিন্ট’ ও ‘স্ট্রবেরি’। এসবে রয়েছে ০.৫ শতাংশ নিকোটিন। ডিএনসির রাসায়নিক পরীক্ষাগারে সিসা বারের যতগুলো আলামত পরীক্ষা করা হয়েছে কোনোটিতেই ০.২ শতাংশের নিচে নিকোটিন মেলেনি। আইন অনুযায়ী ০.২ শতাংশের বেশি নিকোটিনযুক্ত সিসা অবৈধ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী দেশে সিসা বার পরিচালনার কোনো বৈধ অনুমতি নেই। তবুও উচ্চবিত্তের একটি অংশ সিসায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে সিসা অতি লাভজনক হওয়ায় প্রভাবশালীরা এ ব্যবসায় ঝুঁকছে। ফলে অভিজাত এলাকাগুলোতে গোপনে সিসা লাউঞ্জ পরিচালিত হচ্ছে।
বাইরে থেকে ক্যাফে বা লাউঞ্জের সাজে সাজানো এসব বারে চলে সিসা পার্টি। সন্ধ্যার পর উচ্চ শব্দে বাজে মিউজিক, ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে থাকে অ্যালকোহলের গন্ধ। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া, এমনকি চাকরিজীবীদেরও নিয়মিত যাতায়াত থাকে এসব বারে। অধিকাংশ সিসা বার গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। নামমাত্র খাবারের আড়ালে বসে নেশার আসর। শুধু ফ্লেভারযুক্ত তামাক নয়, সিসার সঙ্গে মেশানো হয় ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিলের নির্যাস কিংবা লিকুইড কোকেন। পাশাপাশি চলে অনৈতিক কার্যকলাপও। অনেক সিসা বারে রয়েছে আলাদা কেবিন। যেখানে প্রবেশাধিকার থাকে শুধু নির্দিষ্ট গ্রাহকের। প্রতিটি কেবিন ঘণ্টাভিত্তিক ভাড়ায় দেওয়া হয়, যেখানে অতিথিদের জন্য রাখা হয় সিসা, অ্যালকোহল ও অন্যান্য মাদক। সেখানে চলে যৌন কার্যক্রম। এমন একটি সিসা বারের ফুটেজে দেখা গেছে, কেবিনে কয়েকজন যুবক-যুবতী মাদক সেবনের পর শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছে। সূত্র বলছে, এমন তরুণীদের দিয়েই এসব বারে মাদকসেবী গ্রাহক আকৃষ্ট করা হয়। আবার অনেক ছাত্র-ছাত্রী শারীরিক সম্পর্কের জন্য সিসা বারের এসব কেবিন ব্যবহার করে থাকে।
গত বৃহস্পতিবার ভোরে বনানীতে ‘৩৬০ ডিগ্রি’ সিসা বার থেকে বের হয়ে খুন হন ইন্টারনেট ব্যবসায়ী রাহাত হোসেন রাব্বি (৩১)। এ ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সিসা বারটিতে আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে এই হত্যাকাণ্ড হয় বলে জানিয়েছে র্যাব। এরপরই সিসা বারগুলোতে অবৈধ কার্যক্রমের চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জানা যায়, একই স্থানে আগে ‘এরাবিয়ান কজি’ নামে একটি সিসা বার চালু ছিল, যা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে বন্ধ হয়ে যায়। পরে কৌশলে নতুন নামে ‘৩৬০ ডিগ্রি’ নাম দিয়ে একই ধরনের অবৈধ ব্যবসা আবার শুরু হয়।
ডিএনসি সূত্র জানায়, সম্প্রতি রাজধানীর ১০টি সিসা লাউঞ্জ বা বারে অভিযান পরিচালিত হয়। এর মধ্যে ৯টি সিসা লাউঞ্জই বনানী এলাকার। গত বছরের ১ অক্টোবর বনানীর আল গ্রিসিনো রেস্টুরেন্টে অভিযান পরিচালনা করে ৫ কেজি ২১৪ গ্রাম সিসা ও দু’টি হুক্কা উদ্ধার করা হয়। পরে লাউঞ্জটির ম্যানেজার শফিকুল ইসলাম ও শিমু নামে একজনের নামে বনানী থানায় মামলা হয়। একই দিন ১১ নম্বর রোডের এরাবিয়ান কেজি নামে একটি সিসা লাউঞ্জে অভিযান পরিচালনায় ৩.৪ কেজি সিসা ও দুটি হুক্কা উদ্ধার হয়। ওইদিনই বনানীর ১১ নম্বর রোডে অবস্থিত সেলসিয়াস সিসা লাউঞ্জে অভিযান পরিচালনা করে ২২০ গ্রাম সিসা ও দুটি হুক্কা উদ্ধার করে তিনজনের নামে মামলা করা হয়। গত ৬ জানুয়ারি আবারও চালু হওয়া এরাবিয়ান কোজি রেস্টুরেন্ট থেকে চার কেজি সিসা, ছয় ক্যান বিয়ার ও ১১টি হুক্কা উদ্ধারের পর ছয়জনের নামে মামলা করা হয়।
এছাড়াও গত ২৪ জানুয়ারি বনানীর ক্লাব ৯২৯৪ লিমিটেডে অভিযান চালিয়ে চার কেজি সিসা, ১০টি হুক্কা ও ছয় বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়। ১১ মার্চ বনানী হেইজ সিসা লাউঞ্জে অভিযান পরিচালনা করে পাঁচ কেজি সিসা ও চারটি হুক্কা উদ্ধারের পর মামলা করা হয়। একই দিন বনানীর হবনব সিসা লাউঞ্জ থেকে ছয় কেজি ২০০ গ্রাম সিসা ও চারটি হুক্কা উদ্ধার করা হয়। ৮ এপ্রিল ধানমন্ডির ওজং রেস্টুরেন্টে অভিযান চালিয়ে তিন কেজি ৯৯০ গ্রাম সিসা ও ২০টি হুক্কা উদ্ধারের পর ছয়জনের নামে মামলা হয়। ১৬ মে বনানীর হেইজ সিসা লাউঞ্জে আবারও অভিযান পরিচালনা করে সাত কেজি সিসা ও ২৬টি হুক্কা জব্দ করা হয়।
২৮ মে বনানীর দি সিলভার লাউঞ্জে অভিযান পরিচালনায় পাঁচ কেজি সিসা ও ১৩টি হুক্কা জব্দ এবং চারজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
অবৈধ সিসা বারের বিষয়ে র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান শনিবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাকায় অবৈধ সিসা লাউঞ্জগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র তালেবুর রহমান বলেন, মাদক সংক্রান্ত বিষয়ে মূল কাজ করে থাকেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। বার বা ক্যাফেটেরিয়ার নামে অবৈধ কার্যকলাপের তথ্য পেলে অবশ্যই পুর্লিশ কাজ করবে।
জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মেহেদী হাসান বলেন, দেশে সিসা বার পরিচালনা অবৈধ। বিভিন্ন সময় গোপনে সিসা বার পরিচালনার অভিযোগে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি আবারও সিসা বার পরিচালনার তথ্য সামনে আসছে। শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করে অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা হবে।
