শিক্ষার্থীদের দ্রুত ক্লাসে ফেরাতে হবে


চোর সন্দেহে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে ভবঘুরে যুবক তোফাজ্জলের মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে চলছে তোলপাড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ডে মর্মাহত গোটা জাতি। ফলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে দোষীদের চিহ্নিত করে কঠোর বিচারের আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-ছাত্র নেতারা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দ্রুত শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনার পরামর্শও তাদের। গত বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে নির্মম নির্যাতন করে মেরে ফেলে কিছু শিক্ষার্থী। আর এ ঘটনার পর নিন্দা জানান ঢাবির বর্তমান, সাবেক শিক্ষার্থীসহ দেশের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং ছাত্র নেতারা এ ধরনের ঘটনাকে ন্যক্কারজনক আখ্যা দিয়ে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কারও দায়িত্বে অবহেলা থাকলে তাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনার কথা জানিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় কেন এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে- জানতে চাইলে ঢাবির শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ বলেন, তরুণদের মাঝে সব সময় একটি স্পিরিট থাকে। সেই তরুণরা যখন ঐক্যবদ্ধ হয় তখন আরও বেশি স্পিরিট কাজ করে। এই তরুণরা যখন কোনো কাজের মধ্যে না থাকে তখন তারা যেমন কন্সট্রাকটিভ (গঠনমূলক) কাজে জড়ায়, একই সাথে ডেস্ট্রাকটিভ (ধ্বংসাত্মক) কাজেও জড়িয়ে পড়ে। কন্সট্রাকটিভ কাজের কথা যদি বলি তাহলে তারা বন্যার সময় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো কেমন হওয়া দরকার সেটার আইডিয়া দিচ্ছে। আর ডেস্ট্রাকটিভ কাজের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তোফাজ্জলের মৃত্যুর ঘটনা। এখন কেন তারা এটা করছে সেটা নিয়ে নানা ধরনের ইন্টারপ্রিটেশন আছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো সাইকোলজিক্যাল। আমার মতে, বিপ্লব-পূর্ব এবং বিপ্লব-পরবর্তী শিক্ষার্থীদের মনোজগত এক জায়গায় নেই। এটা বোঝার জন্য আমাদের গবেষণা করার দরকার আছে। তিনি বলেন, এই মৃত্যুর ঘটনার দায় তরুণরাও যেমন এড়াতে পারে না ঠিক তেমনি ওই হল প্রশাসনও এড়াতে পারে না। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যিনি সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে আছেন তারাও এড়াতে পারেন না। আমার কাছে মনে হয়েছে অনেক আগেই এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্লাসরুমে নিয়ে আসা উচিত ছিল। প্রশাসন ‘স্লো অ্যান্ড স্টেডি’তে এগিয়েছে। এটা ভালো হলেও সবসময় ভালো না। ফলে শিক্ষার্থীরা একটি ওপেন স্পেস পেয়েছে। তাদের কোনো কাজ নেই, পড়াশোনা নেই, তারা কী করবে। আর তাদের পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনতে না পারার দায় কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাষ্ট্রের উভয়ের আছে। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এই ‘মব জাস্টিসের’ নামে মানুষ মারা বন্ধের জন্য শিক্ষার্থীদের সবার আগে ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের কী কী দাবি দাওয়া আছে সেগুলোর একটি লিস্ট করা; একই সঙ্গে শিক্ষকদের বিষয়টিও আমলে আনতে হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শুধু শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকবান্ধব হচ্ছে না। আর শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে কোনটি দীর্ঘ সময়ে আর কোনটি স্বল্প সময়ে বাস্তবায়ন করবে সেটির বার্তাও শিক্ষার্থীদের দেওয়া। শিক্ষার্থীদের ডাকসু কিংবা সহশিক্ষা কার্যক্রমে সংযুক্ত করতে হবে। অন্যথায় তারা তাদের মস্তিষ্ককে কোথাও না কোথাও কাজে লাগাবে। সহজ কথায় তাদের এই ব্রেইনকে আমাদের কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগাতে হবে সেটা প্রতিভা বিকাশ কিংবা কোনো প্রডাক্টিভ কাজ হোক। একই সঙ্গে যাদের মানসিক সমস্যা হচ্ছে তাদের বিভাগ ওয়াইজ ডেকে কাউন্সেল করতে হবে। এছাড়াও যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। যাতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এটি একটি উদাহরণ হয়ে থাকে। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা ঘটবে এটি খুবই দুঃখজনক। ৫ আগস্টের পর ছাত্রদের রাজনীতিবিমুখ করার একটি প্রচেষ্টা চলছে। আর এ জন্য তথাকথিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে কে কত বেশি কথা বলতে পারে তার একটি প্রতিযোগিতা চলছে। এরই একটি প্রভাবে এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় যারা জড়িত তাদের প্রচলিত আইনে বিচার করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা উচিত। যেটি এই মব-কালচার চিরতরে বন্ধ করতে সহায়তা করবে। মব-কালচারের বিষয়ে ছাত্রদলের বক্তব্য হচ্ছে-ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে আমাদেরও অভিযোগ রয়েছে। তার মানে এই নয় তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে। মব-কালচারের নামে মানুষ মারা, এটি ছাত্রদল কখনোই সমর্থন করে না। তিনি বলেন, আমরা ফজলুল হক মুসলিম হলে দেখলাম শিক্ষার্থীদের সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে বোঝাপড়ার একটা গ্যাপ রয়েছে। জুনিয়র শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কথা না শুনে বেশি আক্রমণাত্মক আচরণ করেছে। তাই শিক্ষার্থীদের মাঝে দূরত্ব দূর করার জন্য অবশ্যই ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুরবৃত্তিমুক্ত সুষ্ঠু রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হবে। ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি রাগীব নাঈম বলেন, তোফাজ্জলকে মারার ঘটনাকে আমি ঠিক মব জাস্টিস বলতে পারি না। কারণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দেখি গুটিকয়েকজন মানুষ মিলে এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে। ফলে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনলেই এই সমস্যার সমাধান হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায় নিয়ে তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় পূর্ববর্তী স্বৈরশাসক ও গোয়েন্দারা মিলে একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ক্ষমতার চক্র বানিয়েছে। তারা সবাই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন থেকে সরে যায়নি। ফলে তাদের একটি ইন্ধন থাকতে পারে বলেও আমার মনে হয়। সাইফুল ইসলাম নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, অতিউৎসাহ থেকে শিক্ষার্থীরা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা আসলে বুঝতে পারেনি ঘটনাটি এতবড় হয়ে যাবে। তবে যারা এ ঘটনার সাথে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।