‘জেন-জি’ ঝড় কি এবার ফিলিপাইনে


‘জেন-জি’ ঝড় কি এবার ফিলিপাইনে
দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মুখে সম্প্রতি আইন সংস্কারের পথে হেঁটেছে ইন্দোনেশিয়া। গত সপ্তাহেই একই ধরনের আন্দোলনে নেপালে সরকার পতন হয়েছে। এবার বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের দুর্নীতির অভিযোগে ফুঁসে উঠেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনের জনগণ। সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের পাশাপাশি সম্প্রতি নেপালে যেমন বড় কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদের সন্তানদের ‘নেপো কিড’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে তাদের বিলাসবহুল জীবন যাপন তুলে ধরে ‘জেন জি’দের নেতৃত্বে ক্ষোভ প্রকাশ হয়েছে, সেই আদলে ফিলিপাইনেও টিকটক, ফেসবুক, এক্স হ্যান্ডেলে দেশটির প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীনদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবন যাপনের কঠোর সমালোচনা চলছে হ্যাশট্যাগ ‘নেপো বেবি’ শিরোনামে। এই ক্ষোভ শুধু অনলাইনে নয়, অফলাইনেও ছড়িয়ে পড়েছে। গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীদের জনসমক্ষে অপমান, অপদস্থ করারও অভিযোগ উঠেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশটির সরকার তদন্ত করে দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার মুখোশ উন্মোচনের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা আশ্বস্ত করতে পারেনি বিক্ষুব্ধদের। তারা আগামী রোববার ব্যাপক দুর্নীতিবিরোধী প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মৌসুমি বৃষ্টিতে নজিরবিহীন বিপর্যয় নেমে এসেছে ফিলিপাইনের জনজীবনে। তীব্র বৃষ্টির পর দেশটির রাস্তাগুলো যেন নদীতে পরিণত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ চলাচল নিয়ে সংকটে পড়েছেন। এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে লেপ্টোসপাইরোসিস নামে লিভারের রোগ, যেটি পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করা ইঁদুরের মল থেকে ছড়ায়। এমন পরিস্থিতিতে সরকার সড়ক, সেতু ও বাঁধ নির্মাণে বিলিয়ন বিলিয়ন পেসো ব্যয় করলেও কেন বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না—এমন প্রশ্ন তুলছেন বিক্ষুব্ধ লোকজন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম টিকটক, ফেসবুক ও এক্সে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। ‘ভূতুড়ে’ প্রকল্পের জন্য চুক্তি হয়, যেগুলো বাস্তবে কখনোই আলোর মুখ দেখে না—এমন অভিযোগ তুলে পার্লামেন্ট সদস্য ও নির্মাণ খাতের সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ জানাচ্ছেন সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এগুলোর নেপথ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্স ব্যাপকভাবে কাজ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও নেপালের অভিজ্ঞতা সঙ্গে মেলালে দেশটিতে চলমান ক্ষোভ ও এর অগ্রসরতা রাজনৈতিক ‘অশনি’সংকেতের ইঙ্গিত দেয়। কেননা, ফিলিপাইনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া ক্ষোভ সামাজিক মাধ্যমের জনপ্রিয় কিছু অ্যাকাউন্টের পেছনের মানুষদের একত্রিত করেছে। ক্রিয়েটরস অ্যাগেইনস্ট করাপশন নামের একটি গ্রুপ বলেছে, ‘আমরা থামব না। বরং আরও সোচ্চার হবো। আমরা ক্ষমতার সামনে আয়না ধরব এবং ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত সরে দাঁড়াব না।’ ফিলিপাইনের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে খানিকটা ধারণা পাওয়া যায় বিবিসিকে দেওয়া দেশটির এক স্কুল শিক্ষিকার সাক্ষাৎকারে। ক্রিসা তলেন্তিনো নামে ৩৬ বছর বয়সী ওই শিক্ষিকা জানান, প্রতিদিন তিনি প্যাডেলবোটে করে জলমগ্ন রাস্তা পাড়ি দিয়ে বাড়ি থেকে কর্মস্থল আপালিত শহরে যান। যাতায়াতের জন্য তার আর কোনো বিকল্প নেই। সেখানে তিনি ক্যান্সারের চিকিৎসাও নেন। তিনি জানান, অনেক আগেই বন্যাকে জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছেন তিনি। কারণ, বছরে মাত্র দুই মাসের মতো সময় সড়ক শুকনা থাকে। তবে এবার তিনি খুবই ক্ষুব্ধ। তলেন্তিনো বলেন, ‘আমি প্রতারিত বোধ করছি। আমি কঠোর পরিশ্রম করি, অপচয় করি না। আর প্রতি মাসে আমার বেতন থেকে কর কেটে নেওয়া হয়। তারপর শুনি, আমাদের কোটি কোটি টাকার কর দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকরা ভোগ করছেন।’ ক্রিসা তলেন্তিনো এই অভিযোগ এখন পুরো ফিলিপাইনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ রোমুয়াল্ডেজ মার্কোস জুনিয়র, যিনি বংবং মার্কোস নামেই বেশি পরিচিত, তিনিও এই সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন। একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পরিদর্শনে গিয়ে তিনি দেখেন, সেটি আদৌ নির্মিতই হয়নি। পরবর্তী সময়ে দেশটির অর্থনৈতিক পরিকল্পনা মন্ত্রীও এক বক্তব্যে জানান, বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে বরাদ্দকৃত সরকারি অর্থের ৭০ শতাংশই দুর্নীতির কারণে আত্মসাৎ হয়। এই ঘটনায় দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার পদত্যাগ করেন, যদিও তিনি কোনো দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। এ ছাড়া সেনেটের নেতাকে পদচ্যুত করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ—আইনত নিষিদ্ধ হলেও একটি সরকারি প্রকল্পের দরপত্রের কাজ পাওয়া একজন ঠিকাদার ২০২২ সালে তার নির্বাচনী প্রচারে অনুদান দিয়েছিলেন। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনেই পতন হয়েছিল মার্কোসের বাবার: ফিলিপাইনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বংবং মার্কোসের বাবাও দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তীব্র জনরোষের মুখে ১৯৭২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর দেশে সামরিক আইন জারি করেছিলেন ফিলিপাইনের দশম প্রেসিডেন্ট মার্কোস। আগামী রোববার ফিলিপাইনে যে দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছে, সেই দিনটিও ২১ সেপ্টেম্বর। এবার ক্ষমতায় মার্কোস সিনিয়রের ছেলে মার্কোস জুনিয়র। ফলে জনরোষ যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তা বংবং মার্কোসের ভালোই জানা থাকার কথা। কেননা, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মুখেই ১৯৮৬ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল তার বাবা, যার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বিলিয়ন বিলিয়ন পেসো আত্মসাতের অভিযোগ ছিল। ফলে গত সোমবার, ফিলিপিনোরা যখন জবাব চাইছিল, প্রেসিডেন্ট মার্কোস জুনিয়র তখন একটি তদন্ত শুরু করার ঘোষণা দেন, ‘প্রতারকদের মুখোশ খুলবে এবং তারা কত টাকা চুরি করেছে তা বের করবে’ বলে তিনি জানান। তিনি এও বলেন, ‘আমি যদি প্রেসিডেন্ট না হতাম, তাহলে হয়তো আমিও তাদের (আন্দোলনকারীদের) সঙ্গে রাস্তায় থাকতাম। তোপের মুখে ‘নেপো বেবি’রা: এদিকে সরকারি অর্থ অপব্যবহারের অভিযোগ আছে—এমন রাজনীতিবিদ ও ঠিকাদারদের সন্তানদের দিকেও ক্ষোভের তীর ছুড়ছেন দেশটির নেটিজেনরা। তাদের ‘নেপো বেবি’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে চিহ্নিত করা হচ্ছে। সম্প্রতি ফিলিপাইনের সাবেক এক পার্লামেন্ট সদস্যের মেয়েকে পোশাকের জন্য সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। তার সঙ্গে দামি হারমেসের বারকিন ব্যাগ ছিল এবং তিনি ফেন্ডি ও ডিওর মিলিয়ে পরেছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিক্ষোভকারীরা বলছেন, ‘নেপো বেবিদের’ উচিত করদাতাদের ধন্যবাদ জানানো। কারণ, তাদের কেনাকাটা ও ভ্রমণের খরচ সেই কর থেকেই আসে। তবে এ ধরনের মন্তব্য এড়াতে ‘নেপো কিডদের’ অনেকেই মন্তব্যের ঘর পুরোপুরি বন্ধ রেখেছেন।